আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা কি সম্ভব?

ড. মাহবুবুর রাজ্জাক
মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা কি সম্ভব?
ড. মাহবুবুর রাজ্জাক

মানুষ মায়ের ভাষা সবচেয়ে ভালো বোঝে। তাই মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে-বিদেশে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে উচ্চশিক্ষা মাতৃভাষায় সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিতর্কটি বেশ পুরোনো। এটি নির্ভর করে মাতৃভাষাটি যাদের, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কতটা অগ্রসর তার ওপর। যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের কোনো একটি শাখা বিকশিত হয়, তাদের ভাষায় স্বাভাবিকভাবেই সেই শাস্ত্রসংশ্লিষ্ট শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। তাই তাদের মাতৃভাষায় সেই শিক্ষা সহজ হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু যে জনগোষ্ঠী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অনগ্রসর এবং যারা অনুবাদের মাধ্যমে কোনো একটি শাস্ত্র অধ্যয়ন করে থাকেন, তাদের মাতৃভাষায় শুধু নিজস্ব শব্দভান্ডার দিয়ে সেই শাস্ত্রের অধ্যয়ন পূর্ণাঙ্গভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

এ অবস্থায় সাধারণত দুটি উপায় অনুসরণ করা যায়। একটি উপায় হলো মূল শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করা, তবে নিজস্ব হরফে লেখা। যেমন: আমরা নিঃশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ করি। এই বাক্যটিতে ‘অক্সিজেন’ শব্দটি বাংলা হরফে লেখা একটি বিদেশি শব্দ। তবে বাক্যটির ভাব বুঝতে কোনো বাঙালির অসুবিধা হয় না। দ্বিতীয় উপায়টি হলো বিদেশি শব্দের পরিবর্তে পরিভাষা ব্যবহার করা। যেমন, ওপরের বাক্যটিতে অক্সিজেনের পরিবর্তে আমরা তার পরিভাষা ‘অম্লজান’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। পুরোনো বই-পুস্তকে ‘অম্লজান’ শব্দটির ব্যবহার বেশি দেখা যায়। তখন এমন ধারণা দেওয়া হতো, ‘অম্লজান’ শব্দটি অক্সিজেন শব্দের বাংলা পরিভাষা। অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে এটি একটি কৃত্রিম শব্দ, নতুন ভাষা। এই শব্দটি আসলে বাংলা কি না, সে নিয়ে বিতর্কে না গিয়েও নির্দ্বিধায় বলা যায়, এটি আমার মায়ের ভাষা তথা মাতৃভাষা নয়। মাতৃভাষার বাইরে গিয়ে যদি কোনো নতুন শব্দ শিখতেই হয়, তবে পরিভাষা কেন, সরাসরি মূল ভাষায় শব্দটি শিখতে অসুবিধা কোথায়?

বিজ্ঞাপন

মূল ভাষার শব্দ বাংলা হরফে লিখে সরাসরি ব্যবহার করাটাই বরং বেশি যুক্তিযুক্ত। পাম্পের পরিভাষা দমকল। তবে ‘পাম্প’ আজকাল মাতৃভাষার মতোই একটি অতিপরিচিত শব্দ হয়ে উঠেছে। কাজেই ‘দমকল’ শব্দটি ব্যবহার না করে সরাসরি পাম্প শব্দটি ব্যবহার করতে অসুবিধা নেই। তবে একটি শব্দ ততটা পরিচিত শব্দ না হয়ে থাকলে মূল শব্দটি ব্র্যাকেটে ল্যাটিন হরফে পাশাপাশি লিখে দিলে ভালো হয়; যেমন সাবমারসিবল পাম্প (submersible pump), ভিসকোসিটি (viscosity) প্রভৃতি। এতে বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। যেমন, কেউ ইংরেজিতে অধিকতর পড়াশোনা করতে চাইলে বা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে তাকে এই শব্দগুলো আর নতুন করে শিখতে হবে না। অন্যদিকে যারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশি শ্রমবাজারে যাবেন, অথবা দেশে থেকেই বিদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগে সম্পৃক্ত হবেন, তারাও ভাষাগত সুবিধা পাবেন।

বর্তমানে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে জ্ঞানের প্রসার হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দেশে অনবরত নতুন নতুন শব্দভান্ডার তৈরি হচ্ছে। এত দ্রুতগতিতে এই বিপুল শব্দভান্ডারের পরিভাষা তৈরি করা সম্ভব নয়। বাংলায় যারা পাঠ্যবই লেখেন এবং যারা পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে আছেন, তাদের উচিত অবিলম্বে পাঠ্যবইয়ে পরিভাষা ব্যবহারের বিষয়ে একটি বাস্তবসম্মত নীতিমালা গ্রহণ করা। অপ্রয়োজনীয় পরিভাষা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা উচিত। শিক্ষা হোক যতটুকু সম্ভব মাতৃভাষা বাংলায়, নয়তো বাংলা হরফে লেখা মূল ভাষায়—পরিভাষাসমৃদ্ধ কৃত্রিম বাংলায় নয়।

কোন স্তর পর্যন্ত শিক্ষা মাতৃভাষায় হবে, সে ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা মাতৃভাষা বাংলায় হওয়া উচিত। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও জাতির সঙ্গে মানসিক বন্ধন সুদৃঢ় করা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। তবে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে চাইলে এবং আমাদের শিক্ষিত জনশক্তিকে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের উপযুক্ত কর্মশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে স্নাতক পর্যায়ের সব পড়াশোনা ইংরেজিতে পরিচালনা করা প্রয়োজন। এতে প্রথমত, আমাদের ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সহজ হয়। দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে মানসম্পন্ন পাঠ্যবই অনেক পাওয়া যায়। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে তৈরি করা পাঠ্যবই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসম্পন্ন হয় না। মানসম্পন্ন পাঠ্যবই রচনার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি আমাদের এখনো গড়ে ওঠেনি। আমাদের বুঝতে হবে, যেই দেশে গবেষণা হয় না বললেই চলে, সেই দেশে ভালো পাঠ্যবই লেখক তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।

স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনায় মূলত পেশাগত দক্ষতা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। তাই এই পর্যায়ের শিক্ষায় গলদ থাকলে পেশাগত সমস্যা তৈরি হয়, ভালো শ্রমশক্তি তৈরি হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ আবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাই স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনায় গলদ থাকলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। স্কুলগুলোয় যারা গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলোর পাঠদান করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই এসব বিষয়ে দুর্বল। এই দুর্বলতার পেছনে মানহীন পাঠ্যবই অন্যতম একটি কারণ। কাজেই যতদিন পর্যন্ত মানসম্পন্ন পাঠ্যবই মাতৃভাষা বাংলায় পাওয়া না যাবে, অন্তত ততদিন পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়া উচিত।

তাছাড়া গবেষণার সারমর্ম প্রকাশ করে সব গবেষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি উপায় হচ্ছে জার্নাল পেপার প্রকাশনা। যে বিশ্ববিদ্যালয় বেশি সংখ্যায় ভালো মানের জার্নাল পেপার প্রকাশ করতে পারে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে তত এগিয়ে থাকে। আজকাল নামকরা মূল জার্নালগুলোর ভাষা ইংরেজি। তাই স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা ইংরেজি মাধ্যমে না হলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় জার্নাল পেপার প্রকাশনার দিক থেকে পিছিয়ে থাকবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা যদি কিছু হয়েও থাকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঠিকমতো তা জানতে পারবে না। সেই বিশ্ববিদ্যালয় হবে শুধু ডিগ্রি দেওয়ার কারখানা, প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশের মতো একটি জনঘনত্বপূর্ণ দেশে সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দেশের ভেতরেই করা দুঃসাধ্য। আমাদের জনশক্তি রপ্তানি করতে হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমাদের দেশের কর্মক্ষম জনশক্তির একটি বড় অংশ কাজের সন্ধানে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। বিদেশগামী এই জনশক্তি যদি ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের ন্যূনতম দক্ষতাও অর্জন করতে পারত, তাহলে তাদের আয় বহুগুণে বেড়ে যেত। সরকার যদি বিদেশগামী শ্রমশক্তিকে ইংরেজি ভাষায় অথবা যেই দেশে যাচ্ছে, সেই দেশের ভাষায় যোগাযোগে সমর্থ করে তুলতে অর্থ বিনিয়োগ করে, তবে তা হবে একটি লাভজনক বিনিয়োগ। এ ধরনের বিনিয়োগের ফলে রেমিট্যান্স নিঃসন্দেহে অনেকগুণে বাড়বে।

মাতৃভাষায় শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একটি জনগোষ্ঠীর পুরো জনশক্তিকে শিক্ষিত করে তোলার প্রক্রিয়াটিকে সহজ করা। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটি শিক্ষিত বেকার জনশক্তি তৈরি করা কখনোই আমাদের কাম্য হতে পারে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনায় শিক্ষিত জনশক্তির কর্মসংস্থানের বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রশ্নটি কর্মসংস্থানের প্রশ্নের সঙ্গে একত্রে বিবেচনা করতে হবে। শিশু শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষায় হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মাধ্যম জাতীয় ভাষা অর্থাৎ আমাদের ক্ষেত্রে বাংলা হওয়া উচিত। স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনার সঙ্গে পেশার সম্পর্ক নিবিড় হওয়ায় এবং বিদেশের শ্রমবাজারে আমাদের শিক্ষিত জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধির প্রয়োজন থাকায় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার মাধ্যম আবশ্যিকভাবেই ইংরেজি হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন