মৎস্য সপ্তাহ পালনের একাল-সেকাল

দেশি মাছ সংরক্ষণ ও মৎস্য চাষই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

ড. মো. মিজানুর রহমান
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৫২
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ০৩

গত ১৮ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে এ বছরের মৎস্য সপ্তাহ। চলবে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত। এবারের মৎস্য সপ্তাহের প্রতিপাদ্য হলো—‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি।’ দেশি মাছে দেশ ভরার স্লোগানটি বেশ শ্রুতিকটু লাগলেও সামগ্রিক বিবেচনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমানে দেশি মাছের ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটকে নির্দেশ করছে। তাই এবারের মৎস্য সপ্তাহ দেশি মাছ সংরক্ষণে ও দেশি মাছের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে মৎস্য সপ্তাহ পালনের সূচনা হয়েছিল দেশজ মাছ রক্ষা, মৎস্য চাষের উন্নয়ন ও জনগণকে মাছ খাওয়ার উপকারিতা বোঝানোর লক্ষ্যে। নব্বইয়ের দশকে মৎস্য সপ্তাহ ছিল মূলত প্রচারণামূলক কর্মসূচি—র‌্যালি, প্রচারপত্র বিতরণ, পোনা অবমুক্তকরণ ও স্লোগাননির্ভর। তখন মৎস্য সপ্তাহের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তারা মাছ চাষে আগ্রহী হয় এবং খাওয়ার অভ্যাসে মাছের স্থান আরো দৃঢ় হয়। সে সময়ের লক্ষ্য ছিল মানুষকে জানানো যে, মাছ বাংলাদেশের প্রধান প্রাণিজ আমিষের উৎস এবং এর উৎপাদন বাড়ানো খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। এর মাধ্যমে দেশের প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণ এবং কৃষির পাশাপাশি মাছ চাষকে অর্থনীতির একটি বড় খাত হিসেবে দাঁড় করানো শুরু হয়। মৎস্য সপ্তাহ প্রথম দিকে সচেতনতা বাড়ানোর প্রধান মাধ্যম হলেও গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তি তখনো ছিল সীমিত।

বর্তমান সময়ের মৎস্য সপ্তাহ অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত, গবেষণাভিত্তিক এবং তথ্যনির্ভর। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য—‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ স্লোগানটিই এই পরিবর্তনের প্রতিফলন। এখন শুধু র‌্যালি নয়, বরং সেমিনার, প্রযুক্তি প্রদর্শনী, গবেষণাভিত্তিক আলোচনা, কুইজ প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল প্রচারণা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

এছাড়া স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদকের মাধ্যমে চাষি ও উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, যা একটি প্রণোদনা হিসেবেও কাজ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। ফলে একালের মৎস্য সপ্তাহ এখন আর কেবল প্রচারণা নয়, বরং জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের জলাশয়ে একসময় ২৬০ প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, গত চার দশকে এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার) দেশি মাছের ৫৬ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে তালিকা প্রণয়ন করেছে। এর প্রধান কারণ হলো নদী-খালের ভরাট, দূষণ, পানিপ্রবাহের বাধা, অতিরিক্ত আহরণ ও অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহার। এ প্রেক্ষাপটে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ২০২৩ সালের মৎস্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুসারে দেশে বর্তমানে প্রায় ১ এক হাজার ২০০টিরও বেশি অভয়াশ্রম রয়েছে, যেখানে ডিম ছাড়ার মৌসুমে মাছ রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব অভয়াশ্রমে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয় এবং গবেষণায় দেখা গেছে, এসব উদ্যোগে দেশি মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এবারের মৎস্য সপ্তাহে এই অভয়াশ্রমগুলোকে কেন্দ্রীয় আলোচনায় আনা হচ্ছে, যা দেশি মাছ সংরক্ষণের জন্য নীতিনির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির মাছ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এফএও’র পরিসংখ্যানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সাতগুণ বৃদ্ধি। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ আসে চাষকৃত মাছ থেকে, বিশেষত কার্প, তেলাপিয়া, ক্যাটফিশ ও গলদা-চিংড়ি। ২০২৪ সালের বিবিএসের তথ্যানুসারে মৎস্য খাত জাতীয় জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ জোগান দিচ্ছে। তাছাড়া মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় দুই শতাংশ আসে মাছ ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে। ফলে মৎস্য চাষ এখন কেবল পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার অংশ নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও অন্যতম প্রধান খাত।

মাছ বাংলাদেশিদের খাদ্যাভ্যাসে একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে। ১৯৭১ সালে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র সাত-আট কেজি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কেজির বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ। এফএও প্রস্তাবিত মান অনুযায়ী, একজন মানুষের বছরে অন্তত ২০ কেজি মাছ খাওয়া উচিত। মাছ প্রোটিন, ভিটামিন ডি, আয়রন এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

বর্তমানে দেশের মোট প্রাণিজ প্রোটিনের ৬০ শতাংশই আসে মাছ থেকে (ডিওএফ, ২০২৪)। তবে সমস্যা হলো, দেশি মাছের প্রজাতির হার কমে যাচ্ছে; আর বিদেশি প্রজাতি, যেমন তেলাপিয়া ও পাঙাশের চাষ যেমন বাড়ছে, একইভাবে এগুলো খাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে পুষ্টিগুণে বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। তাই এবারের মৎস্য সপ্তাহে দেশি মাছ সংরক্ষণের বার্তাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও চ্যালেঞ্জও কম নয়। নদী-খাল ভরাট, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পানিদূষণ, পরিবেশ দূষণ, প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং অবৈধ জাল ব্যবহার এখনো বড় হুমকি। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিয়মিত বন্যা মাছের প্রজনন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার ও শিল্পবর্জ্য নদীতে পড়ায় মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি দেশি মাছের জেনেটিক বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যতে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চাষ যেমন রিসার্কুলেটরি অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম (আরএএস), বায়োফ্লক প্রযুক্তি এবং জেনেটিক উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করা জরুরি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ, দেশি মাছের প্রজনন ক্ষেত্র পুনর্গঠন এবং চাষিদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো অপরিহার্য। মৎস্য সপ্তাহকে তাই কেবল উৎসব নয়, বরং জাতীয় পরিকল্পনার একটি অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।

দেশি মাছের সংরক্ষণ এবং আধুনিক চাষাবাদের সমন্বয়ই আগামী দিনের বাংলাদেশের খাদ্য, পুষ্টি ও অর্থনীতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। অভয়াশ্রম, গবেষণা, প্রযুক্তি ও জনসচেতনতা একসঙ্গে এগোলে আমরা শুধু দেশি মাছ ফিরিয়ে আনতে পারব না, বরং মৎস্য খাতকে টেকসই উন্নয়নের এক প্রধান স্তম্ভে রূপান্তর করতে পারব এবং বৈদেশিক বাজারেও প্রতিযোগিতা বাড়াতে সক্ষম হব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্সেস টেকনোলজি বিভাগ, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত