লৌহ শাসনের অবসান : পরিবর্তনের সূচনা
‘নৈতিক মহাবিশ্বের চাপ দীর্ঘ, তবে তা ন্যায়ের দিকে বাঁক নেয়।’ —মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকার রাস্তাঘাটগুলো বিশৃঙ্খলায় ঢাকা পড়েছিল। এটা কোনো বিক্ষোভ ছিল না। এটা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ভয়ের শাসনের অবসান। তার সরকার কঠোর নিয়ন্ত্রণ, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ, আর নির্বাচনে কারচুপি করে শাসন করেছিল। নিরাপত্তা বাহিনী যখন বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, তখন আগুন জ্বলে ওঠে। এই তরুণ জনতা নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র চেয়েছিল, কিন্তু তার জবাবটা ছিল বর্বর। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, এক হাজার চারশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। টিয়ার গ্যাস ও বুলেটে অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে গেছে। এই বর্বরতা গোটা বিশ্বকে তখন চমকে দিয়েছিল।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তার প্রস্থানে বাংলাদেশ সংকট থেকে মুক্তি পায়। সরকারের পতন হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা ধসে পড়ে। জাতি ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে এগিয়ে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক পরিবর্তনে কাজের স্বীকৃতির জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন তিনি। তার লক্ষ্য সুস্পষ্ট—জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র নির্মাণ করা।
ড. ইউনূস যেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছেন, এই নিবন্ধে সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠান, বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক খেলা। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি নিরপেক্ষ ও সমতার ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারবে? বাংলাদেশ একটা জটিল মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। এটা হলো এই জাতির পথ খোঁজার গল্প।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার মধ্যে নেতৃত্বদান
যেকোনো একটি জায়গার অবিচার সব জায়গার ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি।
- —মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
দেশ যখন ভেঙে পড়তে উন্মুখ, তখন দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন ড. ইউনূস। গণঅভ্যুত্থানের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় সামরিক বাহিনীকে মাঠে নামতে হয়েছে। এতে অনেকের কাছে বাংলাদেশকে সামরিক শাসনের দেশ মনে হয়েছে। বহু বছরের দুর্নীতি আর গোয়েন্দাগিরি সেনাবাহিনীর ব্যাপারে জনগণের আস্থা ধসিয়ে দিয়েছে। ব্যবস্থা পচে গেছে।
ইউনূস আরেকটি বাধার মুখে পড়েছেন। পুরো টিমকে তিনি স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারেননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে চলতে গিয়ে তিনি এমন কতিপয় উপদেষ্টাকে নিতে বাধ্য হয়েছেন, যাদের পুরোনো ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এতে তার পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ভেতর থেকে অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে গেছে। তারপরও তিনি ড. খলিলুর রহমানের মতো শক্তিশালী সংস্কারপন্থিকে নিয়োগ দিতে পেরেছেন। খলিলুর রহমানের ভূমিকা সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়াতে পারে, আবার কমাতেও পারে।
এক নির্বাসিত টেকনোক্র্যাট
মহত্ত্বের মূল্য হলো দায়বদ্ধতা।
—উইন্সটন চার্চিল
ড. খলিলুর রহমানের মতো ব্যাক্তি এখন বাংলাদেশে দরকার। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং জাতিসংঘে ২৫ বছর ধরে কূটনীতির অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ২০০১ সালে তিনি ব্রাসেলস প্রোগ্রামস অব অ্যাকশন সৃষ্টিতে সাহায্য করেছেন। এই কর্মসূচি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বাজার খুলে দিয়েছে। হার্ভার্ড ও টাফটে লেখাপড়া করা খলিলুর রহমান সারা বিশ্বেই সম্মানের পাত্র।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা-বিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিই বদলে দিয়েছেন খলিলুর রহমান। ভারত আর চীনের মধ্যে সম্পর্কে তিনি ভারসাম্য নিয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে তিনি শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। ভারত ও চীনের সঙ্গে কঠিন আলোচনা পার করে তিনি বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করেছেন।
কিন্তু খলিলুর রহমানকে আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। বিএনপি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে, খলিলুর রহমান ভুয়া নাম নিয়ে কাজ করেছেন। তার আনুগত্য নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন। খলিলুর রহমান তাদের মিথ্যাচার অস্বীকার করেছেন। বহু দশক ধরে তিনি বাংলাদেশকে সেবা দিয়ে আসছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অপপ্রচারের পেছনে রয়েছে ভারত। খলিলুর রহমান যে স্বাধীন নীতি নিয়ে কাজ করছেন, সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাকে দুর্বল করার জন্য ভারত মিডিয়া আর রাজনৈতিক চাপকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
খলিলুর রহমানের সংগ্রাম একজন মানুষের সংগ্রাম মাত্র নয়। এটা সংস্কার আর পুরোনো শক্তির লড়াই সামনে এনেছে। তার মতো নেতাকে রক্ষা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা ন্যায্যতার প্রশ্ন। এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিভ্রম
বাস্তবায়নবিহীন ভিশন হলো বিভ্রম।
—থমাস এডিসন
আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন মাহমুদ বিন হারুন, যিনি আশিক চৌধুরি নামে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা বিডার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হার্ভার্ডে লেখাপড়া করা আশিক চৌধুরি দুবাই ও সিঙ্গাপুরে আর্থিক খাতে কাজ করেছেন। তার নিয়োগটা ছিল নতুন মেধাবীদের সামনে আনার ব্যাপারে একটা সাহসী পদক্ষেপ।
চলতি বছরের মার্চে আশিক চৌধুরি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে কথা বলেন। তিনি বড় বড় স্বপ্নের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো উৎপাদন কেন্দ্র হতে পারে। তিনি ইলেক্ট্রনিক্স, সবুজ টেক্সটাইলস এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। তার কথাগুলো তখন খবরের শিরোনাম হয়েছিল।
তবে অনেকেই তার পরিকল্পনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের জন্য এখনও প্রস্তুত নয়। সহিংসতা, লালটেপের দৌরাত্ম্য এবং বিদেশবিরোধী মনোভাব ব্যবসায়ীদের অনীহা তৈরি করে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকা বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতা নিয়ে রিপোর্ট করেছে। স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের অনেকে আশিক চৌধুরির ধারণাগুলোকে ফাঁকা বুলি মনে করেন। তারা বলছেন, সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য ভূমি আইন, কর ও আদালতে সংস্কার আনতে হবে। এসব সংস্কার ছাড়া তার বক্তৃতা শুধু ফাঁকা প্রদর্শনী মাত্র।
উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ড. ইউনূস উপদেষ্টাদের নিয়ে কাউন্সিল করেছেন। এটার নাম দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল কনসেনসাস কমিশন। কমিশনে ২৩ জন উপদেষ্টা আর তিনজন বিশেষ সহকারী রয়েছেন। এই গ্রুপে স্কলার, রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, অর্থনীতিবিদ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদেরও নেওয়া হয়েছে। নারী, তরুণ, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সবারই এখানে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি রয়েছে। এই কমিশন থেকে বোঝা যায়, ড. ইউনূস ঐক্য ও ন্যায্যতার প্রশ্নে কতটা আন্তরিক।
এই কাউন্সিলের শক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের জন্য বিখ্যাত ড. ইউনূস অর্থ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করছেন। কতিপয় ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে। তারা অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে এবং রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য কাজ করছেন।
একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ড. আলী রীয়াজ। তিনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান। তিনি ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। রিয়াজ বাংলাদেশের অতীত নিয়ে কাজ করেন, যাতে ভবিষ্যতের পথ দেখানো যায়। তার টিম ক্ষমতা ভাগাভাগি, স্বাধীন আদালত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মতো বড় বড় ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত রাখা এবং পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার মতো ধারণাগুলোর পক্ষে সমর্থন রয়েছে। রীয়াজ সব গোষ্ঠীর সঙ্গেই কথা বলছেন। এটা তার কাজের ব্যাপারে আস্থা তৈরি করছে।
তবে ঝুঁকি রয়েই গেছে। এই কাউন্সিল কি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে? কট্টর গোষ্ঠীগুলো সংস্কারকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কারো কারো উদ্বেগ রয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বেশি ক্ষমতা পেয়ে যেতে পারে। সুশাসন ব্যবস্থায় সত্যিকারের পরিবর্তন এবং আস্থা নির্মাণের ওপর নির্ভর করছে চেষ্টা কতটা সফল হবে।
অর্থনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের ওপর। তিনি আইএমএফে কাজ করেছেন। মনসুর বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি বাজারভিত্তিক বিনিময় রেট চালু করেছেন, সবুজ অর্থায়নের নীতিমালা চালু করেছেন। মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় তিনি সুদের হার বাড়িয়েছেন। তিনি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অর্থও দিয়েছেন। অনেকে তার বাস্তবমুখী পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। অন্য অনেকে বলছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির ক্ষতি করবে।
কাউন্সিল, সাংবিধানিক টিম এবং ব্যাংক নেতারা—সবাই মিলে আস্থা সৃষ্টি এবং গণতন্ত্র ফেরাতে একটা পরিকল্পনা নিয়েছেন। তাদের সাফল্য নির্ভর করছে বাস্তব পদক্ষেপ এবং জনগণের সমর্থনের ওপর।
ক্ষমতার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিভ্রম
গণতন্ত্র শুধু ভোটের অধিকার নয়, এটা মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার।
—নাওমি ওসমান
বিএনপি সংস্কারকে সমর্থনের কথা বললেও চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তারা নির্বাচন দাবি করেছিল। তারা কতিপয় উপদেষ্টাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিও তুলেছে। ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) মতো তরুণ দল তাদের সঙ্গে একমত নয়। তারা বলছে, নির্বাচনের আগেই সংস্কার হতে হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের খারাপ ইতিহাস রয়েছে। কারচুপি ও হুমকি-ধমকির বিষয়গুলো এখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, শুধু নির্বাচন হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। শক্তিশালী আদালত, ন্যায্য নির্বাচনী আইন এবং স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া নির্বাচন হলে মানুষের মুক্তি মিলবে না, পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণের দিকে যাবে।
সিংহাসনের পেছনের ক্ষমতা
সামরিক বাহিনী একই সঙ্গে সহায়ক শক্তি এবং হুমকি। মে মাসে জেনারেল ওয়াকার বেসামরিক শাসনের কথা বলেছেন। কিন্তু উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। কিছু সামরিক নেতা পুরোনো শাসনের প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছেন। ইউনূসের সংস্কারকে তারা পছন্দ করছেন না। সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। তাদের কাজ জাতিকে সুরক্ষা দেওয়া, দেশ শাসন করা নয়। এই পরিবর্তনের জন্য বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ এবং সুস্পষ্ট পরিকল্পনা লাগবে।
সংস্কারের ভঙ্গুর কিন্তু অপরিহার্য পথ
ভবিষ্যৎ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সেটা নির্মাণ করা।
—পিটার ড্রাকার
ড. ইউনূস ২০২৬ সালের এপ্রিলে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। সেটা শুধু একটা তারিখ ছিল না। সেটা হলো নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে। তাদের অবশ্যই আস্থা গড়তে হবে, পুরোনো ভাঙা ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান করতে হবে। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে—
- পুলিশ ব্যবস্থা মেরামত : বহু বছরের দুর্নীতি পুলিশ কাঠামোর ক্ষতি করেছে। জনগণকে নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং তাদের সেবার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- স্বাধীন গণমাধ্যম ও নির্বাচন : নির্বাচন কমিশন ও মিডিয়াকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। এর মাধ্যমেই কেবল ভোট কারচুপি প্রতিহত করা এবং উন্মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করা সম্ভব।
- ঘাতকদের বিচার : ২০২৪ সালের জুলাই হত্যার পেছনে যারা রয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এতে সরকারের প্রতি আস্থা গড়ে উঠবে।
- স্বাধীন আদালত ও জনপ্রশাসন : বিচার বিভাগ ও আমলাতন্ত্রকে অবশ্যই মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, রাজনীতিবিদদের জন্য নয়।
- সামরিক শক্তিকে সীমিত রাখা : সেনাবাহিনীকে অবশ্যই প্রতিরক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে, রাজনীতিতে নয়। গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য এর বিকল্প নেই।
- জুলাই সনদ : ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে মর্যাদা দিতে হবে। ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য উপযুক্ত সনদ ঘোষণা করতে হবে।
বিপ্লব থেকে পুনর্গঠন : চূড়ান্ত পরীক্ষা
ভাইয়ের মতো একসঙ্গে বাস করতে না শিখলে আমরা বোকার মতো ধ্বংস হয়ে যাব।
—মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
হাসিনার পতনে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু নতুন যুগের নিশ্চয়তা আসেনি। সংস্কার না হলে পুরোনো শক্তিই ফিরে আসবে। ইউনূস ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার তার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু তার টিমের দূরদর্শিতা দরকার, জনগণের সমর্থন দরকার।
বাংলাদেশ অনেক মিথ্যা সূচনা দেখেছে। এখন শুধু নেতা নয়, পুরো ব্যবস্থাকে বদলে ফেলার সময়। বিপ্লবকে অবশ্যই পুনর্গঠনে পরিণত করতে হবে।
নৈতিক দায় মেটানোর এখনই সময়
আজকের সিদ্ধান্ত রাজনীতির চেয়ে অনেক বড়। এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। এখনই তৎপর হতে না পারলে অবিচারের ঝুঁকি আরো বাড়বে, তরুণদের কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে যাবে এবং গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে। এর মূল্য অনেক। মানুষ স্বাধীনতা হারাবে, আস্থা নষ্ট হবে এবং একটা পুরো প্রজন্ম আশাহীন হয়ে পড়বে।
সময় বেশি নেই। বাংলাদেশকে অবশ্যই এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের সাহস লাগবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। চেষ্টা করলে অতীতের শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে দেশ। এই তৎপর হওয়ার আহ্বানে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যতের শুরু আজ থেকেই।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক

