নীরবতা কোনো দুর্বলতা নয়। শান্তিপ্রিয় মানুষ নীরব থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অনেক বিষয় বুঝেও ঝামেলা এড়াতে এড়িয়ে যান। এই শ্রেণির মানুষের প্রতিবাদের মাধ্যমই হলো নীরবতা। কিন্তু স্বৈরাচার সরকার মানুষের এই নীরবতাকে দুর্বলতা মনে করে ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করেছে। মানুষের নীরবতাকে পুঁজি করে এ দেশের মানুষের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছে, তার যে বীভৎস রূপ আজ চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে।
৫ আগস্টে স্বৈরাচারের পলায়নের পর থেকে তার যত অপকর্মের সাক্ষী এই বাংলার মানুষ হয়েছে, সেটা বর্ণনা করাও খুবই কঠিন। এমন বীভৎস হত্যাযজ্ঞ কোনো মানুষের দ্বারা বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম। হিটলার তার জীবদ্দশায় যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিলেন, সেটার তুলনায় ক্ষুদ্র আয়তনের এই বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের আনুপাতিক হার অনেক বেশি। এমনসব অপকর্ম ঘটানো হয়েছে, যেটা এই বাংলার মানুষের চিন্তাশক্তির অনেক বাইরে।
বিভিন্ন সময় হাসিনা সরকার টিভি-মিডিয়ায় এসে যে কান্নাকাটি করে বুক ভাসাতেন। তার কান্না দেখে মনে হতো আহারে কী মমতাময়ী মা পেয়েছে এই বাংলার মানুষ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এটাই কোকোডাইলস টেয়ার্সের যথাযথ উদাহরণ।
৫ আগস্টের আগে ফেসবুক চালাতে ভয় করত না জানি কখন কী পোস্ট হয়ে যায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। এখন সহ্য-ক্ষমতার বাইরের অনেক ঘটনা সামনে এসে পড়ে। কারো মাথার খুলির ৪৫ শতাংশ বুলেটে উড়ে গেছে। কারো বা নাক, মুখ-চোখ এক হয়ে গেছে খুনির বুলেটে। কলিজা কেঁপে উঠে সেই স্থির চিত্রগুলো চোখের সামনে এলে। ভাবা যায় একটা মানুষের শরীরে আরেকজন মানুষ কীভাবে ১০, ১৫ এমনকি ২০টা পর্যন্ত গুলি চালায়। একটা মানুষের শরীরে ২০টা গুলি চালাতে একজন মানুষকে কতটুকু অমানুষ হতে হয়?
বিবিসির এক তথ্যে বলা হয়েছে, ১৯ জুলাই ঢাকার উত্তরায় পুলিশের গুলিতে আহত হন কলেজশিক্ষার্থী রাইসুল রহমান রাতুলকে পুলিশ পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে গুলির বিস্ফোরণে রাতুলের ভুঁড়ি বেরিয়ে যায়। রাতুলের ভাষায়Ñ“পুলিশ হয়তো আমাকে আগে থেকেই টার্গেট করেছিল। কারণ সেদিন সকাল থেকেই আমি আহতদের ফার্স্ট এইড দিয়ে সাহায্য করছিলাম।
তো মসজিদ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন পুলিশ এসে আমাকে ধরে ফেলে। আমার কোমরের বেল্ট ধইরা বলতেছে, সাইডে চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে। ‘আমি যাইতে চাই নাই’। জাস্ট এটুকুই বলছি, কেন যাব? সঙ্গে সঙ্গেই পাশের একজন পুলিশ বলে যে তুমি যাবা না? আচ্ছা ঠিক আছে, বলেই সে ডিরেক্ট আমার পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে ফায়ার করে। একদম তলপেটে শটগানের গুলি বিস্ফোরণের মতো হলো। পেট থেকে আমার ভুঁড়ি বের হয়ে যায়। আমি নিজ হাতে আমার ভুঁড়ি ধরে রেখেছিলাম।”
মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৭৫ জন নিহত এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। ১২টি জাতীয় দৈনিক, এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিট ও সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, নিহতদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই গুলিতে মারা গেছে। এ ছাড়া অভ্যুত্থানে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দীর্ঘ ৯ মাসে এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকে শহীদ করেছিল আর ২০২৪-এ এসে এ দেশেরই স্বৈরাচার সরকার এক মাসে ৩০ হাজার মানুষকে তাদেরই টাকায় কেনা গুলিতে জীবন দিতে হবে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘মোট ৭৭২ জনের মৃত্যুর ধরন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৯৯ জন বা ৭৭ শতাংশ গুলিতে নিহত হয়েছে। ৬১ জন (৮ শতাংশ) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। ৮৫ জনকে (১১ শতাংশ) পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অন্যান্য কারণে মারা গেছে ২৭ জন (৪ শতাংশ)।’ আহারে কি নৃশংসতা চালানো হয়েছে, এ দেশের মানুষের ওপর। চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন।
এইচআরএসএস জানিয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের একাংশের বয়স, পেশা, মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩২৭ জন এবং ৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা যান) ৫৪৮ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৭৭ শতাংশ গুলিতে মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সিদের মৃত্যুহার ৫৩ শতাংশ। আর ৩০ বছরের মধ্যে বয়স ধরলে, নিহতের হার দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী, এ হার ৫২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে গুলিতে এবং পুলিশের হামলায়।
এটা তো শুধু ২০২৪-এর একাংশের পরিসংখ্যান। তাহলে এই ১৭ বছর যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, এ দেশের মানুষের ওপর সেটার হিসাব মেলানো খুবই কঠিন।
মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের দেশে একটি অবহেলিত বিষয় এবং এই বিষয়ে অনেক নেতিবাচক মনোভাবও জনমনে রয়েছে। আমাদের উচিত হবে স্বৈরাচার পতনের যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি মানসিক সহানুভূতি দেখানো। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে, সে অনুযায়ী সহায়তা দেওয়ার বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।

