আলফাজ আনাম
ফ্যাসিবাদী শাসনের দেড় দশকে বিনোদনমূলক সাংবাদিকতা ছিল বিদেশ সফর শেষে গণভবনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনগুলো। সেখানে প্রশ্ন নয়, প্রশংসার বাণী নিয়ে হাজির হতেন বাংলাদেশে সাংবাদিকতা বাহিনীর জেনারেলরা। তাদের চোখে শেখ হাসিনা হয়ে উঠতেন ম্যাজিক্যাল লেডি, আবার কারো চোখে তিনি ছিলেন বিশ্বনেত্রী। বিশ্বের জটিল সব সমস্যা সমাধানে তার তৎপরতার কারণে দেশে তাকে আর পাওয়া যাবে না বলে বেদনার কথা শোনাতেন এই সাংবাদিকরা। আবার কেউ কেউ নোবেল বিজয়ের কলাকৌশল জানিয়ে পরামর্শ দিতেন প্রধানমন্ত্রীকে। কেউ আবার শেখ হাসিনাকে মাছ চাষ, আলু চাষ শেখাতেন। শেখ হাসিনা তাদের সীমাহীন প্রশংসা উপভোগ করতেন, আবার নানা প্রসঙ্গে কখনো কখনো খিলখিলিয়ে হাসতেন। সেই হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত সাংবাদিকদের মধ্যে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কারণে বিনোদনমূলক প্রশ্নোত্তর পর্বটা দেখতে পারছেন না বলে দেশের মানুষ অপার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাংবাদিক বাহিনীর জেনারেলদের চোখে শেখ হাসিনার আমলে এই সংবাদ সম্মেলনগুলো ছিল ব্যাপক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অংশ।
শেখ হাসিনা তার সাংবাদিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সর্বশেষ বসেছিলেন পালিয়ে যাওয়ার এক দিন আগে গণভবনে। সেখানে সাংবাদিকরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কীভাবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের দমন করা যায়। কীভাবে তারা দেশকে ধ্বংস করছে, তার ভয়াল চিত্র তারা তুলে ধরেছিলেন। র্যাব-পুলিশ ঠিকমতো গুলি করতে পারছে না বলে তাদের আক্ষেপের শেষ ছিল না। সেদিন যারা গণভবনে উপস্থিত ছিলেন, হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের কয়েকজনও পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হয়েছেন। অনেকের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের কয়েকজন আছেন কারাগারে, আবার কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। সে সংখ্যা খুবই সামান্য।
গণভবনে পরামর্শ দিতে কিংবা প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে যারা যেতেন, তাদের অনেকে সাংবাদিকতা বাহিনীর জেনারেল হিসেবে একেকটি পত্রিকা ও টেলিভিশন স্টেশনে যে দাপট দেখাতেন, সেটি আর পারছেন না। এ নিয়ে তাদের ক্ষোভ, দুঃখ ও হতাশার শেষ নেই। কারণ তাদের মতে ড. ইউনূসের শাসনে দেশ এখন ক্রান্তিকালে আছে। এখনই করা যেত আসল সাংবাদিকতা-এখন আর প্রশংসা নয় প্রশ্নবাণে নিক্ষেপ করা যেত। কিন্তু তাদের আখ্যায়িত করা হচ্ছে নিপীড়ক সরকারের দোসর হিসেবে। তাদের দাবি, তারা তো দোসর নন, তারা শুধু সাংবাদিকতা করেছেন।
এখন যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় আপনারা যে প্রশংসার ডালি নিয়ে হাজির হতেন, সেটি কেমন সাংবাদিকতা ছিল? কিংবা আপনারা যে জনতার আন্দোলন দমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা কীভাবে সাংবাদিকতার অংশ ছিল? তারা বুক ফুলিয়ে বলবে অবশ্যই। আমরা তো সাংবাদিকতা করেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা তো মতামত দিতেই পারি। এটা ব্যক্তির স্বাধীনতা, একজন সাংবাদিকের মতপ্রকাশের অধিকার।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে এর বিপীতে আরো কিছু সাংবাদিক ছিলেন। ছিল কিছু সংবাদপত্র ও টেলিভিশন স্টেশন। হাসিনার পোষা সাংবাদিক বাহিনীর চোখে এরা সাংবাদিক হিসেবে গণ্য হতেন না। তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হয়েছিল। এভাবেই সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল, তখন আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? তাদের জবাব হচ্ছে, সাংবাদিকতা ও অ্যাক্টিভিজম তো এক হতে পারে না। এসব সংবাদমাধ্যম তো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করেনি, সীমালঙ্ঘন করেছে। তারা সাংবাদিকতা করেননি, অ্যাক্টিভিজম করেছেন। সরকারকে প্রশ্ন করা, নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা, দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা ছিল তখন অ্যাক্টিভিজম। কিন্তু গণভবনে গিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যার উসকানি দেওয়া, গুম ও খুন নিয়ে প্রশ্ন না করে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেওয়া অ্যাক্টিভিজম নয়-এগুলো সাংবাদিকতা।
গত দেড় দশকে সরকারের নিপীড়নের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের সব ধরনের চেষ্টা করেছে এসব সাংবাদিক ও গণমাধ্যম। কিন্তু তাদের ফ্যাসিবাদের দোসর বলা যাবে না, এমনকি অ্যাক্টিভিস্টও বলা যাবে না। কারণ ফ্যাসিবাদী আমলে তারা যা করেছেন, তা ছিল সাংবাদিকের অধিকার। কিন্তু হাসিনার শাসনামলে যারা গুম, খুন নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারা সাংবাদিক ছিলেন না। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বড় পরিচয়। আসলে সাংবাদিকতার নামে নিপীড়কের সহযোগী শক্তি এখনো ঠিক করে দিতে চায় কারা সাংবাদিক এবং কারা সাংবাদিক নন।
শেখ হাসিনার সময় প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে অফিসে গিয়ে লাঞ্ছিত করে মাসের পর মাস কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। মাহমুদুর রহমানকে মাসের পর মাস রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়েছে। কয়েক বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। জয় হত্যাচেষ্টার ভুয়া অভিযোগে ৯০ বছর বয়সের সম্পাদক শফিক রেহমানকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের চোখে এরা কেউ সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় যদি কেউ আটক হন, ব্যাংকে শতকোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়, খুন ও গুমের পরামর্শ দেওয়ার জন্য যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়, তখন তা হয়ে উঠে সাংবাদিকের ওপর হয়রানি।
শেখ হাসিনার সাংবাদিক বাহিনীর সদস্যরা আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে চান। এখন তাদের লক্ষ্য হলো আওয়ামী লীগের হত্যার পক্ষে ন্যায্যতা প্রমাণ করা। শেখ হাসিনা হত্যাকাণ্ডের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করার জন্য এখন প্রায়ই বলে থাকেন, পুলিশ হত্যার বিচার হবে। তিনি আরো বলেন, দেশে ফিরে এসে প্রতিটি হত্যার বিচার করবেন। শেখ হাসিনার সুরে তার সাংবাদিক বাহিনীর সদস্যরা প্রশ্ন তুলছেন, ১৪০০ লোক যে মারা গেছে, তার কী কোনো প্রমাণ আছে? যুক্তি দেওয়া হচ্ছে শেখ হাসিনা কীভাবে একজন লোক হয়ে ১৪০০ লোক মারতে পারেন? অকাট্য যুক্তি বটে! শেখ হাসিনা নিজে হত্যা করেননি, তিনি ছিলেন হত্যার নির্দেশদাতা। এই সহজ সত্যটি তারা বলতে নারাজ। যেমন তারা এখন স্বীকার করেন না শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষকে নিপীড়ন ও পঙ্গু করার পক্ষে গণসম্মতির সঙ্গে এই সাংবাদিক বাহিনীর জেনারেল থেকে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট-সবাই ভূমিকা পালন করেছেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে চারটি বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা। দ্বিতীয়ত, মাওলানা সাঈদীর রায়ের পর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ড। প্রতিটি ঘটনায় আওয়ামীপন্থি সাংবাদিক বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ডের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা হয়েছে, রাষ্ট্রের স্বার্থে এসব হত্যাকাণ্ড জায়েজ ছিল-এই ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকে এখন বলছেন, তার চাকরির স্বার্থে এগুলো করেছেন। আবার টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রের মালিকরা বলছেন, সরকারের চাপে তারা এমন প্রচারণা চালিয়েছেন। গণমাধ্যমের মালিকদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে এমন বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েমের শুরু যেখান থেকে, সেই শাহবাগের আন্দোলনের সময় গণমাধ্যম কীভাবে নিজ উদ্যোগে শাহবাগ তৈরি করেছে, সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে প্রথমে ১৫ থেকে ২০ জন বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী শাহবাগে দাঁড়িয়েছিলেন। দ্রুত মিডিয়া বিষয়টি সামনে আনে। এরপর একটি একটি করে সব টেলিভিশন লাইভ সম্প্রচার করে। গণমাধ্যম যখন বিষয়টিকে ইস্যু তৈরি করে, পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এতে সম্পৃক্ত হয়। শাহবাগের আন্দোলনে অ্যাক্টিভিস্টদের চেয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই শাহবাগ থেকে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল। যার ওপর ভর করে হাসিনা তিনটি বিনাভোটের নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করেছিলেন।
হেফাজতের আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের এসব তথাকথিত পেশাদার গণমাধ্যমে গাছ কাটা ও কোরআন পোড়ানো ছিল প্রধান খবর। কিন্তু হেফাজতের হিসাবে সেদিন ৯৩ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন, সে খবর গুরুত্ব পায়নি। আমরা যদি সে সময়ের খবরগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে, কোনো সরকারি নির্দেশনা নয়, এসব গণমাধ্যম নিজ উদ্যোগে আলেম-ওলামাদের প্রতি ঘৃণা থেকে এভাবে খবর পরিবেশন করেছে। এখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছর না ঘুরতেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুলছেন, ১৪০০ লোক মারা যাওয়া তথ্য সঠিক কি না। এই সাংবাদিকরা এখন প্রশ্ন করার স্বাধীনতা চান। অবশ্যই সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার আছে। এমনকি ছাত্র অভ্যুত্থানে নিহতদের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে প্রশ্ন করা।
কিন্তু এই সাংবাদিকদেরও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তাদের বলতে হবে শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনে আপনি নিপীড়ন চালানোর পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন কি না? শেখ হাসিনা বা সরকারের কতজন মন্ত্রীকে আপনি গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন? যখন সংবাদপত্র বন্ধ করে তিনজন প্রবীণ সম্পাদককে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল, তখন আপনার ভূমিকা কী ছিল? সাংবাদিক শুধু প্রশ্ন করবেন কিন্তু সাংবাদিকরা প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন না, তা তো হতে পারে না। আপনার সাংবাদিক পরিচয় আছে বলে ফ্যাসিস্টের সহযোগীর ভূমিকা আড়াল হতে পারে না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ
alfaz@dailyamardesh.com
ফ্যাসিবাদী শাসনের দেড় দশকে বিনোদনমূলক সাংবাদিকতা ছিল বিদেশ সফর শেষে গণভবনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনগুলো। সেখানে প্রশ্ন নয়, প্রশংসার বাণী নিয়ে হাজির হতেন বাংলাদেশে সাংবাদিকতা বাহিনীর জেনারেলরা। তাদের চোখে শেখ হাসিনা হয়ে উঠতেন ম্যাজিক্যাল লেডি, আবার কারো চোখে তিনি ছিলেন বিশ্বনেত্রী। বিশ্বের জটিল সব সমস্যা সমাধানে তার তৎপরতার কারণে দেশে তাকে আর পাওয়া যাবে না বলে বেদনার কথা শোনাতেন এই সাংবাদিকরা। আবার কেউ কেউ নোবেল বিজয়ের কলাকৌশল জানিয়ে পরামর্শ দিতেন প্রধানমন্ত্রীকে। কেউ আবার শেখ হাসিনাকে মাছ চাষ, আলু চাষ শেখাতেন। শেখ হাসিনা তাদের সীমাহীন প্রশংসা উপভোগ করতেন, আবার নানা প্রসঙ্গে কখনো কখনো খিলখিলিয়ে হাসতেন। সেই হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত সাংবাদিকদের মধ্যে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কারণে বিনোদনমূলক প্রশ্নোত্তর পর্বটা দেখতে পারছেন না বলে দেশের মানুষ অপার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাংবাদিক বাহিনীর জেনারেলদের চোখে শেখ হাসিনার আমলে এই সংবাদ সম্মেলনগুলো ছিল ব্যাপক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অংশ।
শেখ হাসিনা তার সাংবাদিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সর্বশেষ বসেছিলেন পালিয়ে যাওয়ার এক দিন আগে গণভবনে। সেখানে সাংবাদিকরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কীভাবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের দমন করা যায়। কীভাবে তারা দেশকে ধ্বংস করছে, তার ভয়াল চিত্র তারা তুলে ধরেছিলেন। র্যাব-পুলিশ ঠিকমতো গুলি করতে পারছে না বলে তাদের আক্ষেপের শেষ ছিল না। সেদিন যারা গণভবনে উপস্থিত ছিলেন, হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের কয়েকজনও পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হয়েছেন। অনেকের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের কয়েকজন আছেন কারাগারে, আবার কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। সে সংখ্যা খুবই সামান্য।
গণভবনে পরামর্শ দিতে কিংবা প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে যারা যেতেন, তাদের অনেকে সাংবাদিকতা বাহিনীর জেনারেল হিসেবে একেকটি পত্রিকা ও টেলিভিশন স্টেশনে যে দাপট দেখাতেন, সেটি আর পারছেন না। এ নিয়ে তাদের ক্ষোভ, দুঃখ ও হতাশার শেষ নেই। কারণ তাদের মতে ড. ইউনূসের শাসনে দেশ এখন ক্রান্তিকালে আছে। এখনই করা যেত আসল সাংবাদিকতা-এখন আর প্রশংসা নয় প্রশ্নবাণে নিক্ষেপ করা যেত। কিন্তু তাদের আখ্যায়িত করা হচ্ছে নিপীড়ক সরকারের দোসর হিসেবে। তাদের দাবি, তারা তো দোসর নন, তারা শুধু সাংবাদিকতা করেছেন।
এখন যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় আপনারা যে প্রশংসার ডালি নিয়ে হাজির হতেন, সেটি কেমন সাংবাদিকতা ছিল? কিংবা আপনারা যে জনতার আন্দোলন দমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা কীভাবে সাংবাদিকতার অংশ ছিল? তারা বুক ফুলিয়ে বলবে অবশ্যই। আমরা তো সাংবাদিকতা করেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা তো মতামত দিতেই পারি। এটা ব্যক্তির স্বাধীনতা, একজন সাংবাদিকের মতপ্রকাশের অধিকার।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে এর বিপীতে আরো কিছু সাংবাদিক ছিলেন। ছিল কিছু সংবাদপত্র ও টেলিভিশন স্টেশন। হাসিনার পোষা সাংবাদিক বাহিনীর চোখে এরা সাংবাদিক হিসেবে গণ্য হতেন না। তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হয়েছিল। এভাবেই সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল, তখন আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? তাদের জবাব হচ্ছে, সাংবাদিকতা ও অ্যাক্টিভিজম তো এক হতে পারে না। এসব সংবাদমাধ্যম তো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করেনি, সীমালঙ্ঘন করেছে। তারা সাংবাদিকতা করেননি, অ্যাক্টিভিজম করেছেন। সরকারকে প্রশ্ন করা, নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরা, দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা ছিল তখন অ্যাক্টিভিজম। কিন্তু গণভবনে গিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যার উসকানি দেওয়া, গুম ও খুন নিয়ে প্রশ্ন না করে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেওয়া অ্যাক্টিভিজম নয়-এগুলো সাংবাদিকতা।
গত দেড় দশকে সরকারের নিপীড়নের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের সব ধরনের চেষ্টা করেছে এসব সাংবাদিক ও গণমাধ্যম। কিন্তু তাদের ফ্যাসিবাদের দোসর বলা যাবে না, এমনকি অ্যাক্টিভিস্টও বলা যাবে না। কারণ ফ্যাসিবাদী আমলে তারা যা করেছেন, তা ছিল সাংবাদিকের অধিকার। কিন্তু হাসিনার শাসনামলে যারা গুম, খুন নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারা সাংবাদিক ছিলেন না। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বড় পরিচয়। আসলে সাংবাদিকতার নামে নিপীড়কের সহযোগী শক্তি এখনো ঠিক করে দিতে চায় কারা সাংবাদিক এবং কারা সাংবাদিক নন।
শেখ হাসিনার সময় প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে অফিসে গিয়ে লাঞ্ছিত করে মাসের পর মাস কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। মাহমুদুর রহমানকে মাসের পর মাস রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়েছে। কয়েক বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। জয় হত্যাচেষ্টার ভুয়া অভিযোগে ৯০ বছর বয়সের সম্পাদক শফিক রেহমানকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের চোখে এরা কেউ সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় যদি কেউ আটক হন, ব্যাংকে শতকোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়, খুন ও গুমের পরামর্শ দেওয়ার জন্য যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়, তখন তা হয়ে উঠে সাংবাদিকের ওপর হয়রানি।
শেখ হাসিনার সাংবাদিক বাহিনীর সদস্যরা আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে চান। এখন তাদের লক্ষ্য হলো আওয়ামী লীগের হত্যার পক্ষে ন্যায্যতা প্রমাণ করা। শেখ হাসিনা হত্যাকাণ্ডের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করার জন্য এখন প্রায়ই বলে থাকেন, পুলিশ হত্যার বিচার হবে। তিনি আরো বলেন, দেশে ফিরে এসে প্রতিটি হত্যার বিচার করবেন। শেখ হাসিনার সুরে তার সাংবাদিক বাহিনীর সদস্যরা প্রশ্ন তুলছেন, ১৪০০ লোক যে মারা গেছে, তার কী কোনো প্রমাণ আছে? যুক্তি দেওয়া হচ্ছে শেখ হাসিনা কীভাবে একজন লোক হয়ে ১৪০০ লোক মারতে পারেন? অকাট্য যুক্তি বটে! শেখ হাসিনা নিজে হত্যা করেননি, তিনি ছিলেন হত্যার নির্দেশদাতা। এই সহজ সত্যটি তারা বলতে নারাজ। যেমন তারা এখন স্বীকার করেন না শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষকে নিপীড়ন ও পঙ্গু করার পক্ষে গণসম্মতির সঙ্গে এই সাংবাদিক বাহিনীর জেনারেল থেকে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট-সবাই ভূমিকা পালন করেছেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে চারটি বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা। দ্বিতীয়ত, মাওলানা সাঈদীর রায়ের পর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ড। প্রতিটি ঘটনায় আওয়ামীপন্থি সাংবাদিক বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ডের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা হয়েছে, রাষ্ট্রের স্বার্থে এসব হত্যাকাণ্ড জায়েজ ছিল-এই ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকে এখন বলছেন, তার চাকরির স্বার্থে এগুলো করেছেন। আবার টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রের মালিকরা বলছেন, সরকারের চাপে তারা এমন প্রচারণা চালিয়েছেন। গণমাধ্যমের মালিকদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে এমন বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েমের শুরু যেখান থেকে, সেই শাহবাগের আন্দোলনের সময় গণমাধ্যম কীভাবে নিজ উদ্যোগে শাহবাগ তৈরি করেছে, সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে প্রথমে ১৫ থেকে ২০ জন বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী শাহবাগে দাঁড়িয়েছিলেন। দ্রুত মিডিয়া বিষয়টি সামনে আনে। এরপর একটি একটি করে সব টেলিভিশন লাইভ সম্প্রচার করে। গণমাধ্যম যখন বিষয়টিকে ইস্যু তৈরি করে, পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এতে সম্পৃক্ত হয়। শাহবাগের আন্দোলনে অ্যাক্টিভিস্টদের চেয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই শাহবাগ থেকে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল। যার ওপর ভর করে হাসিনা তিনটি বিনাভোটের নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করেছিলেন।
হেফাজতের আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের এসব তথাকথিত পেশাদার গণমাধ্যমে গাছ কাটা ও কোরআন পোড়ানো ছিল প্রধান খবর। কিন্তু হেফাজতের হিসাবে সেদিন ৯৩ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন, সে খবর গুরুত্ব পায়নি। আমরা যদি সে সময়ের খবরগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে, কোনো সরকারি নির্দেশনা নয়, এসব গণমাধ্যম নিজ উদ্যোগে আলেম-ওলামাদের প্রতি ঘৃণা থেকে এভাবে খবর পরিবেশন করেছে। এখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছর না ঘুরতেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুলছেন, ১৪০০ লোক মারা যাওয়া তথ্য সঠিক কি না। এই সাংবাদিকরা এখন প্রশ্ন করার স্বাধীনতা চান। অবশ্যই সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার আছে। এমনকি ছাত্র অভ্যুত্থানে নিহতদের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে প্রশ্ন করা।
কিন্তু এই সাংবাদিকদেরও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তাদের বলতে হবে শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনে আপনি নিপীড়ন চালানোর পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন কি না? শেখ হাসিনা বা সরকারের কতজন মন্ত্রীকে আপনি গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন? যখন সংবাদপত্র বন্ধ করে তিনজন প্রবীণ সম্পাদককে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল, তখন আপনার ভূমিকা কী ছিল? সাংবাদিক শুধু প্রশ্ন করবেন কিন্তু সাংবাদিকরা প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন না, তা তো হতে পারে না। আপনার সাংবাদিক পরিচয় আছে বলে ফ্যাসিস্টের সহযোগীর ভূমিকা আড়াল হতে পারে না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ
alfaz@dailyamardesh.com
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন বছর অতিক্রান্ত হয়নি। এর মধ্যে ফ্যাসিবাদের সফট পাওয়ারগুলো সরব হয়ে উঠেছে।
১৯ ঘণ্টা আগেকবি ও গীতিকার কাইফি আজমি সিনেমার গান লেখার একটা অদ্ভুত পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে এই পদ্ধতির বেশ মিল আছে।
১৯ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ, যে দেশটির সঙ্গে তার সব প্রতিবেশীর সম্পর্ক তিক্ততায় ভরা। শুধু তা-ই নয়, ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার এমন একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে, যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হচ্ছে সংঘাতপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া।
২ দিন আগেফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গত মাসে দেওয়া এক ভাষণে হামাসের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংগঠনটির সদস্যদের ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দেন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ওই ভাষণে তিনি অবিলম্বে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণ করার এবং অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।
২ দিন আগে