লিটন সরকার
যখন অনুন্নত দেশের যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিরা উন্নত দেশে স্থানান্তরিত হন, তখন এ ঘটনাকে ‘মেধা পাচার’ বা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বলা হয়। নানা কারণে দেশ ত্যাগ করার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ক্ষেত্রে। অথচ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ‘বিশ্ব জনসংখ্যার অবস্থা প্রতিবেদন-২০২৫’-এ বাংলাদেশকে বর্তমানে একটি জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (Demographic Dividend) উপভোগকারী দেশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের কাছে সুযোগের এমনই একটি দরজা, যেখানে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষম জনসংখ্যা রয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে ১১ কোটি মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে এবং তাদের কর্মক্ষম হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ বা এক-চতুর্থাংশ ১৫-২৯ বছর বয়সি। সংখ্যার দিক থেকে দেশের বর্তমান যুব জনসংখ্যা ৪ কোটি ৫৯ লাখ। এই তরুণরা দ্রুত নতুন কিছু শিখতে পারে। সুতরাং তরুণদের কার্যকর ও সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে হবে।
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য ৫৫টি দেশে গেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ এবং ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮। আর ২০০৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এর ২ শতাংশও দেশে ফেরত আসছেন না। উচ্চশিক্ষায় বিদেশগামীদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের পছন্দের দেশের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, মালয়েশিয়া ও জার্মানি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালনায় ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ৫৫ শতাংশ মানুষ এর লক্ষ্য বিদেশে পাড়ি জমানো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশিদের বিদেশে শিক্ষার ব্যয় ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের ব্যয় ৫ লাখ টাকার বেশি। অন্যদিকে বুয়েটের মতো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যয় কমপক্ষে ১০ লাখ এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে ১৫ লাখ টাকার ওপর। দেশের জনগণের দেওয়া করের টাকায় সরকার এই অর্থের জোগান দিয়ে থাকে। বিষয়টি এ রকম, দেশের জনগণের করের টাকায় তৈরি করা মেধাবীদের সেবায় উন্নত হচ্ছে অন্য দেশ। দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে ভাবার সময় কারোর নেই। এই প্রবণতা দেশের মানবসম্পদের বিকাশে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং জাতীয় উন্নয়নকে পিছিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম একটি রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণ প্রজন্মের যথাযথ লালনপালন, তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন এবং তারা যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই ‘মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন’ অন্যতম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা একটি দেশের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও এর সম্ভাব্যতাকে স্থবির করে দিতে পারে।
মানসম্মত উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতার মতো বিষয়গুলো তাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহিত করছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবাই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল এবং দেশে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিলেন। কিন্তু তেমনটা বাস্তবে দেখা যায়নি। অনেকে ভেবেছিলেন, দেশে হয়তবা ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেন’ শুরু হবে। কিন্তু বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বিষয়ে তেমন কিছু দেখা যায়নি। তাই উন্নত জীবনের নিশ্চয়তায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত আছে এবং বেশির ভাগই বিদেশে যাচ্ছেন স্থায়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে।
আমাদের দেশে একজন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষে বুঝে উঠতে পারছে না সে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে। সে অনিশ্চয়তায় ভুগছে ও হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের তরুণদের দেশে রাখতে চাইলে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত কর্মজীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, গত চার দশকে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তাদের শিল্পক্ষেত্রে। যেটা বাংলাদেশে ঘটেনি। তরুণদের উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত করতে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। দেশে ভালো চাকরির সুযোগ যেমন নেই, তেমনি জীবনের নিরাপত্তাও নেই। তাছাড়া আমাদের দেশে সম্মানজনক চাকরি বলতে সবাই সিভিল সার্ভিসকে বোঝে। অথচ একটা বিসিএস সম্পন্ন হতে প্রায় চার-পাঁচ বছর চলে যায়। অথচ এ সময় একজন মেধাবী বিদেশে ভালো একটা ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণায় রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন রঙ নেই। জাতি তৈরির মহান পেশা শিক্ষক হতে হলুদ-নীল, সাদা দল নয়, যোগ্যতা ও গবেষণার মানই মুখ্য। ওইখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষকরা দিনরাত কাজ করেন আবিষ্কারের নেশায়। শিক্ষা ও গবেষণায় অর্জিত সাফল্যের ফসল ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মধ্যে। নিজ নিজ জায়গায় রয়েছে স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের তাগিদ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এ জায়গাগুলোয় অনেকে পরিবর্তনের আশা করেছিলেন কিন্তু এখন আর তেমন কিছু হবে না বলে মনে হওয়ায় অনেকেই নিরাশ হচ্ছেন।
উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবেশে লেখাপড়া, গবেষণা এবং বৈশ্বিক জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে পরিচিত হতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়াটা অপরাধ নয়, বরং জরুরি। ফিরে এসে তারা দেশের জনশক্তিকে বৈশ্বিক মানে তৈরি করতে পারতেন। চীন ও ভারত প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েটকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলোয় পাঠাচ্ছে। এজন্য তাদের উচ্চশিক্ষা খাতে বিনিয়োগের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও সহজভাবে ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিসহ নানা সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যতিক্রম হচ্ছেÑযারা পড়তে যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ আবার ফিরে এসে নিজ দেশের সেবা করছেন, যা আমাদের মেধাবীরা করছেন না। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও বহু বছর ধরে মেধা পাচার দেখে আসছে। অনেক উচ্চ মেধাসম্পন্ন দক্ষ পেশাদাররা বিদেশে আরো ভালো সুযোগ-সুবিধার জন্য নিজ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এ সমস্যা সমাধানে মেধাবী ও দক্ষ পেশাজীবীদের দেশে ধরে রাখতে এবং তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। বাস্তবায়িত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ব্রেইন কোরিয়া-২১’ (ইক-২১) প্রকল্প, যেখানে উচ্চমানসম্পন্ন মানবসম্পদ বিকাশের লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা ও শিক্ষা প্রোগ্রামের জন্য বিশেষ তহবিল সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পটিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের তাদের উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে বড় আকারের বৃত্তি দেওয়া হয়। উপরন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার স্টার্টআপ এবং উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বিভিন্ন নীতি প্রবর্তন করেছে। এই নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে কর প্রণোদনা, তহবিল সহায়তা এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ নমনীয় ভিসা পদ্ধতি। এতে করে তাদের বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও জনশক্তি দেশের ভেতর থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হয়। এছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সেক্টর তৈরি করা ও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে দক্ষিণ কোরিয়া গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারও প্রতিষ্ঠা করেছে, যার অন্যতম কাজ হচ্ছে তরুণদের দক্ষ করে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসনসহ তার নাগরিকদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ও ক্রমাগত আরো উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা মেধাবী ও দক্ষ পেশাদারদের জন্য দেশকে আরো আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করেছে। এসব উদ্যোগের কারণেই মেধাবী ও দক্ষ পেশাদারদের দেশে থাকতে বা ফিরে আসতে উৎসাহিত করেছে। কার্যকর নীতিমালার প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া মেধা পাচার মোকাবিলা করে আসছে।
মেধাবীরা দেশ থেকে চলে যাওয়ায় অযোগ্যদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে দেশ। একদিকে যেমন তারা অযোগ্য, তার ওপর দুর্নীতিবাজ। এর বিষয়ময় শিকার আজ বাংলাদেশ। দেশের সর্বত্র অগ্রগতির পরিবর্তে নেমে এসেছে স্থবিরতা আর নৈরাজ্য। এই দুর্নীতিবাজরা দেশ থেকে পাচার করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
একজন মেধাবী ব্যক্তি যখন দেশে তার যোগ্যতা অনুসারে চাকরি না পান, তখন তিনি হতাশ হবেনÑএটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এমন উদাহরণও আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার মতো মহান, সম্মানজনক ভালো চাকরি পাওয়া সত্ত্বেও বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেকে আর দেশে ফেরেননি। দেশের উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে ছুটি শেষে আর দেশে ফেরেননি দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭১ জন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একের পর এক চিঠি দিয়েও সাড়া না মেলায় তাদের মধ্যে ১২০ জনকে ইতোমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকি শিক্ষকদের চাকরি থাকলেও তারা এখনো লাপাত্তা। কিন্তু না-ফেরা শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন।
‘মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন’ রোধে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রেমিট্যান্সের স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা কখনোই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ‘মানব পুঁজির’ মতো দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা হারানোর বিশাল ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে পারবে না।
লেখক : উপপরিচালক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
যখন অনুন্নত দেশের যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী ব্যক্তিরা উন্নত দেশে স্থানান্তরিত হন, তখন এ ঘটনাকে ‘মেধা পাচার’ বা ‘ব্রেইন ড্রেন’ বলা হয়। নানা কারণে দেশ ত্যাগ করার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ক্ষেত্রে। অথচ জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ‘বিশ্ব জনসংখ্যার অবস্থা প্রতিবেদন-২০২৫’-এ বাংলাদেশকে বর্তমানে একটি জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (Demographic Dividend) উপভোগকারী দেশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের কাছে সুযোগের এমনই একটি দরজা, যেখানে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষম জনসংখ্যা রয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে ১১ কোটি মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে এবং তাদের কর্মক্ষম হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ বা এক-চতুর্থাংশ ১৫-২৯ বছর বয়সি। সংখ্যার দিক থেকে দেশের বর্তমান যুব জনসংখ্যা ৪ কোটি ৫৯ লাখ। এই তরুণরা দ্রুত নতুন কিছু শিখতে পারে। সুতরাং তরুণদের কার্যকর ও সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অফুরন্ত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে হবে।
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য ৫৫টি দেশে গেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ এবং ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮। আর ২০০৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এর ২ শতাংশও দেশে ফেরত আসছেন না। উচ্চশিক্ষায় বিদেশগামীদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের পছন্দের দেশের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, মালয়েশিয়া ও জার্মানি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালনায় ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ৫৫ শতাংশ মানুষ এর লক্ষ্য বিদেশে পাড়ি জমানো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশিদের বিদেশে শিক্ষার ব্যয় ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের ব্যয় ৫ লাখ টাকার বেশি। অন্যদিকে বুয়েটের মতো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যয় কমপক্ষে ১০ লাখ এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে ১৫ লাখ টাকার ওপর। দেশের জনগণের দেওয়া করের টাকায় সরকার এই অর্থের জোগান দিয়ে থাকে। বিষয়টি এ রকম, দেশের জনগণের করের টাকায় তৈরি করা মেধাবীদের সেবায় উন্নত হচ্ছে অন্য দেশ। দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে ভাবার সময় কারোর নেই। এই প্রবণতা দেশের মানবসম্পদের বিকাশে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং জাতীয় উন্নয়নকে পিছিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম একটি রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণ প্রজন্মের যথাযথ লালনপালন, তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন এবং তারা যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই ‘মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন’ অন্যতম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা একটি দেশের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও এর সম্ভাব্যতাকে স্থবির করে দিতে পারে।
মানসম্মত উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতার মতো বিষয়গুলো তাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহিত করছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবাই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল এবং দেশে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিলেন। কিন্তু তেমনটা বাস্তবে দেখা যায়নি। অনেকে ভেবেছিলেন, দেশে হয়তবা ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেন’ শুরু হবে। কিন্তু বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বিষয়ে তেমন কিছু দেখা যায়নি। তাই উন্নত জীবনের নিশ্চয়তায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত আছে এবং বেশির ভাগই বিদেশে যাচ্ছেন স্থায়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে।
আমাদের দেশে একজন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষে বুঝে উঠতে পারছে না সে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে। সে অনিশ্চয়তায় ভুগছে ও হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের তরুণদের দেশে রাখতে চাইলে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত কর্মজীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, গত চার দশকে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তাদের শিল্পক্ষেত্রে। যেটা বাংলাদেশে ঘটেনি। তরুণদের উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত করতে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। দেশে ভালো চাকরির সুযোগ যেমন নেই, তেমনি জীবনের নিরাপত্তাও নেই। তাছাড়া আমাদের দেশে সম্মানজনক চাকরি বলতে সবাই সিভিল সার্ভিসকে বোঝে। অথচ একটা বিসিএস সম্পন্ন হতে প্রায় চার-পাঁচ বছর চলে যায়। অথচ এ সময় একজন মেধাবী বিদেশে ভালো একটা ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণায় রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন রঙ নেই। জাতি তৈরির মহান পেশা শিক্ষক হতে হলুদ-নীল, সাদা দল নয়, যোগ্যতা ও গবেষণার মানই মুখ্য। ওইখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষকরা দিনরাত কাজ করেন আবিষ্কারের নেশায়। শিক্ষা ও গবেষণায় অর্জিত সাফল্যের ফসল ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মধ্যে। নিজ নিজ জায়গায় রয়েছে স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের তাগিদ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এ জায়গাগুলোয় অনেকে পরিবর্তনের আশা করেছিলেন কিন্তু এখন আর তেমন কিছু হবে না বলে মনে হওয়ায় অনেকেই নিরাশ হচ্ছেন।
উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবেশে লেখাপড়া, গবেষণা এবং বৈশ্বিক জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে পরিচিত হতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়াটা অপরাধ নয়, বরং জরুরি। ফিরে এসে তারা দেশের জনশক্তিকে বৈশ্বিক মানে তৈরি করতে পারতেন। চীন ও ভারত প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েটকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলোয় পাঠাচ্ছে। এজন্য তাদের উচ্চশিক্ষা খাতে বিনিয়োগের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও সহজভাবে ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিসহ নানা সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যতিক্রম হচ্ছেÑযারা পড়তে যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ আবার ফিরে এসে নিজ দেশের সেবা করছেন, যা আমাদের মেধাবীরা করছেন না। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও বহু বছর ধরে মেধা পাচার দেখে আসছে। অনেক উচ্চ মেধাসম্পন্ন দক্ষ পেশাদাররা বিদেশে আরো ভালো সুযোগ-সুবিধার জন্য নিজ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এ সমস্যা সমাধানে মেধাবী ও দক্ষ পেশাজীবীদের দেশে ধরে রাখতে এবং তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। বাস্তবায়িত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ব্রেইন কোরিয়া-২১’ (ইক-২১) প্রকল্প, যেখানে উচ্চমানসম্পন্ন মানবসম্পদ বিকাশের লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা ও শিক্ষা প্রোগ্রামের জন্য বিশেষ তহবিল সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পটিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের তাদের উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে বড় আকারের বৃত্তি দেওয়া হয়। উপরন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার স্টার্টআপ এবং উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বিভিন্ন নীতি প্রবর্তন করেছে। এই নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে কর প্রণোদনা, তহবিল সহায়তা এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ নমনীয় ভিসা পদ্ধতি। এতে করে তাদের বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও জনশক্তি দেশের ভেতর থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হয়। এছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সেক্টর তৈরি করা ও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে দক্ষিণ কোরিয়া গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারও প্রতিষ্ঠা করেছে, যার অন্যতম কাজ হচ্ছে তরুণদের দক্ষ করে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসনসহ তার নাগরিকদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ও ক্রমাগত আরো উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা মেধাবী ও দক্ষ পেশাদারদের জন্য দেশকে আরো আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করেছে। এসব উদ্যোগের কারণেই মেধাবী ও দক্ষ পেশাদারদের দেশে থাকতে বা ফিরে আসতে উৎসাহিত করেছে। কার্যকর নীতিমালার প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া মেধা পাচার মোকাবিলা করে আসছে।
মেধাবীরা দেশ থেকে চলে যাওয়ায় অযোগ্যদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে দেশ। একদিকে যেমন তারা অযোগ্য, তার ওপর দুর্নীতিবাজ। এর বিষয়ময় শিকার আজ বাংলাদেশ। দেশের সর্বত্র অগ্রগতির পরিবর্তে নেমে এসেছে স্থবিরতা আর নৈরাজ্য। এই দুর্নীতিবাজরা দেশ থেকে পাচার করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
একজন মেধাবী ব্যক্তি যখন দেশে তার যোগ্যতা অনুসারে চাকরি না পান, তখন তিনি হতাশ হবেনÑএটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এমন উদাহরণও আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার মতো মহান, সম্মানজনক ভালো চাকরি পাওয়া সত্ত্বেও বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেকে আর দেশে ফেরেননি। দেশের উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে ছুটি শেষে আর দেশে ফেরেননি দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭১ জন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একের পর এক চিঠি দিয়েও সাড়া না মেলায় তাদের মধ্যে ১২০ জনকে ইতোমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকি শিক্ষকদের চাকরি থাকলেও তারা এখনো লাপাত্তা। কিন্তু না-ফেরা শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন।
‘মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন’ রোধে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রেমিট্যান্সের স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা কখনোই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ‘মানব পুঁজির’ মতো দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা হারানোর বিশাল ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে পারবে না।
লেখক : উপপরিচালক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের অনেক গুণ থাকলেও, যে গুণটির বড্ড অভাব, তা হলো আত্মপর্যালোচনার অভ্যাস। কিন্তু এর জন্য পুরোপুরি তাদের দায়ী করা চলে না। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের যারা দর্শক-শ্রোতা তথা (সু)ফলভোগী, অর্থাৎ আমাদের মতো আমজনতা, আমরা তাদের কাজকে সেটা ভুল হোক, ভালো হোক হাততালি দিয়ে আর প্রশংসায় ভ
১৫ ঘণ্টা আগেভারতও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই আমি আবার সেই প্রশ্নে ফিরে যাই : আমরা কি মুসলিম, নাকি মুজরিম (অপরাধী)? কেন আমাদের প্রতিদিন আসামির মতো বাঁচতে হবে, যখন খুনিরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়? কেন আমাদের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়া থেকে গায়েব করে ফেলা হয়, অথচ রাষ্ট্র স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদযাপন করে?
১৬ ঘণ্টা আগেগত সপ্তাহটি অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও ঘটনা-দুর্ঘটনায় ভরপুর। অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছিল জুলাই সনদের স্বাক্ষরতার মধ্য দিয়ে। অবশেষে বিমানবন্দরে ভয়াবহ দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে গোটা সপ্তাহটি নানা ধরনের আলামতে অতিবাহিত হলো।
১৬ ঘণ্টা আগে