শান্তির মুখোশে গাজায় টনি ব্লেয়ারের প্রত্যাবর্তন

তানভীর আহমেদ
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ১৬
ছবি: এএফপি

গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বোর্ড পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজার জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে কাজ করবে। এখানে এক ধরনের ভণ্ডামি রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়ই ইসরাইলে গাজায় গণহত্যা ও জাতিগত নিধন পরিচালনা করছে। এই বোর্ডের আরেক সদস্য হিসেবে যে নামটি সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তুলেছে, তিনি হলেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় গাজার ‘পুনর্গঠন’ বা ‘মেকওভার’-এর জন্য ব্লেয়ারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। বিষয়টি ফিলিস্তিনিদের কাছে নিছক রাজনৈতিক উপহাসের মতো। টনি ব্লেয়ারের নাম শুনলেই মনে পড়ে ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের সেই ভয়ংকর অধ্যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যকে টেনে নিয়েছিলেন এমন এক যুদ্ধে, যার ভিত্তি ছিল ভুয়া অভিযোগ—ইরাকের হাতে নাকি গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। সেই মিথ্যা অভিযোগের কারণে শুরু হয় আগ্রাসন, যাতে ধ্বংস হয়েছে ইরাক। ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা এক বাক্যে বলেন, ব্লেয়ার নিজেই যুদ্ধাপরাধী। তাহলে প্রশ্ন আসে, যুদ্ধের রক্তাক্ত দায় মাথায় নিয়ে কেউ কীভাবে ‘শান্তির দূত’ হতে পারে?

২০০৭ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ব্লেয়ার হারিয়ে যাননি। বরং খুব দ্রুতই তিনি আবির্ভূত হন মধ্যপ্রাচ্যের কোয়ার্টেটের দূত হিসেবে। এই কোয়ার্টেট গঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাতিসংঘের উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান। কিন্তু বাস্তবে এই পদে থেকে ব্লেয়ার কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি আনতে পারেননি। বরং বারবার ইসরাইলের প্রতি তার পক্ষপাতিত্বই প্রকাশ পেয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ব্লেয়ারের কূটনৈতিক ভূমিকা তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে যায়। তিনি একদিকে আরব সরকারগুলোকে লাখ লাখ ডলারের বিনিময়ে নানারকম পরামর্শ দিয়েছেন, অন্যদিকে ২০০৮ সালে মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানে সিনিয়র উপদেষ্টা হয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি প্রতি বছর এক মিলিয়নেরও বেশি ডলার আয় করতেন। অর্থাৎ, ব্লেয়ারের একেকটি বৈঠক বা সিদ্ধান্তের পেছনে লুকিয়ে থাকত ব্যক্তিগত লাভের হিসাব। লেখক ফ্রান্সিস বেকেট এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যখন ব্লেয়ার কোনো বৈঠকে যেতেন, তখনই প্রশ্ন উঠত—সামনে আসা মানুষটি কে? কোয়ার্টেটের দূত ব্লেয়ার নাকি তার ফাউন্ডেশনের প্রধান, নাকি তার কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের কর্তা?’ এই দ্বৈত ভূমিকাই তার কাজকে সন্দেহের চোখে দেখার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালে ইসরাইলের কাছ থেকে তিনি পশ্চিম তীরে একটি নতুন ফিলিস্তিনি মোবাইল অপারেটরের (ওয়াতানিয়া মোবাইল) জন্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আদায় করে দেন। উপরিভাগে এটি ছিল একটি উন্নয়নমূলক সাফল্য। কিন্তু এর অন্তরালে ছিল ভয়ংকর চুক্তি। ইসরাইল শর্ত দেয়, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব জাতিসংঘে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে অভিযোগ তুলবে না। সেই যুদ্ধাপরাধ ছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে গাজায় পরিচালিত ‘অপারেশন কাস্ট লিড’, যেখানে মাত্র ২২ দিনে নিহত হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি। এখানেই শেষ নয়। জনাথন কুক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ব্লেয়ারের ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থও এই চুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল। শুধু ওয়াতানিয়া নয়, জেপি মরগ্যানও এই ব্যবসা থেকে বিরাট লাভবান হওয়ার সুযোগ পায়।

বিজ্ঞাপন

ট্রাম্পের ঘোষিত নতুন পরিকল্পনা স্পষ্টতই ব্লেয়ারের মতো ব্যক্তিদের আরো একবার গাজার নিয়ন্ত্রণে বসানোর চেষ্টা। ‘বোর্ড অব পিস’-এর মাধ্যমে গাজার মানুষের রাষ্ট্রের দাবি, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও হত্যাযজ্ঞ থেকে মুক্তির সংগ্রামকে গোপনে সরিয়ে দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও বহুজাতিক মূলধনের লোভ। ট্রাম্পের ভাষায়—‘সদিচ্ছাপূর্ণ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর নানা বিনিয়োগ প্রস্তাব ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গাজায় নতুন আশার সঞ্চার করবে।’ কিন্তু ফিলিস্তিনিরা যখন বারবার রক্ত ঝরাচ্ছে, তখন তাদের জন্য ‘আশা’ বলতে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। পুঁজিবাদ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রাসন সেই ক্ষত আরো গভীর করবে। আর সেই আগ্রাসনের প্রতীক হয়ে উঠতে পারেন টনি ব্লেয়ার, যিনি বারবার যুদ্ধাপরাধের ছায়া নিয়েও শান্তির মুখোশ পরে মঞ্চে হাজির হয়েছেন। আজ যখন গাজার ভাগ্য আবারও ট্রাম্প, ব্লেয়ার এবং আরো অনেক আন্তর্জাতিক শক্তির হাতে বন্দি, তখন ফিলিস্তিনিদের কাছে এই পরিকল্পনা নিছক এক নতুন শেকল ছাড়া আর কিছু নয়। শান্তির নামে যুদ্ধাপরাধীদের হাতে তাদের ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়া মানে হচ্ছে—আরো রক্ত, আরো বঞ্চনা, আরো দমননীতি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

বিষয়:

আমার দেশ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত