একটি দেশ সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত তখনই হয় যখন সেই দেশের শাসন বিভাগ এবং আইন ও বিচার বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে। একটি অপরিহার্য অংশ হলো বিচার বিভাগ। কোনো একটি বিভাগের ওপর অন্য বিভাগের হস্তক্ষেপ সেই দেশের স্বাধীনতাকে অবমূল্যায়ন করে।
রাষ্ট্র তখনই সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়, যখন সেখানে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা থাকে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে বিচারহীনতা যেন এক ভয়ংকর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আদালতের দোরগোড়ায় মানুষের ভিড় আছে, কিন্তু ন্যায়বিচারের আশ্বাস নেই। এই অদৃশ্য সংকটই ক্রমে আমাদের গণতন্ত্রের ভিতকে ক্ষয়ে দিচ্ছে। বিচারহীনতা যেন মৌনভাবে অন্যায়ের স্বীকৃতি প্রদান করে। বিচারহীনতা কেবল আদালতের বিলম্ব নয়, এটি একটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। মানুষ যখন দেখে অপরাধী মুক্ত, কিন্তু নিরীহ মানুষ শাস্তির মুখে, তখন সমাজে ন্যায়বোধ ভেঙে পড়ে। এই অন্যায়ের প্রতি সামাজিক সহনশীলতাই আজ বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে।
একজন সাধারণ নাগরিক জানে, বিচার চাইলে বছর নয়, যুগ লেগে যাবে। ফলে মানুষ আর আদালতের দিকে নয়, প্রভাব ও ক্ষমতার দিকে তাকায়। এভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ভেঙে যায়। পরক্ষণেই আক্ষেপ থেকে সাধারণ মানুষ আইনের আশ্রয় থেকে দূরে সরে যায় এবং অন্যায়বোধে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের একটি বিশাল অংশজুড়ে রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থার অশুভ এক অদৃশ্য সম্পর্ক রয়েছে।
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিচারব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে বা পড়ে আসছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে মামলার রায় পর্যন্ত রাজনৈতিক রঙ যেন সর্বত্র ছাপ ফেলছে।
বিচার বিভাগের ওপর যখন নির্বাহী বিভাগের ছায়া পড়ে, তখন আদালত আর সত্যের আশ্রয় নয়, বরং ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আইনের শাসন ভঙ্গুর হয়, আর গণতন্ত্র হারায় তার আত্মা। এর ফলে আইনের শাসনের বিপর্যয় ঘটে।
‘আইনের শাসন’ কথাটা এখন প্রায় স্লোগানে পরিণত হয়েছে, বাস্তবে নয়। কারণ যে সমাজে বিচার কিনে নেওয়া যায়, সেখানে আইন থাকে কাগজে আর বিচার পাওয়া যায় টাকা ও ক্ষমতায়। বিচারপ্রার্থী মানুষ বছরের পর বছর আদালতে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হয় না। একদিকে মামলার জট, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাব—সব মিলিয়ে মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে আইনের প্রতি।
আর মানুষ যখন বিশ্বাস করে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়, তখন গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাও ক্ষয়ে যায়। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতির বহু উদাহরণ রয়েছে। ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা, ধর্ষণ, অর্থ আত্মসাৎ, লুটপাট, ডাকাতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য হানাহানি-মারামারি করার পরও মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে মিথ্যা মামলায় দেশের নিম্নবর্গীয় সাধারণ মানুষেরা দিনের পর দিন আদালতে ঘুরতে থাকে। এটি বিচারহীনতার চরম ব্যর্থতাকে প্রকটভাবে তুলে ধরে।
অন্যায়ের সঙ্গে মানুষের মানিয়ে নেওয়াই বিচারহীনতার সবচেয়ে ভয়াবহ প্রতিফলন। যখন দুর্নীতিবাজ বা প্রভাবশালীদের অপরাধ প্রকাশ পেলেও মানুষ ভাবে, ‘তার কিছুই হবে না,’ তখন এই অস্বাভাবিকতাই স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয় এবং কারো অবাক লাগে না। এই চিন্তাই সমাজে নৈতিকতার মৃত্যু ঘটায়।
যেখানে অপরাধীকে ভয় করা হয় না, বরং প্রশংসা করা হয় তার প্রভাবের জন্য, সেই সমাজে গণতন্ত্র থাকে কেবল বাক্যবাণী হিসেবে, বাস্তবতায় নয়। সেইসঙ্গে গণতন্ত্রের ক্ষয়রেখা প্রসারতা লাভ করে, যা ভীষণ লজ্জাজনক। গণতন্ত্র টিকে থাকে তিন স্তম্ভের ভারসাম্যে, বিচার বিভাগ, আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ। এর মধ্যে যদি একটিও দুর্বল হয়, পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে। আজ বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকে বিশ্বাসই করে না—‘আইন সবার জন্য সমান।’
বিচার না পাওয়া মানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অন্যায়েকে মৌন অনুমোদন দেওয়া। আর এই অনুমোদনই গণতন্ত্রের ধ্বংসের সূচনা করে। বিচারহীনতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ হতে পারে সচেতন গণমাধ্যম ও সাহসী নাগরিক উদ্যোগ। গণমাধ্যম যদি সত্য বলার সাহস না করে, তবে রাষ্ট্র অন্ধকারেই থাকবে। আবার নাগরিক সমাজ যদি নীরব থাকে, তবে ক্ষমতার অপব্যবহার আরো গভীর হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কেবল আদালতের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাসের বাংলাদেশে, বিচারহীনতার দৃষ্টান্তে পূর্ণ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতির দায়মুক্তি, কিংবা নির্যাতনের বিচার না হওয়া—সবই এই সংস্কৃতিরই প্রতিচ্ছবি। কারণ বিগত সব দলীয় সরকারই প্রায় রাজনৈতিক প্রভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছে এবং দলীয় অনুকূলে বিচার বিভাগকে সাজ্জিত করেছে। একসময়কার এই বিচ্যুতি এখন সামাজিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই আজ ‘বিচার চাই’ বলা যেন প্রতিবাদের বদলে নিরর্থক আহ্বানে পরিণত হয়েছে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথেই গণতান্ত্রিক মুক্তি মিলবে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারপতি নিয়োগ, বিচার প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং আদালতের ওপর নির্বাহী হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। যখন বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হবে, তখনই গণতন্ত্র তার পূর্ণতা পাবে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ব্যাপ্তি ও তীব্রতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। এর পাশাপাশি সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, ন্যায্যতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ও সামাজিক প্রবৃদ্ধি নড়বড়ে হয়ে পড়বে। গণঅভ্যুত্থান একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক নয়, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্র শৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ন্যায়বিচারই গণতন্ত্রের আত্মা, কেননা ন্যায়বিচার শুধু আদালতের বিষয় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের নৈতিক চেতনার কেন্দ্রবিন্দু।
যেখানে বিচার নেই, সেখানে ভয় থাকে; আর যেখানে ভয় থাকে, সেখানে স্বাধীনতা টেকে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানে হলো গণতন্ত্রের ধীরে ধীরে মৃত্যু। এই সংস্কৃতি ভাঙতে হলে প্রয়োজন সাহস, নৈতিক শক্তি এবং সত্য বলার দায়বোধ।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই এক দিনে জয়ী হয় না, কিন্তু প্রতিটি প্রতিবাদই সেই লড়াইয়ের প্রথম পদক্ষেপ। না হলে আমাদের সমাজ আরো সহিংস এবং অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ashikhasanm03@gmail.com

