চোরতন্ত্রের রাজনীতি: খালার পথে ভাগনি

আলফাজ আনাম
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ৫৯
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ২৫

শেখ মুজিবুর রহমানের পতনের পর লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিচরিত্রের বিবরণ দিতে গিয়ে লেখা হয়েছিল—‘নিজের পরিবারের লোকজনের আর্থিক স্বার্থ আদায়ের প্রতি তার নজর ছিল। তিনি নিজে ঘুষ নিয়েছিলেন কি না, এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক; কারণ তা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

বাংলাদেশের কাগজের নোটের ওপর তার ছবি ছাপা হয়েছিল। সবচেয়ে গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পদের সঙ্গে যেসব ব্যয়বহুল সুযোগ-সুবিধা সম্পৃক্ত সবই তার করায়ত্তে ছিল। তবে অনেকেই তার ছেলেদের ও অন্য আত্মীয়দের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন।’

বিজ্ঞাপন

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ৫০ বছর পরও তার পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্য ও তাদের উত্তরাধিকারদের মধ্যে আমরা একই চরিত্রের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। এমনকি তারা ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন পরিবেশে বিদেশ-বিভুঁইয়ে বেড়ে ওঠার পরও দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।

hasina-tulip

সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তার কন্যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি নীতি হিসাবে গ্রহণ করেন পিতার একদলীয় শাসনের পথ। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে যেভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল হিসেবে নেওয়া হয়েছিল, সেই একই কৌশল গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও একটি সার্বভৌম দেশকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করার দায় নিয়ে জনরোষে দেশ থেকে পালিয়ে যান।

শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ ডাইনেস্টির পতন হয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষের সামনে অপেক্ষা করছিল শেখ পরিবারের আরেকটি পতনের দৃশ্য। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের এক নাতনির রাজনৈতিক মৃত্যু হলো, যিনি ব্রিটেনের রাজনীতিতে বেশ ভালো জায়গা করে নিয়েছিলেন। তিনি লেবার পার্টি থেকে টানা চতুর্থবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সম্ভবত আর্থিক প্রভাব ও লবিংয়ের কারণে লেবার পার্টিতে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তিনি হয়ে ওঠেন শেখ পরিবার ও আওয়ামী রাজনীতির এক আইডল। তাকে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। নিয়তির নির্মম পরিহাস হলো দুর্নীতির দায়ে তাকে পদ ছাড়তে হয়েছে।

টিউলিপ সিদ্দিক তার খালার মতো এত বড় মাপের স্বৈরশাসক বা নেত্রী নন। কিন্তু শেখ ডাইনেস্টির যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য টিউলিপ সিদ্দিকের চরিত্রে পুরো মাত্রায় ফুটে উঠেছে, তা নিয়ে পশ্চিমা জগতে চলছে তোলপাড়।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ৭৭ বছর বয়সী শেখ হাসিনার ছবি ও খবর পশ্চিমা সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়েছিল নিকৃষ্ট এক ডিক্টেটর হিসাবে। গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল কীভাবে তিনি নির্মমভাবে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করতে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেখানে দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর ছয় মাস না যেতেই সেই ডিক্টেরের ৪২ বছর বয়সি ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের ছবি ও খবরও ফলাও করে প্রকাশ হচ্ছে।

ব্রিটেনের মন্ত্রী ও এমপি টিউলিপ দুর্নীতির মাধ্যমে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন। এমনকি তার ছোট বোন আজমিন সিদ্দিক রুপন্তির নামে একটি ফ্ল্যাট আছে, যে ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করতেন। অথচ ফ্ল্যাটটি পাওয়ার সময় তার বোনের কোনো দৃশ্যমান আয় ছিল না।

আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থপাচারকারীরা যে এসব ফ্ল্যাট তার ও তার বোনের নামে উপহার দিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি তার মা শেখ রেহানা বাংলাদেশে শীর্ষ অর্থপাচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলের দেওয়া ফ্ল্যাটে বাস করতেন। সালমান রহমান ছিলেন শেখ হাসিনার অলিগার্কদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন।

টিউলিপ সিদ্দিক বারবার বলে এসেছেন, খালার রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু তিনি ও তার বোন যার সুবাদে ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির সূত্রে তাদের উপহার দিয়েছেন। টিউলিপ যে তার খালার রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন, সেটি প্রথম গণমাধ্যমে আসে ২০১৩ সালে।

শেখ হাসিনার রাশিয়া ও বেলারুশ সফরের সময় সফরসঙ্গী ছিলেন টিউলিপ। সেখানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তার ছবি ব্রিটেনের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। এই সফরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সমাঝোতা হয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ খরচ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি ছিল।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে ৯টি বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তাতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের নাম আসে। ওই অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এখন ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমে টিউলিপ তার মা ও বোনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আর্থিক দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। লন্ডন ও দুবাইকেন্দ্রিক আওয়ামী মাফিয়াদের শক্তিশালী চক্র যে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত, তার বহু প্রমাণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।

tulip

এর আগে আল জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের লন্ডনে ও দুবাইয়ে বিপুল সম্পদের তথ্য প্রকাশ পায়। শুধু ব্রিটেনেই ৩৬০টি বাড়ির সন্ধান পায় আল জাজিরা। এছাড়া দুবাইয়ে তার ২৫০টির বেশি ফ্ল্যাট রয়েছে। লন্ডনে থাকা বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। সাইফুজ্জামান জাভেদ আল জাজিরাকে জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা দেশের বাইরে তার ব্যবসার কথা জানতেন। তিনি বলেন, আমার এখানে ব্যবসা আছে, সেটা তিনি জানতেন।

সাইফুজ্জামনের মতো আরও অনেক আওয়ামী মন্ত্রীর অর্থপাচারের তথ্য টিউলিপ কিংবা তার মা না জানার কোনো কারণ নেই। সালমান এফ রহমান কিংবা সাইফুজ্জামান জাভেদের উত্থান শেখ পরিবারের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব নয়।

টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, সেসব ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’ বা ‘হিমশৈলের চূড়া’ মাত্র। বাংলাদেশ থেকে শেখ পরিবারের অর্থ পাচারের আসল তথ্য হয়তো আগামী দিনে আরও প্রকাশিত হবে। টিউলিপ সিদ্দিক যে শুধু ব্রিটেনে সম্পদের মালিক হয়েছেন, এমন নয়, বাংলাদেশেও তার পরিবারের সদস্যরা একাধিক প্লটের মালিক হয়েছেন, যার মধ্যে তার ভাই ও বোন রয়েছেন।

শেখ রেহানার পরিবারের দুই কন্যা ও এক পুত্রের মধ্যে ব্রিটেনে অবস্থান করা দুই কন্যার অবৈধ সম্পদের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এখন তার পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির সম্পদের চিত্র প্রকাশের অপেক্ষা। ববি বাংলাদেশে রাজনীতিতে সরাসরি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। এটি ছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে গুজব তৈরির প্রধান ফ্যাক্টরি।

আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির আগে বিরোধী মত দমনের অপপ্রচার, গুজব ও ভুয়া খবর ছড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে সিআরআইয়ের বিরুদ্ধে। এই প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট ৫০টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও ৯৮টি পেজও বন্ধ করে দেয় মেটা। ফেসবুক বা মেটা তখন জানিয়েছিল, এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ ও সিআরআইয়ের সঙ্গে যুক্ত।

শেখ রেহানার পরিবারের আগে শেখ হাসিনার পুত্রের দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশনের বরাত দিয়ে সম্প্রতি নিউএজের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্ট বলছে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন।

এফবিআইয়ের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর হাসিনা ও জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল মার্কিন বিচার বিভাগের অপরাধ বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে এফবিআই প্রতিবেদনটি জমা দেয়। এফবিআই’র প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পেয়েছে দুদক।

দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা ও তার সন্তানরা শুধু এ দেশের মানুষের ওপর নিপীড়ন চালাননি, এ দেশ থেকে অর্থ পাচারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে তারা পঙ্গু করে দিয়েছেন। পুরো দেশকে তারা পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

এ দেশের মানুষকে শোষণ করে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন ছিল তাদের লক্ষ্য। ফলে হাসিনা ও রেহানার কোনো সন্তান দেশে বসবাস করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাদের শাসন পরিচালনার পদ্ধতি ছিল চোরতন্ত্র কায়েম করা, যাদের মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুট করে পাচার করা যাবে। কিন্তু চোরতন্ত্রের শেষ পরিণতি হয় বিপর্যয়কর। হাসিনার পর টিউলিপের রাজনৈতিক মৃত্যু তার প্রমাণ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত