প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ়তা

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ২৮

একটি আমূল পরিবর্তনের পর ছয় মাস ধরে মানুষের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা মানুষ বুঝতে উঠতে পারছিল না। ঠিক এ রকম একটি পরিস্থিতিতে জুলাই গণহত্যার ওপর গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্কর মন্তব্য, অতঃপর কমিশনগুলোর সব পরামর্শ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ইঙ্গিত বহন করছে।

আর এটাও সত্য, আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। মহান আল্লাহ তায়ালাও মানুষের এ ধরনের প্রচেষ্টাকে ভালোবাসেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘জেনে রেখো আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্তু পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।’ (সুরা আর রদ, আয়াত: ১১)।

বিজ্ঞাপন

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, আমরা যদি ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা না করি, তা হলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন না। তাই নিষ্ঠুরতম শাসনের অবসানের পর জাতি গঠনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। অর্থাৎ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে অগ্রসরের পথ ঠিক করা।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই ইঙ্গিতই আমাদের দিয়েছেন। কমিশনের এই প্রথম বৈঠকে ২৬টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় ২০৫ জন অংশগ্রহণ করে গোটা দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফ্যাসিবাদের নিগড় থেকে বের হয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা যে, একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতারা ঐকমত্য পোষণ করলেন।

ওই দিন ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস উদ্বোধনী ও সমাপনী ভাষণে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা সাধারণ মানুষকে প্রচণ্ডভাবে উজ্জীবিত করেছে। তিনি তার ভাষণে বিগত ছয় মাসকে প্রথম পর্ব এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে সংস্কারের পরামর্শগুলো বাস্তবায়নের ধাপকে দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে অভিহিত করে তার দৃঢ় অবস্থানকে আরো জোরালোভাবে জানান দিয়েছেন। অন্যদিকে বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সহায়তাসহ সব ধরনের সাহায্য করার কথা বলায় জনমনে আস্থা আরো বেড়ে গেছে।

বিশেষ করে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টে জুলাই গণহত্যার ভয়বহ চিত্র ফুটে ওঠা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্তদের দায়মুক্তি না পাওয়ার বিষয়টিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তর্কের মন্তব্যই মূলত অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কঠিন দায়বদ্ধতায় আটকে দিয়েছে। কারণ জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টকে অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা আগামী দিনে নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের কারো পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমরা আমেরিকা কিংবা মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইসরাইল নই যে, জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারব। বরং মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের হত্যাকারীদের দায়মুক্তি না দেওয়ার নির্দেশনা রাষ্ট্রের সব অঙ্গ ও রাজনীতিবিদরা মেনে নিতে বাধ্য।

এসব ছাড়াও জাতিসংঘের সঙ্গে আমাদের অনেক বিষয়ে দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম আরেকটি খাত হচ্ছে জাতিসংঘ। আমাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা মিশনে গিয়ে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। সে বিবেচনায় সেনা ও পুলিশবাহিনীর কর্মকর্তারাও জাতিসংঘ তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী জুলাই গণহত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

এদিকে জাতিসংঘের রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল বসনিয়া ও রুয়ান্ডার সেসব নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যার কথা, যেসব গণহত্যার বিচার করেছিল জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সুতরাং বাংলাদেশে জুলাই গণহত্যার বিচার শুধু বাংলাদেশে নয়, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালেও হতে পারে।

তাই বিচারে জাতিসংঘকে যুক্ত করতে পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য অন্য মাত্রায় পৌঁছাবে। যেমন বসনিয়া গণহত্যার বিচারের জন্য জাতিসংঘ নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচার হয়েছিল তানজানিয়ার আরুশা শহরে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালে (আইসিটিআর)। সেখানে অনুষ্ঠিত সেই বিচারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল—১. গণহত্যা; ২. মানবতাবিরোধী অপরাধ; ৩. যুদ্ধের নিয়মনীতি লঙ্ঘন; এবং ৪. জেনেভা কনভেনশনের ভয়াবহ লঙ্ঘন।

ওই অভিযোগগুলোর প্রায় সবই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়ার ব্যাপারে বাধা থাকার কথা নয়। বসনিয়া গণহত্যার বিচারে অন্যতম অভিযুক্ত কুখ্যাত সার্ব নেতা রদোভান কারাদজিচের ৪০ বছরের কারাদণ্ড হয়। প্রধান আসামি হিসেবে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোশেভিচের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার আগেই কারাগারে তার মৃত্যু ঘটে। মিলোশেভিচ নিজের সম্পর্কে এত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন যে, তার বিরুদ্ধে আনা গণহত্যাকে তিনি অবলীলাক্রমে অস্বীকার করে যাচ্ছিলেন।

ভাবখানা এমন ছিল যেন বলাকান অঞ্চলে কিছুই ঘটেনি। অথচ সেখানে হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। একমাত্র স্রেব্রেনিৎসারে মুসলিম নারী ও শিশুদের আলাদা করে সক্ষম সব পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নিহতদের সংখ্যা ছিল আট হাজার। তারা সার্ব নয়, শুধু এই অপরাধে এই গণহত্যা চালানো হয়েছিল। যেমন করে বাংলাদেশে শুধু আওয়ামী লীগ করে না, এই অপরাধে জুলাই গণহত্যাসহ ১৫ বছর ধরে শত শত মানুষ গুম-খুন ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। আর ঠিক মিলোশেভিচের মতোই বাংলাদেশের গণহত্যাকারীরাও এমনভাব দেখাচ্ছেন যে, কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ঘটেনি। যা কিছু ঘটেছে তার সবকিছুই ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

অপরদিকে রুয়ান্ডা গণহত্যার হোতাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল ফ্রান্সে। কারণ গণহত্যা চালানো সত্ত্বেও ফরাসি সরকার তৎকালীন হুতু-নিয়ন্ত্রিত রুয়ান্ডা সরকারকে সহায়তা করে যাচ্ছিল। ফরাসিদের সহায়তা ও সমর্থন গণহত্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছিল।

তবে সে ঘটনার ২৬ বছর পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাকরোন রুয়ান্ডা গণহত্যার দায় স্বীকার করেছিলেন। অন্যদিকে একইভাবে বাংলাদেশের গণহত্যাকারীরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আর গণহত্যাকারীরা আগাগোড়া ভারতের সমর্থন পেয়ে আসছে। কিন্তু আমরা জানি না শেষ পর্যন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশটি কী ভূমিকা পালন করবে!

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত