চড়াই-উতরাই

জাতির পিতা : উটকো দাহ

আবদুল হাই শিকদার
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৭
আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ২৫

এক

এই মহাপৃথিবীতে বোধ করি আমরাই একমাত্র জাতি, যাদের সম্পর্কে কবি বলেছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুধাবন করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।’

বিজ্ঞাপন

এই কাণ্ডটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের তথাকথিত সুশীলদের দিকে তাকালে। তারা কোনো কাজে অগ্রণী নন, তারা কোনো কাজ অনুসরণ করেন মাত্র। তারা কাজের কাজ কিছুই করেন না, কিন্তু সংকট ও সমস্যা সৃষ্টির জন্য গায়ে পড়ে পরামর্শ দিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তারা আন্দোলন-সংগ্রামে নেই, কিন্তু বাতাসের ভাব বুঝে শেষ মুহূর্তে নিতান্ত বিড়ালতপস্বীর মতো, পরবর্তী সূর্যোদয়ের মাখন খাওয়ার লোভে বেহায়ার মতো, গিরগিটির মতো রং পাল্টে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’র মতো সবাইকে টেক্কা দিয়ে মঞ্চ জাঁকিয়ে বসেন। তেলবাজি, তোষামোদ, দলদাসত্ব ও ক্ষমতার তাঁবেদারি করতে অতিশয় সরফরাজ বোধ করেন। কাজের বদলে তৈরি করেন অকাজ। সংগ্রামে তারা নেই, কিন্তু আছেন হুজ্জতে। চাপান উতোর আর মগজ ধোলাইয়ের কাজে তাদের নিয়োগ দেয় আধিপত্যবাদ। সেই অর্থে তাদের পদবি হতে পারে ‘নিয়োগী’। এই নিয়োগীরা দেশপ্রেমের ভান ধরেন। দেশ ও জনগণের ওপর চাপিয়ে দেন আধিপত্যবাদের এজেন্ডা। এরা প্রভুর খুদ-কুঁড়া খাওয়ার বিনিময়ে দেশকে বিপদের জালে জড়িয়ে, দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার যুক্তিসংগত সব অর্জনকে ‘কুকুরটিকে একটি খারাপ নাম দাও’ স্টাইলে মগজ ও পাঠের টেবিল থেকে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করে জাতীয় স্বার্থবিরোধী, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পাটাতন বিনষ্টকারী একের পর এক রাষ্ট্রঘাতী ও জাতিঘাতী বয়ান প্রচার করে।

এই রকমই একটি অপ্রয়োজনীয় ও উটকো বিষয় ‘জাতির পিতা’ প্রসঙ্গ।

দুই

জাতির পিতা টার্মটার মধ্যেই রয়েছে সামন্তবাদের দুর্গন্ধ। এই পদ্ধতির উদ্ভবই হয়েছে ব্যক্তিপূজার মানসিকতা থেকে। এখানে একজন ব্যক্তিকে দোষত্রুটি, আইন-আদালতসহ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে কঠিন স্বার্থবুদ্ধি। এই স্বার্থকে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করার জন্য লেলিয়ে দেওয়া হয় সুশীল সমাজকে। আর দলীয় গুণ্ডপাণ্ডাদের নামানো হয় ওয়াচডগের ভূমিকায়। এরা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় ত্রাস। সবাইকে দিয়ে নানামাত্রিক রূপকথা তৈরি করা হয়। উদ্ভট, অবিশ্বাস্য গল্প দিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত করা হয় মহিমান্বিত। পাশাপাশি অন্ধের মতো ও উন্মাদের মতো অন্য সবার অবদান ও ভূমিকাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়।

ক্ষমতার নির্যাতন দিয়ে বিরোধী সব মতকে নিষ্ঠুরভাবে নির্মূল করা হয়। গণমাধ্যমকে সেবাদাসে পরিণত করে, প্রচারণা ও প্রপাগান্ডা দিয়ে সৃষ্টি করা হয় ধূলিঝড়। মন, মগজ, বুদ্ধি, বোধ—সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় রাষ্ট্র। তারপর আইন ও আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নির্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে মানতে বাধ্য করা হয় জনগণকে। ফলে অচিরেই আইনের শাসন পরিণত হয় দলীয় শাসনে। পরে দলীয় শাসনেরও ঊর্ধ্বে উঠে ব্যক্তির শাসন। জন্ম হয় স্বৈরাচারের, যার শেষ ঠিকানা হয়ে ওঠে জিঘাংসা ও প্রতিহিংসার নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদ। হত্যা, গুম, হামলা, মামলা, জেল, জুলুম প্রভৃতির ভয়ানক ভীতি ছড়িয়ে ফ্যাসিবাদ হয়ে ওঠে সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা। প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, গণমাধ্যমসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান তখন পরিণত হয় আজ্ঞাবহ ভৃত্যে, বিবেকবর্জিত রোবটে। নীতি, নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবতা এবং বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কোথাও কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।

তিন

প্রাচীন রোমে এই ‘জাতির পিতা’ ধারণাটি শাসকরা এবং তাদের কৃপাজীবীরা আবিষ্কার করে। শাসককে, সিজারকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের জন্য তোষামদের চরম পরাকাষ্ঠা হিসেবে একে দেখা যেতে পারে। তাদের মতে, যে শাসক একটি দেশ, রাষ্ট্র বা জাতি গঠন করেছেন, তাকে জাতির পিতা বলা যেতে পারে। তাদের ভাষায় ‘পাতের পাত্রিয়া’। আবার ‘প্যারেন্স পাত্রিয়াই’ও বলা হতো, যার অর্থ ‘জন্মভূমির জনক’। সবটাই রোমান শাসকদের ইচ্ছায় হতো। প্রথমে এটি রোমান সিনেট, পরে রোমান সম্রাট অনুমোদন দিতেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রাচীন রোমে অনেক জাতির পিতার প্রাদুর্ভাব হয়েছে। যখন যিনি ক্ষমতাধর হতেন, তিনিই জাতির পিতা হয়ে উঠতেন।

পর্তূগাল কিংবা চেক রাষ্ট্রে বিষয়টা একটু ভিন্ন রকম ছিল। তারা রাষ্ট্রে বিদ্যমান সকল বংশধরের একজন কাল্পনিক পূর্বপুরুষ আছে বলে ধরে নিত। পর্তুগালে একে বলা হয় ‘লুসাস’, চেক-এ ‘রাস’।

যখনই কোনো রাজা নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতেন, তিনিই হয়ে উঠতেন জাতির পিতা। আবার কেউ যদি তেমন গা না করতেন, সে ক্ষেত্রে রাজা নিজেই নিজেকে জাতির পিতা ঘোষণা দিতেন। তার বংশের পতনের মধ্য দিয়ে তার জাতির পিতাগিরিও বিলুপ্ত হয়ে যেত। নতুন রাজবংশ নতুন করে জাতির পিতা বেছে নিত। যেমন টোগোর ‘নাসিংবি এদিমা’, জায়ারের ‘মোবুতু সেসি সেকু’।

উত্তর-ঔপনিবেশিক আফ্রিকার অনেক নেতাই স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান রেখোছিলেন, এই যুক্তিতে তারা নিজেরাই নিজেকে জাতির পিতা বলে ঘোষণা করতেন।

১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে জোসেফ স্টালিনকে জাতির জনক বলে ঘোষণা করা হয়। বলা বাহুল্য, স্টালিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার জাতির পিতা উপাধিও কবরে ঢুকে যায়।

২০০৭ সালে স্লোভাকিয়ার সংসদ তুমুলভাবে বিতর্কিত নেতা লিঙ্কা-কে প্রায় জাতির পিতা ঘোষণা করেই ফেলেছিল। প্রবল গণপ্রতিরোধের মুখে লিঙ্কার আর জাতির পিতা হওয়া ভাগ্যে জোটেনি।

কিছু দেশ আছে যেখানে সামন্তবাদের সুবিধাভোগী ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ দলীয় স্বার্থে কিছু কিছু লোককে জাতির পিতা হিসেবে দেখাতে চায়। যেমন আফগানিস্তান একসময় আহমদ শাহ আবদালি দুররানিকে জাতির পিতা হিসেবে মানাতে সচেষ্ট হয়। পরে আরও কয়েকজন জাতির পিতার ডামাডোল বেজে ওঠে। ব্রাজিল কমপক্ষে দুবার তাদের জাতির পিতা বদলিয়েছে। প্রথমজন ডোম পেদ্রো, দ্বিতীয়জন আন্দ্রাদা-ই সিলভা। সেখানে এখন জাতির পিতা কে জানি না। চেক প্রজাতন্ত্র তিনবার তাদের জাতির পিতা বদলিয়েছে, পোলোৎস্কি, চতুর্থ চার্লস ও মাশা রেক। আর্জেন্টিনা ও পেরুতে কোনো জাতির পিতাই নেই, আছে একজন অভিভাবক। জার্মানিতে আগের সব ধারণা বাতিল করে হিটলার হয়ে ওঠেন জাতির পিতা। এমনকি জাতির পিতার চাইতেও বড় কিছু।

চার

বাংলাদেশের জন্মের আগে ১৯৫৭ সাল থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে জাতির পিতা হিসেবে সভা-সেমিনার ও মিছিলে উল্লেখ করা হতো। কারণ তিনিই কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘লাকুম দীনিকুম ওয়াল ইয়াদদীন’ জানিয়ে ঘোষণা করেছিলেন তার ঐতিহাসিক ‘আসসালামু আলাইকুম’ তত্ত্ব। তিনি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে গণদাবিতে পরিণত করেছিলেন। এরও বহু আগে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার ‘অপরাধে’ তিনি হারিয়েছিলেন প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির সদস্যপদ। আবার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতার বাইরে তিনি ছিলেন একমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি এই সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন।

সব হিসাব ওলটপালট করে দেয় ছাত্রলীগের এডলফ্ হিটলার মার্কা চাতুর্য ও কায়দা। তারা দুভাবে দুই পর্যায়ে এই জাতির পিতাগিরি ছিনতাই করে। যে মওলানা ভাসানী অবিস্মরণীয় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে রক্ষা করেন, তাকে জনপ্রিয় করে দেন—সেই ভাসানীকে পাশ কাটিয়ে ১৯৬৯ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারিতেই ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমদ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায়, কারও অনুমোদন না নিয়ে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বসেন। পরে তাকে আমরা দেখব মুজিবনগর সরকারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের গড়ে তোলা ‘মুজিব বাহিনী’র একজন সংগঠক হিসেবে। তখন জেনারেল উবান ছিলেন তার গুরু।

দ্বিতীয় ধাপের নেতৃত্বেও ছিলেন আরেকজন ছাত্রলীগ নেতা ডাকসুর তোফায়েল-পরবর্তী ভিপি আ স ম আবদুর রব। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আকস্মিকভাবে শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা দিয়ে সবাইকে হতভম্ব করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকেও আমরা জেনারেল উবানের পাশে দেখব।

যাহোক, যুদ্ধের পরে আমরা দেখি, শেখ মুজিব এসব ঘোষণাকে কাজে লাগিয়ে জাতির পিতার আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই অবস্থার অবসান ঘটে ২০০৪ সালে বিএনপির মাধ্যমে। কিন্তু ২০১১ সালে বিচারপতি খায়রুল হকের দেশ ধ্বংসকারী পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিব আবার জাতির পিতার গদিতে আসীন হন। শুধু তা-ই নয়, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কথা বলাকেও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিধান জারি করা হয়।

পাঁচ

যে শেখ মুজিব গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন, সেই নেতা বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা হাতে নিয়েই সংহারক মূর্তিতে দেখা দেন। ১৯৭২ সালেই যুবলীগের সভাপতি মুজিব-ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ঘোষণা করেন, কোনো আইনের শাসনটাসন বুঝি না, দেশ চলবে মুজিবি শাসনে। অচিরেই এ ঘোষণার কুফল ফলতে শুরু করল। ১৯৭২ সালে ৩০ জানুয়ারি গুম হয়ে গেলেন চলচ্চিত্রকার ঔপন্যাসিক জহির রায়হান। জহির রায়হানকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন সিআইডির ইন্সপেক্টর কাজী আবদুল আলীম। কোনো তদন্ত রিপোর্ট পেশ করার আগেই মুজিব ঘোষণা করলেন, জহির রায়হানকে কেউ গুম করেনি। তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। যেটুকু তদন্ত হয়েছিল সে ফাইলটাও ক্লোজ করে দেওয়া হলো।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাতে ধর্ষিত হন অসংখ্য নারী। চারদিকে ঘৃণা-ধিক্কারের তুফান উঠলেও এই নিয়ন্ত্রণহীন ধর্ষণকাণ্ডের কোনো তদন্ত করেননি শেখ মুজিব, বিচার তো নয়ই। ডাকসু নির্বাচনের ব্যালটবাক্স লুটের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র শেখ কামাল। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংঘটিত হয় ভয়াবহ কারচুপি। এরপর বিরোধী দল দমনে নেওয়া হয় নিষ্ঠুরতম সব পদ্ধতি। গুম, খুন, লুণ্ঠন, দখল, দুর্নীতি ও চোরাচালানের এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সর্বত্র। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের নাম দিলেন ‘নিখিল বাংলা লুটপাট সমিতি’। শেখ মুজিবের লাল বাহিনী, নীল বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, ছাত্র ও যুবলীগের সশস্ত্র গুণ্ডাদের হাতে নিহত হন ২৭ হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণ করা ছাড়া তাদের আর কোনো অপরাধ ছিল না। এসব নিহত মানুষের মধ্যে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের জন্য, দেশে প্রচুর খাদ্য থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অনাহারে মৃত্যুবরণ করে ১০ লাখ মানুষ। এইসব অপশাসন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও চোরাচালান প্রতিরোধের বদলে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদারকে হত্যা করে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দম্ভভরে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?’

‘রক্তকরবী’র আত্মবিমোহিত রাজার মতো, মধ্যযুগের রক্তপিপাসু রাজা-বাদশাহদের মতো ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করার জন্য ১৯৭৫ সালেই মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পার্লামেন্টে তিনি পাস করান চতুর্থ সংশোধনী। এই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অঙ্গীকারকে আজিমপুরে দাফন করে মুজিব হয়ে ওঠেন একমেবাদ্বিতীয়ম।

বন্ধ হয়ে যায় বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা। নিষিদ্ধ হয় সকল রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র। সর্বময়ক্ষমতার অধিকারী শেখ মুজিব একদিকে যেমন হয়ে ওঠেন চরম একনায়ক, অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম দেন ফ্যাসিবাদের। আর দেশ পরিণত হলো ‘এক নেতা, এক দেশ’-এ; চালু হলো কুখ্যাত বাকশালি শাসন। পরে শেখ হাসিনার হাতে এই ফ্যাসিবাদ দানবে পরিণত হয়। তিনি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেন গণহত্যা।

শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ বানানো ও মানার খেসারত জাতি জীবন দিয়ে পরিশোধ করেছে। আওয়ামী অভিলাষ চরিতার্থ হওয়ার পথে যাদেরই বাধা হিসেবে দেখা হয়েছে, তাদেরই হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড চলেছে নির্বিচারে। কোথাও কোনো জবাবদিহি ছিল না।

ছয়

আবার সেই নির্মম-নিষ্ঠুর দানব কি আমরা গড়তে চাই? আবার কি আমরা আরেকটা হিংস্র, স্বার্থপর, রাষ্ট্রঘাতী ও জাতিঘাতী ক্রূর একনায়ক, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদকে আমরা ডেকে আনতে চাই? কারণ জাতির পিতা ধারণার মধ্যেই রয়েছে বিষবৃক্ষের বীজ। এ পদ্ধতি থাকলে আবারও জন্ম নেবে দৈত্য, দানব ও রাক্ষস। যদি আমরা বাস্তবতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই, যদি আমরা সস্তা আবেগের স্রোতে ভেসে যাই, তাহলে তো আধিপত্যবাদের চক্রান্তের ফাঁদেই আবার পতিত হবো। তাদের নীলনকশারই বাস্তবায়িত হবে আমাদের আহাম্মকির মাধ্যমে। যদি আমরা তা করি তাহলে কি আমাদের হাজার হাজার শহীদ সন্তানদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে না? জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে যারা নতুন এক বাংলাদেশকে সামনে নিয়ে এলো, তাদের সঙ্গে কি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না?

যদি আমরা অমঙ্গল কল্যাণ থেকে বাঁচতে চাই, যদি আমরা বিভেদ ও হানাহানিমুক্ত একটা সুখী-সমৃদ্ধ দেশ চাই, তাহলে তো এই মধ্যযুগীয় বস্তাপচা ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশ এই উটকো যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য জাতির পিতার সিস্টেমটাই তুলে দিয়েছে।

সাত

তারপরও যদি কারও খায়েশ থাকে তাহলে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহকে জাতির পিতা ঘোষণা করুন। কারণ এই মানুষটিই তো বিশ্ব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, সেই ১৩৪২ সালে ‘বাংলা’ নামে দেশের পত্তন করেছিলেন। শশাঙ্ক বলুন, গোপাল কিংবা সেন রাজাদের কথা ধরুন, তারা কেউই ‘বাংলা’ নামে কোনো দেশ প্রতিষ্ঠা করেননি।

আমার মনে হয়, আমাদের বিবেক ও বিবেচনাবোধকে জাগ্রত করার সময় এটা। স্লোগান তো এখন একটাই—তোমার আগে, আমার আগে, সবার আগে দেশ, বাংলাদেশ। তাই যদি হয় তাহলে এগুতে হবে ভিন্ন পথে। সেই পথের কিছুটা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে এগিয়ে দিয়েছে। সেই ধারণা থেকে নিজের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভূগোল ও আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে, জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে, আমরাও তো জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে যারা নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, প্রাণ দিয়ে গেছেন, আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন আজাদির মঞ্জিলে, সম্মান, মর্যাদা ও স্বনির্ভরতার দিকে, এখন তো তাদের দিকে চোখ ফেরাতে পারি।

কোনো একক ব্যক্তিকে ‘আইকন’ বানিয়ে সবার অবদান ও ভূমিকাকে অস্বীকার করা কি কোনো কাণ্ডজ্ঞানের লক্ষণ? একজন ব্যক্তিকে চাম্পিয়নশিপ দিলে কী পরিণতি হতে পারে তা কি এখন আমরা অনুধাবন করছি না?

এজন্য আমার বিনীত প্রস্তাব, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা’ বা ‘ফাউন্ডারস অব দ্য নেশন’—জাতীয় ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে চিরকালের জন্য আমরা রাক্ষস জন্মাবার দরজা রুদ্ধ করতে পারি। চিরকালের জন্য উপড়ে ফেলতে পারি দানবের লালসাকাতর দাঁত।

এখানে এই ফাউন্ডারস অব দ্য নেশনের একটা তালিকা পেশ করতে পারি। এটা একটা প্রস্তাব মাত্র। পথ অতিক্রমের একটা উপকরণ মাত্র। এখানে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ তো আছেই।

‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে যাদের নাম বিবেচনা করা যেতে পারে, তারা হলেন:

১. শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (‘বাংলা’ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক)

২. ঈশা খাঁ (দিল্লির আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক)

৩. সিরাজদৌলা (স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের প্রথম শহীদ)

৪. ফকির মজনু শাহ (ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক)

৫. মীর নিসার আলী তিতুমীর (ব্রিটিশবিরোধী ওহাবী আন্দোলনের প্রাণ)

৬. হাজী শরীয়তুল্লাহ (ফারায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা)

৭. খাজা সলিমুল্লাহ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, আধুনিক ঢাকার রূপকার, প্রথম আধুনিক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা)

৮. শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক (শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্মদাতা)

৯. কাজী নজরুল ইসলাম (জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির স্রষ্টা ও রেনেসাঁর স্থপতি)

১০. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (গণতন্ত্রের মানসপুত্র)

১১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (স্বাধীনতার প্রথম স্বাপ্নিক গণমুখী রাজনীতির প্রধান পুরুষ)

১২. শেখ মুজিবুর রহমান (স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ)

১৩. জিয়াউর রহমান (স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মধ্যমণি ও আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা)

১৪. জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী (মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক)

আট

নিজেকে একজন সৌভাগ্যবান মানুষই মনে করি। কারণ আমি ’৬৯-এর গণঅভুত্থানে রাজপথে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। ৭ নভেম্বর বিপ্লবে সিপাহি জনতার ট্যাংকে উঠেছি। ’৯০-এর গণজাগরণে মাঠে ছিলাম। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ছুকিকাঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলাম। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও প্রধানমন্ত্রী হত্যাপ্রচেষ্টার বানোয়াট মামলার আসামি ছিলাম। বিগত ১৫ বছরে আমি ও আমার পরিবার সহ্য করেছি নানামাত্রিক নির্যাতন। শুধু আমার সন্তান বলে নিরপরাধ পুত্রকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল জেলে। মেয়ে বঞ্চিত হয়েছে নৌবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্তি থেকে। আমাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অসহনীয় বেকারত্বে। একটা চাকরির জন্য পথে পথে ঘুরে মরেছি। গণমাধ্যমগুলো রেডলিস্টভুক্ত করেছিল। তবুও হামলা, হুমকি-ধমকি ও নির্যাতনের মুখেও অবিচল ছিলাম দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। চালিয়ে গিয়েছি কলম ও কণ্ঠের যুদ্ধ। আমার উচ্চতার চেয়ে উচ্চকিত হয়ে নির্বিরাম ছিলাম মিটিং, মিছিল, সেমিনার, মানববন্ধন ও গণসমাবেশে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলাম সাথিদের নিয়ে। গত ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জের তাণ্ডবের মধ্যেও এক মুহূর্তের জন্য ছাত্রজনতার পাশ থেকে সরে যাইনি।

জুলাই বিপ্লবের আগুনে দগ্ধীভূত ও উজ্জীবিত একজন সামান্য কবি হিসেবে আমার এই ভূমিকা হয়তো আজকের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মূল্যহীন। কিন্তু দেশের মানুষ জানে, ছাত্রজনতা জানে, সাক্ষী দেশের অলিগলি-রাজপথ, সাক্ষী ঢাকার ধুলাবালু—আমি কে ছিলাম, কেমন ছিলাম। সেই অধিকার থেকেই আজকের এই প্রস্তাবনা পেশ।

সকলকে অনুরোধ করি, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানকে যাচাই-বাছাই করে, বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সাহায্যে কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো আধুনিকতা। এটাই তো জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা। তাই নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করি:

আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,

গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।

সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,

তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রমমহান,

চলমান বেগে প্রাণ উছল।

রে নবযুগের স্রষ্টাদল,

জোর কদম চল্‌ রে চল্‌ ।।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত