ওয়াক্‌ফ বিল অস্তিত্ব সংকটে ভারতীয় মুসলিমরা

মো. ইশতিয়াক হোসেন রাতুল
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ৩৩

ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় আজ এক চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় অধিকার, সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব—সবকিছুই হুমকির মুখে। ২০২৫ সালের ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিলের পাস হওয়ার পর, এ পরিস্থিতি আরো তীব্র হয়েছে। এই বিলটি মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি, সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যা তাদের অস্তিত্বের প্রতি এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি ইসলামি আইন অনুযায়ী মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। ওয়াক্‌ফ বোর্ড এসব সম্পত্তি পরিচালনা করে এবং তা মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ একর। তবে এর সঠিক ব্যবহারের অভাব, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে এই সম্পত্তি মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

এখন নতুন ‘ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫’ পাস হওয়ায় এই সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। বিলটির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, কেন্দ্রীয় ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল ও রাজ্য ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি। এতে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির পরিচালনায় সরকার ও অন্য সম্প্রদায়ের আরো বেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সরকারের হাতে থাকবে বিতর্কিত ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণের ক্ষমতা, যা মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তির ওপর অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ভারতের মুসলমানরা বহু বছর ধরেই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা, ২০১৩ সালের মুজাফফরনগর দাঙ্গা ও ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা—এগুলোর মধ্যে কিছু বড় সহিংসতার ঘটনা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও তাদের নিজস্ব ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ—এসব এখনো চলমান। ২০১৪ সালে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিমদের প্রতি গোরক্ষার নামে গণপিটুনির (Mob Lynching) ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গোমাংসের অভিযোগে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ১০০টির বেশি হামলা হয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন।

২০১৯ সালে ভারত সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) পাস করে, যা মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই আইন অনুসারে, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও মুসলমানদের জন্য এই সুযোগ নেই। NRC (National Register of Citizens)-এর মাধ্যমে মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন করার ভয়ও তৈরি হয়েছে, যার ফলে ভারতের মুসলমানদের অবস্থান আরো জটিল হয়ে উঠেছে।

ভারতের মুসলমানরা শিক্ষা ও অর্থনীতির দিক থেকেও পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষার হার, কর্মসংস্থান, সরকারি চাকরি—এসব ক্ষেত্রে মুসলিমদের অংশগ্রহণ অপ্রতুল। ভারতের মুসলিমরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আর কর্মসংস্থানে তাদের অংশগ্রহণও মাত্র ৪-৫ শতাংশ অথচ জনসংখ্যার দিক দিয়ে তারা ১৫ শতাংশ।

সাচার কমিটির রিপোর্টে দেখা গেছে, ভারতের মুসলিমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দলিতদের থেকেও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তাদের একাধিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে প্রান্তিকতা, ন্যায়বিচারের অভাব, কর্মসংস্থানের সুযোগের সীমাবদ্ধতা এবং সরকারি সহায়তার অভাব।

ভারতের মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত অধিকার এখন হুমকির মুখে। হিজাব নিষিদ্ধকরণ, আজান নিয়ে বিতর্ক, মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙার মতো ঘটনা দেশে নিয়মিত হয়ে উঠেছে। মুসলিম সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বানও ক্রমাগত শোনা যাচ্ছে। মুসলিম ব্যবসায়ীদের হালাল খাদ্য বর্জন করতে বলা হচ্ছে এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উন্নয়নও অবহেলা করা হচ্ছে।

ওয়াক্‌ফ (সংশোধনী) বিল ২০২৫ মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি এবং ঐতিহ্যকে আরো সংকুচিত করতে পারে। গণমাধ্যম, শিক্ষা, রাজনীতি এবং সমাজে তাদের চিত্রায়ণ নেতিবাচক। মুসলমানদের নাম, পোশাক, ধর্মীয় চিহ্ন—এসবই হুমকির মুখে। এদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এবং তারা সামাজিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।

আজ ভারতীয় মুসলমানদের সামনে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এই বিল, সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং সামাজিক বৈষম্যের চাপের মধ্যে তারা ক্রমেই তাদের ধর্মীয় অধিকার এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় হারাতে বসেছেন।

ভারতের সংবিধান সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে; কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। এখনো মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তি ও সমাজে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত