পিয়ূষ অধিকারী
নেপালের জেনজি বিপ্লবের ৪৮ ঘণ্টায় সারা দেশে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল—‘তাদের লেনিন কোথায়?’ কিন্তু এই বিপ্লবকে বোঝার জন্য এটি সম্ভবত একটি ভুল প্রশ্ন। দশকের পর দশক নেপালে সংঘটিত হওয়া বিপ্লবগুলো শত্রুদের কারণে ব্যর্থ হয়নি, বরং নেতাদের কারণেই ব্যর্থ হয়েছে। এবার কোনো একক নেতার অনুপস্থিতি দুর্বলতা ছিল না, উল্টো সেটাই ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
যখন বিক্ষোভ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো, তখন সুদান গুরুঙয়ের নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তিনি যুবকদের সংগঠন ‘হামি নেপাল’-এর প্রধান। কিন্তু গুরুঙ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেননি, তিনি সামনে আসেন আন্দোলন শেষ হওয়ার পর; তাও নেতা হিসেবে নয়, একজন মুখপাত্র হিসেবে। তার দেরিতে পরিচিতি পাওয়াই প্রমাণ করে কেন এই আন্দোলন ছিল আলাদা। নেতা নির্ধারণ না করে নেপালের তরুণ বিক্ষোভকারীরা অতীতের সেই ধারা ভেঙে দিয়েছে, যেখানে ক্ষমতা সবসময় কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকত। তারা দেখিয়েছিল, পরিবর্তন সামষ্টিক শক্তি থেকেও আসতে পারে, কোনো একক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব অপরিহার্য নয়।
নেতৃত্বের ধারণা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা এই বিপ্লব এটাও দেখিয়েছে, মানুষের ক্ষমতা মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে কী বিশাল আত্মত্যাগ করতে হয়। মানবিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই এটি ছিল নেপালের ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সময়গুলোর একটি। সংঘর্ষে অন্তত ৭৪ জন নিহত এবং প্রায় ২ হাজার ১১৩ জন আহত হন। গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ—সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট এবং সিংহদরবারকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতা শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ ছিল না; সারা দেশে অন্তত ৩০০টি স্থানীয় সরকারি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, গণমাধ্যমও রক্ষা পায়নি; নেপালের বৃহত্তম বেসরকারি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ‘কান্তিপুর মিডিয়া হাউস’-এও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন নেপালি রুপি (প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। প্রাথমিক সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শুধু সরকারি অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন রুপি। সংখ্যাটি নেপালের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক। ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ আর সংসদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল সেনাবাহিনী।
এই রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে বিপ্লবের বিকেন্দ্রীকৃত বৈশিষ্ট্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য বিপ্লবের সংগঠকরা তাৎক্ষণিকভাবে ‘ইউথ এগেইনস্ট করাপশন’ নামে ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মে একটি চ্যানেল খোলেন। ‘ডিসকর্ড নির্বাচন’ নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়াটি ছিল বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। হাজার হাজার মানুষ সেখানে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
এই প্ল্যাটফর্মে সাত হাজার পাঁচশর বেশি মানুষ ভোট দেন এবং শেষ পর্যন্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তবে শুধু এই ঘটনাগুলোর ভিত্তিতে বিপ্লবটিকে বিচার করলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। এই বিদ্রোহ কোনো পরিকল্পিত আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল একটি রিঅ্যাকশন। প্রথমে শুধু স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদে নেমেছিল। প্রথম দিনেই ১৯ জন বিক্ষোভকারী (যাদের কেউ কেউ ছিল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায়) নিহত হওয়ার ঘটনা পুরো দেশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। যে রাষ্ট্র তার নিজ সন্তানদের হত্যা করে, সেই রাষ্ট্রের প্রতীকী বিষয়গুলো জনগণের টার্গেটে পরিণত হয়।
এখন রাজপথের বিশৃঙ্খলা কিছুটা কমে গেছে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার নেপালিদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু সেই আশার সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে। নেপাল কি আবার আগের পক্রিয়ায় নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে, নাকি এবার তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন কোনো মানদণ্ড সৃষ্টি করবে? বিপ্লবের ৪৮ ঘণ্টায় নেপালের জনগণ সত্যিই বিশ্বাস করেছিল, ক্ষমতা জনগণের হাতে আছে। এটি নিছক বিশ্বাসও ছিল না; বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় জনগণ এই সত্য উপলব্ধি করেছিল।
এই বিপ্লবের শিক্ষা মনে রাখাই হবে জেনজি ও পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ। কীভাবে এবং কেন এটি ঘটেছিল, তাও আমাদের বিস্মৃত হওয়া চলবে না। এই বিপ্লবকে বুঝতে হলে আমাদের নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার ধারাবাহিকতা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না, একে দেখতে হবে পুনরাবৃত্ত এক ধারা হিসেবে। ২০২৫ সালের এই অভ্যুত্থান হঠাৎ করে ঘটেনি; এটি ছিল দীর্ঘদিনের বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ঘটা একটি বিস্ফোরণ।
মার্কসবাদী বিশ্লেষণ এটা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। আমরা মার্কসের ‘বেইজ’ ও ‘সুপারস্ট্রাকচার’-এর ধারণাগুলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করতে পারি। ‘রাজনৈতিক বেইজ’ বলতে নেপালের ক্ষমতার কাঠামোকে বোঝানো যেতে পারে। এই কাঠামো পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার এক জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। আর ‘রাজনৈতিক সুপারস্ট্রাকচার’ হলো সেই শক্তি, যা এই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানায় কখনো সংগঠিত কোনো দল হিসেবে, আবার কখনো জেনজির মতো বিচ্ছিন্ন জনগণ হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রতিটি আন্দোলনের পরেই ‘সুপারস্ট্রাকচার’ বেইজে পরিণত হয়। অর্থাৎ আন্দোলনকারীদের নেতারাই নতুন নিপীড়কে পরিণত হন।
গত শতাব্দীতে নেপালের প্রথম অভ্যুত্থানটি ঘটে ১৯৫১ সালে। অভ্যুত্থানের নেতা কৈরালা সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হন নেপালের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মাত্র এক দশক পর রাজা মহেন্দ্র সংসদ ভেঙে দেন, রাজনৈতিক দলগুলো বিলুপ্ত করেন এবং ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা চালু করেন। সার্বভৌমত্ব আবার রাজতন্ত্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। কেউ কেউ এই যুগকে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে মহিমান্বিত করেন, কিন্তু সেই যুগের অসন্তোষ থেকেই জন্ম নেয় ১৯৮০ সালের আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে ঘটে আধুনিক নেপালের দ্বিতীয় বৃহৎ বিপ্লব।
সেই বিপ্লবেরও একই পরিণতি হয়েছিল। আবারও রাজনৈতিক ‘বেইজ’ পরিবর্তিত হয়, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে গণতন্ত্রকামীরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিল, তারা সামন্ততন্ত্রের মূল কাঠামো ভাঙতে ব্যর্থ হয়। বরং তারা নিজেই এমন এক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা দেশকে নিয়ে যায় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে।
মাওবাদী বিদ্রোহ নেপালের ইতিহাসে যোগ করেছিল আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়। কমিউনিস্ট তত্ত্বে এই বিপ্লব পরিচালিত হলেও তারা পুরোনো দুষ্টচক্র থেকে বেরোয়নি। মাওবাদী অভিজাতরা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারেনি; তারা কেবল পুরোনো ব্যবস্থার অংশ হয়ে গিয়েছেন। যে কমান্ডাররা একসময় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তারাই পরে মন্ত্রী হয়ে সেই একই ব্যবস্থা বজায় রেখে শাসন করেছেন।
পেছনে তাকালে দেখা যায়, এসব বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাদের নেতৃত্বে। এ প্রেক্ষাপটে নেপালের সাম্প্রতিক জেনজি বিপ্লবে কেন্দ্রীয় নেতা না থাকা কোনো দুর্বলতা ছিল না, বরং সেটিই ছিল এর সবচেয়ে বড় কৌশলগত শক্তি।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, ২০২৫ সালের জেনজি বিপ্লব হঠাৎ কোনো বিস্ফোরণ ছিল না, বরং দশকের পর দশক ধরে এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ।
এখন নেপালের বিপ্লবী তরুণদের যে কাজটি অবশ্যই করতে হবে তা হচ্ছে—নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার এই চক্রকে ভেঙে ফেলতে হবে। কে ক্ষমতায় থাকবে, সেটি আর মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হচ্ছে ক্ষমতার অর্থই বদলে দেওয়া।
আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা
নেপালের জেনজি বিপ্লবের ৪৮ ঘণ্টায় সারা দেশে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল—‘তাদের লেনিন কোথায়?’ কিন্তু এই বিপ্লবকে বোঝার জন্য এটি সম্ভবত একটি ভুল প্রশ্ন। দশকের পর দশক নেপালে সংঘটিত হওয়া বিপ্লবগুলো শত্রুদের কারণে ব্যর্থ হয়নি, বরং নেতাদের কারণেই ব্যর্থ হয়েছে। এবার কোনো একক নেতার অনুপস্থিতি দুর্বলতা ছিল না, উল্টো সেটাই ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
যখন বিক্ষোভ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো, তখন সুদান গুরুঙয়ের নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তিনি যুবকদের সংগঠন ‘হামি নেপাল’-এর প্রধান। কিন্তু গুরুঙ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেননি, তিনি সামনে আসেন আন্দোলন শেষ হওয়ার পর; তাও নেতা হিসেবে নয়, একজন মুখপাত্র হিসেবে। তার দেরিতে পরিচিতি পাওয়াই প্রমাণ করে কেন এই আন্দোলন ছিল আলাদা। নেতা নির্ধারণ না করে নেপালের তরুণ বিক্ষোভকারীরা অতীতের সেই ধারা ভেঙে দিয়েছে, যেখানে ক্ষমতা সবসময় কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকত। তারা দেখিয়েছিল, পরিবর্তন সামষ্টিক শক্তি থেকেও আসতে পারে, কোনো একক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব অপরিহার্য নয়।
নেতৃত্বের ধারণা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা এই বিপ্লব এটাও দেখিয়েছে, মানুষের ক্ষমতা মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে কী বিশাল আত্মত্যাগ করতে হয়। মানবিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই এটি ছিল নেপালের ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সময়গুলোর একটি। সংঘর্ষে অন্তত ৭৪ জন নিহত এবং প্রায় ২ হাজার ১১৩ জন আহত হন। গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ—সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট এবং সিংহদরবারকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতা শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ ছিল না; সারা দেশে অন্তত ৩০০টি স্থানীয় সরকারি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, গণমাধ্যমও রক্ষা পায়নি; নেপালের বৃহত্তম বেসরকারি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ‘কান্তিপুর মিডিয়া হাউস’-এও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন নেপালি রুপি (প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। প্রাথমিক সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শুধু সরকারি অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন রুপি। সংখ্যাটি নেপালের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক। ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ আর সংসদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর শৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল সেনাবাহিনী।
এই রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে বিপ্লবের বিকেন্দ্রীকৃত বৈশিষ্ট্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য বিপ্লবের সংগঠকরা তাৎক্ষণিকভাবে ‘ইউথ এগেইনস্ট করাপশন’ নামে ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মে একটি চ্যানেল খোলেন। ‘ডিসকর্ড নির্বাচন’ নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়াটি ছিল বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। হাজার হাজার মানুষ সেখানে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
এই প্ল্যাটফর্মে সাত হাজার পাঁচশর বেশি মানুষ ভোট দেন এবং শেষ পর্যন্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তবে শুধু এই ঘটনাগুলোর ভিত্তিতে বিপ্লবটিকে বিচার করলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। এই বিদ্রোহ কোনো পরিকল্পিত আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল একটি রিঅ্যাকশন। প্রথমে শুধু স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদে নেমেছিল। প্রথম দিনেই ১৯ জন বিক্ষোভকারী (যাদের কেউ কেউ ছিল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায়) নিহত হওয়ার ঘটনা পুরো দেশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। যে রাষ্ট্র তার নিজ সন্তানদের হত্যা করে, সেই রাষ্ট্রের প্রতীকী বিষয়গুলো জনগণের টার্গেটে পরিণত হয়।
এখন রাজপথের বিশৃঙ্খলা কিছুটা কমে গেছে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার নেপালিদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু সেই আশার সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে। নেপাল কি আবার আগের পক্রিয়ায় নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবে, নাকি এবার তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন কোনো মানদণ্ড সৃষ্টি করবে? বিপ্লবের ৪৮ ঘণ্টায় নেপালের জনগণ সত্যিই বিশ্বাস করেছিল, ক্ষমতা জনগণের হাতে আছে। এটি নিছক বিশ্বাসও ছিল না; বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় জনগণ এই সত্য উপলব্ধি করেছিল।
এই বিপ্লবের শিক্ষা মনে রাখাই হবে জেনজি ও পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ। কীভাবে এবং কেন এটি ঘটেছিল, তাও আমাদের বিস্মৃত হওয়া চলবে না। এই বিপ্লবকে বুঝতে হলে আমাদের নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার ধারাবাহিকতা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না, একে দেখতে হবে পুনরাবৃত্ত এক ধারা হিসেবে। ২০২৫ সালের এই অভ্যুত্থান হঠাৎ করে ঘটেনি; এটি ছিল দীর্ঘদিনের বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ঘটা একটি বিস্ফোরণ।
মার্কসবাদী বিশ্লেষণ এটা বুঝতে সাহায্য করতে পারে। আমরা মার্কসের ‘বেইজ’ ও ‘সুপারস্ট্রাকচার’-এর ধারণাগুলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করতে পারি। ‘রাজনৈতিক বেইজ’ বলতে নেপালের ক্ষমতার কাঠামোকে বোঝানো যেতে পারে। এই কাঠামো পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার এক জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। আর ‘রাজনৈতিক সুপারস্ট্রাকচার’ হলো সেই শক্তি, যা এই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানায় কখনো সংগঠিত কোনো দল হিসেবে, আবার কখনো জেনজির মতো বিচ্ছিন্ন জনগণ হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রতিটি আন্দোলনের পরেই ‘সুপারস্ট্রাকচার’ বেইজে পরিণত হয়। অর্থাৎ আন্দোলনকারীদের নেতারাই নতুন নিপীড়কে পরিণত হন।
গত শতাব্দীতে নেপালের প্রথম অভ্যুত্থানটি ঘটে ১৯৫১ সালে। অভ্যুত্থানের নেতা কৈরালা সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হন নেপালের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মাত্র এক দশক পর রাজা মহেন্দ্র সংসদ ভেঙে দেন, রাজনৈতিক দলগুলো বিলুপ্ত করেন এবং ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা চালু করেন। সার্বভৌমত্ব আবার রাজতন্ত্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। কেউ কেউ এই যুগকে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে মহিমান্বিত করেন, কিন্তু সেই যুগের অসন্তোষ থেকেই জন্ম নেয় ১৯৮০ সালের আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে ঘটে আধুনিক নেপালের দ্বিতীয় বৃহৎ বিপ্লব।
সেই বিপ্লবেরও একই পরিণতি হয়েছিল। আবারও রাজনৈতিক ‘বেইজ’ পরিবর্তিত হয়, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু যে গণতন্ত্রকামীরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিল, তারা সামন্ততন্ত্রের মূল কাঠামো ভাঙতে ব্যর্থ হয়। বরং তারা নিজেই এমন এক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা দেশকে নিয়ে যায় এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে।
মাওবাদী বিদ্রোহ নেপালের ইতিহাসে যোগ করেছিল আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়। কমিউনিস্ট তত্ত্বে এই বিপ্লব পরিচালিত হলেও তারা পুরোনো দুষ্টচক্র থেকে বেরোয়নি। মাওবাদী অভিজাতরা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারেনি; তারা কেবল পুরোনো ব্যবস্থার অংশ হয়ে গিয়েছেন। যে কমান্ডাররা একসময় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তারাই পরে মন্ত্রী হয়ে সেই একই ব্যবস্থা বজায় রেখে শাসন করেছেন।
পেছনে তাকালে দেখা যায়, এসব বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাদের নেতৃত্বে। এ প্রেক্ষাপটে নেপালের সাম্প্রতিক জেনজি বিপ্লবে কেন্দ্রীয় নেতা না থাকা কোনো দুর্বলতা ছিল না, বরং সেটিই ছিল এর সবচেয়ে বড় কৌশলগত শক্তি।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, ২০২৫ সালের জেনজি বিপ্লব হঠাৎ কোনো বিস্ফোরণ ছিল না, বরং দশকের পর দশক ধরে এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ।
এখন নেপালের বিপ্লবী তরুণদের যে কাজটি অবশ্যই করতে হবে তা হচ্ছে—নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার এই চক্রকে ভেঙে ফেলতে হবে। কে ক্ষমতায় থাকবে, সেটি আর মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হচ্ছে ক্ষমতার অর্থই বদলে দেওয়া।
আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৪ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৪ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে