গত চৌদ্দ মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে দুটি যুগান্তকারী বিপ্লবÑচব্বিশের জুলাই বিপ্লব এবং পঁচিশের ডাকসু ও জাগসু বিপ্লব। এই দুটি আন্দোলন শুধু স্বৈরশাসনের পতন বা ছাত্র-জনতার বিজয়ের গল্প নয়; বরং এগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এ নিয়ে নানা রকম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যান ও মতামত ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে, এই বিপ্লবগুলো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তনের পথ খুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব, বিভাজন, ট্যাগিং এবং ইতিহাসের একমাত্রিক বয়ানকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তবে জুলাই এবং ডাকসু-জাগসু বিপ্লবের পর নতুন প্রজন্মের উত্থান এবং জনসাধারণের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, পুরোনো কৌশল আর কার্যকর নয়; রাজনীতির ধরন, ভাষা এবং উদ্দেশ্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। নিচে দুই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতির কয়েকটি নতুন ধারা তুলে ধরা হলো-
১.
রাজনৈতিক ন্যারেটিভ পরিবর্তনশীল এবং সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ। ভারত এবং দেশীয় বামপন্থিদের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ একাত্তর নিয়ে যেসব ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল, তা দিয়ে তারা গত ৫৩ বছর রাজনীতি করেছে, ক্ষমতায় এসেছে এবং ক্ষমতা থেকে বিতাড়িতও হয়েছে। যে ন্যারেটিভ একসময় এই দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল এক শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে, সেই একই ন্যারেটিভ শেষে পরিণত হলো ‘শোষণের হাতিয়ার’ হিসেবে : চুরিতন্ত্র, মাফিয়াতন্ত্র, ভোটচুরি, গণহত্যা আর দেশের স্বাধীনতাকে উল্টো ভারতীয় আধিপত্যে বিলীন করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। একাত্তর এখন শোষণের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আর নেই, বরং নতুন প্রজন্ম এটাকে শোষণ এবং ফ্যাসিজমের পক্ষে এক বিশাল সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখা শুরু করেছে।
ফলে একাত্তর নিয়ে রাজনীতির দিন শেষ। এটাকে যতই নতুন করে সামনে আনা হবে, ততই হিতে বিপরীত ঘটবে। কারণ একাত্তর নিয়ে অতীতমুখী রাজনীতির (retrogressive politics) কোনো মার্কেট কারেন্সি এখন আর আগের মতো নেই; বরং এর মধ্যে নতুন প্রজন্ম শুধু ফ্যাসিবাদের গন্ধই আবিষ্কার করবে।
এ থেকে বলা যায়, এই রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থিদের রাজনীতি অনেকটা নাই হয়ে গেছে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে এদের নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে ময়দানে নামতে হবে।
২.
সময়ের বিবর্তনে যেটাকে একসময় শোষণের হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হতো, সেটা আবার মুক্তির হাতিয়ার হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে। যে ‘রাজাকার’ শব্দটি দিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী বীভৎস মানবচরিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরা হতো, সেই একই শব্দকে সময়ের বিবর্তনে মুক্তির হাতিয়ার বানিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা : ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলে।
এর অর্থ এই নয় যে রাজাকারের প্রায়োগিক অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এই শব্দের তীরে ক্ষতবিক্ষত করার সময় এখন শেষ হয়ে গেছে। বরং এর মানে হলো, রাজাকার, গুপ্ত, টেম্পো স্ট্যান্ড, আলবটরÑএসব ট্যাগিং রাজনীতির দিন শেষ। এবারের ডাকসু নির্বাচন এটা ভালোভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে। যিনি ট্যাগিং রাজনীতি করবেন, তার জনসমর্থনে ধস নামবে, অন্যদিকে যাকে ট্যাগিং করা হচ্ছে, তার জনসমর্থন আরো বেড়ে যেতে পারে।
৩.
এখন এক পজিটিভ রাজনীতির উত্থান তীব্রভাবে লক্ষণীয়। আগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছোট করা, দোষারোপ করা, অপবাদ দেওয়া এবং অপমান করা ছিল মুখ্য কৌশল। কিন্তু নতুন প্রজন্ম নেতিবাচক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করছে। এখন যে দল বা সংগঠন নিজের ইতিবাচক আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচি বেশি শক্তভাবে তুলে ধরতে পারছে, সেই-ই জনসমর্থন পাচ্ছে। যেমন : ডাকসু বিপ্লবে দেখা গেছে, বিজয়ী ছাত্রনেতারা একে অন্যকে আক্রমণ করার বদলে নিজেদের ইতিবাচক ভিশনÑগণতন্ত্র, শিক্ষা সংস্কার, সামাজিক ন্যায়বিচারÑতুলে ধরেছেন। ফলে ‘পজিটিভ ন্যারেটিভ’ এখন রাজনৈতিক মূলধনের নতুন ভিত্তি।
এর অর্থ, এখনকার রাজনীতি হলো নিজের উত্তম আদর্শ দিয়ে ভোটারদের মন জয় করার প্রতিযোগিতা; আক্রমণে অন্যকে পরাভূত করে নিজেকে জাহির করার প্রচেষ্টা নয়।
৪.
‘ডেলিভারি রাজনীতি’ হলো নতুন রাজনীতির আরেক দিক, যেখানে ফাঁকা প্রতিশ্রুতি নয়, বরং কাজ করে দেখিয়ে দেওয়া বা প্রারম্ভেই উদাহরণ সৃষ্টি করা বা বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই হলো আসল কাজ। বাংলাদেশে এতদিন রাজনীতি মানে ছিল ফাঁকা প্রতিশ্রুতি, সস্তা স্লোগান, গলাবাজি, গায়ের জোর এবং ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু জনগণ এখন চায় বাস্তবায়নযোগ্য নীতি, দৃশ্যমান কর্মফল এবং স্বচ্ছ পদ্ধতি। তাই ‘ডেলিভারি রাজনীতি’ এখন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে। এর অর্থ হলো, মারামারি আর গলাবাজি বাদ দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে এই সার্ভিস ওরিয়েন্টেড কাজ দিয়ে এবং এর মধ্যে নতুনত্ব যোগ করে। এটা একটা নতুন প্যারাডাইম শিফট। উদাহরণস্বরূপ, ডাকসুতে যাদের ভূমিধস বিজয় হয়েছে, তাদের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সার্ভিস ওরিয়েন্টেড কাজ-
ক. জুলাই জাগরণ অনুষ্ঠান।
ক. ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেস।
গ. সায়েন্স ফেস্ট।
ঘ. জুলাই চিত্র প্রদর্শনী।
ঙ. রমজানে ইফতার বিতরণ।
চ. মৌসুমি ফল উৎসব, পিঠা উৎসব।
ছ. প্রকাশনা উৎসব।
জ. ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প।
ঝ. ফ্রি বাস সার্ভিস ফর বিসিএস।
ঞ. স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি।
ট. বৃক্ষরোপণ অভিযান।
ঠ. ছাত্রীদের হলে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন।
ড. লাল বাস অ্যাপ, যেটির মাধ্যমে ঢাবির বাসগুলোর লোকেশন ট্র্যাক এবং অ্যারাইভাল টাইম চেক করা যাবে।
৫.
একা বা একদল নয়, ‘সমষ্টির রাজনীতি’ এখন জনপ্রিয়। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতি প্রায়ই দলকানা মানসিকতায় ভুগেছে, যেখানে নিজের দল ছাড়া আর কাউকে স্বীকৃতি না দেওয়াই ছিল রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু সাম্প্রতিক আন্দোলন দেখিয়েছে, একা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে এগোতে হবে। যেমন : ডাকসু-জাগসু আন্দোলনে ডান, বাম, ইসলামপন্থি, এমনকি নির্দলীয় ছাত্ররাও একত্র হয়েছিল। ফলে নতুন প্রজন্ম শিখেছেÑরাজনীতি মানে সমষ্টির যাত্রা, একক আধিপত্য নয়। যারা সবাইকে নিয়ে ইনক্লুসিভ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছেন, তারাই রাজনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন।
৬.
নম্রতা ও ভদ্রতার রাজনীতিই আজ সবাই দেখতে চায়। অতীতে রাজনীতিতে অহংকার, জেদ এবং ক্ষমতাশালী ভঙ্গি বা দাপট দেখানো ছিল বহুল প্রচলিত। তবে নতুন প্রেক্ষাপটে এগুলো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। ছাত্রনেতারা দেখিয়েছেন, ভদ্রতা ও নম্রতাই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আনে। যেমন : ডাকসু আন্দোলনের সময় ছাত্রনেতাদের নম্র ভাষা, শালীন বক্তব্য এবং অহিংস আচরণ সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় অংশজুড়ে ছিল ক্যাডারগিরি, মাস্তানিভাব এবং শক্তি প্রদর্শন। কিন্তু সাম্প্রতিক আন্দোলন প্রমাণ করেছে, এগুলো এখন আর কার্যকর নয়। জনগণ এসব আচরণের প্রতি খুবই নেতিবাচক এবং চরম নাখোশ। বরং শান্ত, যুক্তিনির্ভর, শীতল কৌশলই এখন শক্তিশালী বলে বিবেচিত হচ্ছে।
সব মিলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ট্যাগিং, একাত্তরের বয়ান, বসগিরি এবং ফাঁকা প্রতিশ্রুতির রাজনীতি এখন অচল। এর জায়গায় উদীয়মান হচ্ছে পজিটিভ আদর্শ, ডেলিভারি রাজনীতি, সমষ্টিগত নেতৃত্ব, নম্রতা ও শালীনতা এবং বাস্তবমুখী পরিবর্তনের সংস্কৃতি। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এই পরিবর্তন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেÑযদি এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি সিঙ্গাপুর

