বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ৫৪ বছর চলে গেছে। সময়টা অর্ধশতাব্দীরও কিছু বেশি। এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর আরো কিছু স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হলো ৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫। ভিয়েতনামের মুক্তির জন্য ভিয়েতনামের জনগণকে দুটি পরাশক্তি ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই করতে হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। সেই ভিয়েতনাম আজ বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ভিয়েতনামকে অন্যান্য রাষ্ট্র সম্ভ্রম ও মর্যাদার চোখে দেখে। ভিয়েতনামের অর্থনীতি এখন মজবুত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভিয়েতনামের নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও সমাজের বাস্তব অবস্থার নিরিখে ব্যক্তি উদ্যোগ ও বাজার সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য এটা নয় যে তারা একটি পুঁজিবাদী সমাজ গঠন করতে চায়। ভিয়েতনামের শাসকদল ‘ভিয়েতনাম ওয়ার্কার্স পার্টি’ সমাজতন্ত্রকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন উৎপাদিকা শক্তির বিশাল বিকাশ। এর জন্য প্রয়োজন একাগ্রতা, সাধনা এবং লক্ষ্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। ভিয়েতনাম সেই পথেই চলছে। দেশি ও বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামের শিল্পায়ন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আধুনিক ইলেকট্রনিক্স শিল্পে তার সাফল্য ঈর্ষণীয়।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরে আমাদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে? বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো মাত্র দুটি খাতের ওপর নির্ভর করে রয়েছে। খাত দুটি হলো পোশাকশিল্প এবং বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো বিদেশি রেমিট্যান্স। কৃষি খাতেও পরিবর্তনের কিছু ছোঁয়া লেগেছে। ফসলের নিবিড়তা প্রায় ৩০০ শতাংশে পৌঁছেছে। কৃষিতে উচ্চমূল্য ফসলের আবাদ শুরু হয়েছে। বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে ফলের আবাদও বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট মাছ ও হাঁস-মুরগির শত শত খামার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির বাণিজ্যায়নেরও সূচনা হয়েছে। এখনকার কৃষিতে লিজ প্রথা দ্রুত বর্ধনশীল। লিজে জমি নিয়ে বাণিজ্যিক লক্ষ্যে নতুন ধরনের আবাদ শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষির রূপান্তর বলতে যা বোঝায় তা পরিপূর্ণতা পায়নি। কৃষির উৎপাদনে প্রবৃদ্ধিও খুবই শ্লথ। মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির অবদান ১১ শতাংশ, অথচ কৃষি এখনো কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশের উৎস। দেশে গত চার বছরে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্য এখন ১৮ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা যায়, বছরে এক শতাংশ করে দারিদ্র্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ার ফলে দারিদ্র্য বাড়ছে। দেশে এখন তিন কোটি ৬০ লাখ দরিদ্র মানুষ। এদের একটা বড় অংশ চরম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান জুগিয়ে অচিরে দারিদ্র্য নিরসন করা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে শিল্প খাতের বিকাশেও আশানুরূপ কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফার্মাসিউটিক্যাল, লেদার গুডস, সিরামিকস ও জাহাজশিল্প বিকাশের সুযোগ থাকলেও এই শিল্পগুলো আশানুরূপভাবে বিকশিত হচ্ছে না। দেশে চলছে বিনিয়োগ দুর্ভিক্ষ। জাতীয় অর্থনীতিতে বিনিয়োগের হিস্যা ২২ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো না গেলে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিরসনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ১০-১৫টি অলিগার্ক গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। এরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ধস নামিয়েছে। এই দুর্বৃত্তদের জন্য প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বোচ্চ শাসকের নির্দেশে ব্যাংকের ভল্টগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এরা এক কড়া-ক্রান্তিও বিনিয়োগ করেনি। সব অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ কয়েক লাখ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার সরকার দেশে এক চোরতন্ত্র (Kleptocracy) প্রতিষ্ঠা করেছে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা রাষ্ট্র দখল (State capture) করেছে। আসলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই চোরতন্ত্র ডালপালা মেলে ক্রমান্বয়ে এক বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। চোরতন্ত্র অর্থনীতির বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে আওয়ামী দস্যু, আওয়ামী আমলা, আওয়ামী পুলিশ ও আওয়ামী বিচারকদের নিয়ে একটি অশুভ Nexus গড়ে উঠেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই nesus-এর চামড়ার নিচে কাঁটা গাঁথতে পারেনি। অথচ এই Nexus ভাঙতে না পারলে দেশে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কারণে আজ পর্যন্ত অব্যাহত গতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি, তার মূলে রয়েছে primitive accumulation বা আদিম সঞ্চয়ন। কার্ল মার্কসের দৃষ্টিতে এটা হলো ‘আদি পাপ’ বা ‘original sin’। যেসব দেশে পুঁজিবাদ দানা বেঁধেছে, সেসব দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে আদিম সঞ্চয়নের মাধ্যমে পুঁজির আদি রূপ গঠিত হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে যেসব দেশে অল্পকাল পরেই আদিম পদ্ধতি অর্থাৎ দখল ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে উৎপাদনে বিনিয়োগ হয়েছে, সেসব দেশ থেকে পুঁজি অন্য দেশে পাচার হয়নি; বরং অন্যদেশ থেকে ছলেবলে কৌশলে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজ দেশে পুঁজির ভিত পাকা করা হয়েছে। যেমনটি করেছে ব্রিটেন ঔপনিবেশিক ভারত থেকে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশি লুটেরারা নিজ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে অন্য দেশে পাচার করে। এই সম্পদ বাংলাদেশি জনগণের ঘাম ও রক্তে সৃষ্ট হয়েছে। জনগণকে এই লুটেরারা শোষণ করে নিঃস্ব ও সর্বহারায় পরিণত করছে। দেশের উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ শুধু উপযুক্ত ধরনের লুণ্ঠনের পরিণতিই ভোগ করছে না, এর অভ্যুদয়লগ্নে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলো থেকে সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র ভারতীয়রা লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। ভারতীয় সৈন্যরা দোকানপাট থেকে মূল্যবান সামগ্রী, ইলেকট্রনিক পণ্য ও সোনাদানা সবকিছু লুটে নিয়ে গেছে। লুণ্ঠিত হওয়াই কি বাংলাদেশের জনগণের বিধিলিপি?
ভারত সাত দফা গোপন চুক্তির মাধ্যমে তথাকথিত ২৫ বছরের বন্ধুত্ব, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তির নামে, পানিবণ্টন চুক্তির নামে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক-অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করে, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা করে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলাদেশকে একটি বর্ধিত সীমান্তের অধীনে (extended frontier) নিয়ে গেছে। কুমড়ার ফালির মতো টুকরো টুকরো করে করিডোর নিয়েছে ভারত। ভারত বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে একতরফা নির্বাচন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রেখেছে তার স্বার্থ আদায় করার জন্য। সে কারণেই শেখ হাসিনা লজ্জা-শরম হারিয়ে উক্তি করেছিলেন, ‘ভারতকে আমরা যা দিয়েছি, ভারত তা চিরকাল মনে রাখবে।’ ভারত-তোষণের নির্লজ্জ এই দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের জনগণ ২০২৪ সালের মহাগণঅভ্যুত্থানে ঘৃণা ও ক্রোধের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মর্যাদা আশা করতে পারে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন কেমন? বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এখন fractured বা ফাটল ধরা। তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্র বলতে বোঝায় সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আমলাতন্ত্র, পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগ ও কারাগার। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই ফাটল ধরেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অতিরাষ্ট্রিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠান বা অঙ্গগুলোকে দেশের জন্য সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রবল ও Firepower-এর দিক থেকে পঙ্গু রাখা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর ডকট্রিনে পরিবর্তন ঘটিয়ে এর ক্ষিপ্রতা ও আঘাত হানার ক্ষমতা খর্ব করে রাখা হয়েছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার সামরিক বাহিনীর কিছু ব্যক্তিকে গণবিরোধী কাজে ব্যবহার করে এর মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। আজ তাই প্রয়োজন রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা এবং এগুলোর ওপর জনআস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে ‘না’ বলতে হবে।
ভারতীয় আধিপত্যবাদকে দৃঢ়ভাবে ‘না’ বলার জন্য প্রয়োজন ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে দোষারোপের রাজনীতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসিত ও কদর্য ভাষায় একদলের লোক অন্যদলের কুৎসা রটনা করছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক পরিস্থিতি। ভারতীয় আধিপত্যবাদ বসে নেই। তারা আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে ভয়াবহভাবে ষড়যন্ত্র করছে। এ কাজে তাদের সহায়তা করছেন ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপনরত আওয়ামী নেতারা। তাদের আছে লুটের টাকা। তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে দেশবাসীর কপালে দুর্ভোগ আছে। রাজনীতির মত ও পথ নিয়ে পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের প্রশ্নে মতপার্থক্য আত্মহননের শামিল। জাতিকে এই অবস্থা থেকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। চাই রাষ্ট্ররক্ষা। চাই দেশরক্ষা।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা ও রাষ্ট্রচিন্তক
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

