মানবিক বাংলাদেশের অপেক্ষায়

ড. মো. কামরুজ্জামান
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১১: ২৬

মাগুরার আট বছরের শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার করুণ মৃত্যুর ঘটনা পুরো বাংলাদেশকেই শোকে স্তব্ধ করেছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। এটি দেশে ক্রমবর্ধমান একটি সামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে বহু আগে থেকেই।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬ নারী এবং ২০২০ সালে ২২ হাজার ৫১৭ নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর আগে ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ এবং ২০১৭ সালে ছিল ৮১৮ জন।

বিজ্ঞাপন

আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫৭৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন পাঁচজন। ২০২৪ সালে ৪০১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৫ জন। ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে চারজনকে আর আত্মহত্যা করেছেন একজন।

এসব ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশে গণধর্ষণের ঘটনা নেহায়েত কম নয়। গণপরিবহনে ডাকাতি ও ধর্ষণ, পরিবহন জিম্মি করে ধর্ষণ, ঘরের মধ্যে চুরি ও ডাকাতি করার সময় ধর্ষণ, ছিনতাই করে ধর্ষণ, বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ধর্ষণ, স্বামীকে আটকে রেখে কলেজের গেস্ট রুমে স্ত্রীকে ধর্ষণ, বিএনপিকে ভোট দেওয়ার কারণে ভোটারকে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ধর্ষণ প্রভৃতি ঘটনা ছিল বাংলাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এসব ধর্ষণের কোনো বিচার হয়নি।

এমন ঘটনা প্রকাশ পেলে ভুক্তভোগীর অনেকেই মামলা করারও সাহস পান না। মামলা হলেও দোষী ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা যায় না। আবার আটক হলেও কিছুদিন পর আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যায়। এ অবস্থায় সমাজে একটা মেসেজ যায় যে, এমন অপরাধ করতে কোনো ভয় নেই। এ অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো সাজা বা শাস্তি হয় না।

বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যত মামলা হয়, তার সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ শতাংশ মামলায় আসামিরা শাস্তি পেয়ে থাকে। আর শুধু ধর্ষণের হিসাব করলে এই হার আরো কম হবে। কারণ এসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে অনেক সময় জড়িত থাকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অথবা সমাজের প্রভাবশালী অনেকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারও করে না। যারা রাজনৈতিকভাবে বা আর্থিকভাবে ক্ষমতাশালী, তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও দ্রুতই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যায় না। এ কারণে তাদের থামানোও যায় না।

অতীতে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ছাত্রনেতাকে প্রকাশ্যে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদ্‌যাপন করতেও দেখা গেছে। আবার সেই ছাত্রনেতাকে সরকার দেশ পরিচালনায় প্রশাসনে বা সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, দেশে অতীতের ফ্যাসিবাদী সরকার ধর্ষককে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে ধর্ষণে উৎসাহ জুগিয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সরকার এ-জাতীয় ঘৃণ্য কাজকে প্রমোট করেছে! অথচ এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ধর্ষণের মতো অপরাধ অবশ্যই কমে যেত।

দেশের বয়স ৫৪ বছর হলেও আজও সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মানুষের মনোজগতে আজও সৃষ্টি হয়নি মানবতা। গণঅভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী মুখে মানবতার কথা বললেও তাদের মনের মধ্যে জমে ছিল পঙ্কিলতা। তাদের মন-মগজ ও মস্তিষ্ক ছিল ফ্যাসিবাদী মানসিকতায় ভরা।

এই ফ্যাসিবাদী শাসন স্থায়ী করতে তারা মানবতা ও নৈতিকতাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। তারা পুলিশ, র‌্যাব, জনপ্রশাসনসহ অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিল মানববিধ্বংসী এক ভয়াবহ সিন্ডিকেট। সাংবাদিকদের তাদের দাস-দাসিতে পরিণত করেছিল। সরকারের অনুগত প্রচারমাধ্যমগুলো রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানিয়েছিল।

যেকোনো দেশ তাদের জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতেই গড়ে তোলে শিক্ষা কারিকুলাম। কিন্তু বাংলাদেশ দীর্ঘ এত দিনেও একটি জাতীয় আদর্শভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করতে পারেনি। প্রতিবছর শিক্ষা কারিকুলামকে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। নৈতিকতার বিপরীতে এসব কারিকুলামে স্থান দেওয়া হয়েছে আগডুম-বাগডুমের মতো অর্থহীন উপাদান। সৃজনশীলতার নামে শেখানো হয়েছে পৌত্তলিকতা ও যৌনতা। শ্রেণিকক্ষে উন্মুক্তভাবে স্থান পেয়েছিল যৌন অরগানগুলোর বিষয়ে আলোচনা।

লজ্জা ও সংকোচকে কবর দিয়ে পাঠদান করা হতো নারীর শরীর-বিষয়ক আলোচনা। ফলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা প্রাথমিক লেভেল থেকেই হারিয়ে ফেলেছিল লজ্জা ও ভদ্রতা। বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ড কালচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল তারা কাঁচা বয়সেই। অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড রূপ পেয়েছিল নান্দনিকতায়! প্রেমের অন্তরালে অনৈতিক সম্পর্ক ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল এসব কোমলমতি শিশু। মাঠে-ঘাটে, স্কুল-মাদরাসায় ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা লাজ-লজ্জাহীনভাবে মেলামেশায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল।

এসব কারণে মানুষের মনোজগতে সৃষ্টি হয়েছিল এক অনৈতিক বাসনা। আর এ অনৈতিক বাসনা জেগে ওঠা মানবপ্রকৃতির এক স্বাভাবিক নিয়ম। যুবক-যুবতীরা তো বটেই, আধা বয়সি পুরুষ-মহিলা এমনকি বৃদ্ধ বয়সের নারী-পুরুষের ভেতরেও এক ধরনের উন্মত্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে সমাজ ছিল ভয়ানক অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। আর তাদের এ অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ার বড় ধরনের সহায়ক উপকরণ হলো হাতের স্মার্টফোন।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় পর্নোগ্রাফি চালানোর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি থাকলেও বাংলাদেশে তা ছিল না। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি ব্যবহারের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে এদেশের কোমলমতি শিশুরা পর্নোগ্রাফির ভয়াল ছোবলে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকার প্রাথমিক স্তরের শতকরা ৯০ ভাগ শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত এবং যুবক-যুবতীর কথা বলাই বাহুল্য। মধ্যবয়সি ও বুড়ো-বুড়িরাও এর ছোবল থেকে রক্ষা পাননি। এসব পর্নোগ্রাফিতে কোনো নারীকে পুরুষের কাছে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে কোনো নারীর ব্যাপারে কোনো পুরুষের মনে কেবল ভোগ্যবস্তু বলেই ধারণা তৈরি হয়। ফলে সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় তথা সার্বিক জীবনে নারীর ওপর পুরুষের অনৈতিক প্রভাব বিস্তার বাড়তে থাকে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত দশকগুলোয় দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পুরোটা জুড়ে ছিল ভিনদেশি সংস্কৃতির রাজত্ব। বিগত দুই দশকে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ধর্মহীনতাকে প্রমোট করা হয়েছে মারাত্মকভাবে। সব ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া হলেও শুধু ইসলামকে পেশ করা হতো নেতিবাচকভাবে।

আইনে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও ভারত আর পশ্চিমাদের ভয়ে তা বাস্তবায়ন করা ছিল দুষ্কর। শাস্তি বাস্তবায়ন করা মৌলবাদীদের নীতি বলে জিগির তুলে দেশের সার্বিক পরিবেশকে অশান্ত করা হতো। অপরপক্ষে শাস্তি না দিলে বিচারহীনতার দোষে দোষী করে পানি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হতো। আর এর পেছনে যাবতীয় কলকাঠি নাড়াত শাহবাগিরা, যা পরিচালিত হতো ভারত থেকে।

ওপরের সার্বিক আলোচনা এটাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয় ছিল বহুমাত্রিক, যার কারিগর ছিল ভারতের প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট পতিত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত আগস্ট বিপ্লবে তার বিদায় হয়েছে। দেশের হাল ধরেছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গোটা পৃথিবী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাকে ব্যর্থ করতে একযোগে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদ, তাদের মদতদাতা ভারত এবং নতুন একটি ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী। দেশটাকে নানাভাবে অস্থির করার নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ড. ইউনূসকে ব্যর্থ করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে তারা।

দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ড. ইউনূসের হাতকে শক্তিশালী করতে বদ্ধপরিকর। তিনি আমাদের নতুন এক মানবিক বাংলাদেশ উপহার দেবেন বলে আশা করি, যেখানে ধর্ষণের মতো অমানবিক কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, শিশু আছিয়াদের করুণ আর্তনাদে বাতাস আর ভারী হবে না। এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। নতুন একটি মানবিক বাংলাদেশ দেখার অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে দেশবাসী, যেখানে নতুন ফ্যাসিবাদের কোনো স্থান হবে না।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত