আওয়ামী লীগ বহু পুরোনো এবং বড় রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালে আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শামসুল হকদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত দলটি গণতান্ত্রিক ও গণমুখী ছিল। পরে নেতৃত্বে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার মেয়ে শেখ হাসিনা, যাদের নেতৃত্বে দলটি ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচারে পরিণত হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এই শাসনামলগুলো ছিল দুঃশাসনে ভরা। তারা জনগণের প্রতি চরম জুলুম করেছে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রক্ষীবাহিনী গঠন করে সিরাজ সিকদার এবং জাসদের প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়, যাতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা এবং চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে আওয়ামী শাসনের অবসান হয়।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত শাসনটা তুলনামূলক ভালো ছিল। কারণ, তখন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ফলে মেয়াদ শেষে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং তাদের অধীনে ভোটের মাধ্যমে জিতে ক্ষমতায় ফিরতে হবে। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে বিএনপি-জামায়াত একজোট হলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করেছে এবং বলেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হয় না। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত হয়। অথচ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। ২০০৬ সালে বিএনপির ক্ষমতা শেষে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আওয়ামী লীগ মানেনি। ফলে ২০০৭ সালে ১/১১ সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালে ভোটে ১/১১-এর সরকারের সহযোগিতায় ও ভারতের চাওয়ায় আওয়ামী লীগকে জেতানো হয়।
এরপর ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতার মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না হয়, সে জন্য আদালতকে ব্যবহার করে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। এবার ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। অনেক সেনা কর্মকর্তা ও বিডিআর সদস্য চাকরি হারান। কয়েক হাজার বিডিআর সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও বিডিআরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কার্যত বিডিআরে কর্মরত ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন সেনা কর্মকর্তাদেরই হত্যা করা হয়।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে ভারতের পরামর্শে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি ভোটারবিহীন ও সাজানো নির্বাচন করে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এই দীর্ঘ সময়ে উন্নয়নের নামে অর্থনীতিতে বেপরোয়া লুটপাট এবং রাজনীতিতে দমন-নিপীড়ন চালানো হয়। ঋণের নামে ব্যাংক এবং শেয়ারবাজার থেকে কারসাজি করে লাখো কোটি টাকা লুট করে পাচার করা হয় বিদেশে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভও চুরি হয়। ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ করে এবং দেশ থেকে পাচার করেছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। বিরোধীদলীয় লোকদের মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদ পরিবর্তন করে দখল করা হয়।
একইভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মালিকানাধীন মিডিয়া যেমন—দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান, সিএসবি চ্যানেল, আমার দেশ এবং দিনকাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ এবং সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করা হয়। সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমানসহ অনেক সাংবাদিককে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হয়। বিরোধী দলের অফিস বছরের পর বছর বন্ধ রেখেছে এবং জনসভায় অনেকবার হামলা হয়েছে। চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরোধী মতের লোকদের বঞ্চিত করা হয়। ক্রীড়াঙ্গন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং বিচার অঙ্গনকেও চরম দলীয়করণ করা হয়।
তাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেননি। ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন বিরোধী দল বয়কট করে এবং ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে ভোটবাক্স পূরণ করা হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিরোধী দলের বৈঠকে পুলিশ হানা দিয়েছে এবং গোপন বৈঠকে নাশকতার অভিযোগ তুলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করেছে। বিরোধী দলের নেতাদের একেকজন নেতার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও হয়েছে। শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে ৮১০৫টি মামলা রয়েছে এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ আসামি। মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে, চলাফেরা করতে এবং নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারেনি। সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ছিল না। বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম ছিল নিষিদ্ধ। হলগুলোয় ছিল ছাত্রলীগের একক দখলদারিত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। ছিট দখল, চাঁদাবাজি এবং বিরোধী মতের ছাত্রদের ওপর নির্যাতন ছিল নিত্যদিনের চিত্র। যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। জামায়াত নেতা গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, এ কে এম ইউসুফ ও আবদুস সোবহানকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তারা কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাজানো মামলায় কারাদণ্ড দিয়ে জেলে নেওয়া হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি। তারেক রহমান দীর্ঘদিন থেকে নির্বাসিত এবং তাকেও বিভিন্ন মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বহু মানুষকে গুম করা হয় এবং বিরোধী মতের অনেক নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা হয়। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল এবং শিবির নেতা ওয়ালিউল্লাহ ও মোকাদ্দেস ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকেই নিখোঁজ। আয়না ঘর প্রতিষ্ঠা করে অনেককে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়। ব্রিগেডিয়ার আজমী এবং ব্যারিস্টার আরমান আট বছর আয়না ঘরে বন্দি থাকার পর মুক্তি পান। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা থেকে অপহৃত হয়ে ৯ বছর পর ভারত থেকে দেশে আসেন। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। অধিকারের তথ্যমতে, সেদিন ৬১ জন মানুষ মারা যায়।
সংগঠনটির মতে, ২০০৯-২৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসন আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা যান ২ হাজার ৬৯৯ জন, গুম হন ৬৭৭ জন এবং কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ৪৮ জন। বিরোধী দলের নেতাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা করা ছিল নিত্যদিনের চিত্র। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতি ছিল লাগামহীন। উন্নয়নের নামে বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়ে বড় বাজেট এবং বড় দুর্নীতি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার অফিসের পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক, হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। সিন্ডিকেটের কারণে জিনিসপত্রের দাম ছিল বরাবরই বেশি ও ঊর্ধ্বমুখী। পুলিশ, প্রশাসন, বিচারালয়সহ সবকিছুকে দলীয়করণ করা হয়। মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে অবজ্ঞা এবং আলেম সমাজকে বরাবরই নির্যাতন করা হয়েছে। অসংখ্য আলেমকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও তাদের স্বার্থে সবসময় কাজ করেছেন শেখ হাসিনা। এসব কারণে জনগণ ছিল খুবই অসন্তুষ্ট এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। এভাবে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান হয়, যা থেকে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নিতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com


আওয়ামী দোসরদের নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ, নেতৃত্বে যারা
রেসিডেন্সিয়াল কলেজের পাশে মা-মেয়ের লাশ
মুখোশ গণতন্ত্রের নামে ভেতরের বাকশাল কায়েম করেছিল হাসিনা