ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা
শেক্সপিয়ার বেঁচে থাকলে আজ সম্ভবত তার উক্তি ‘নামে কী-বা আসে-যায়’ প্রত্যাহার করে নিতেন। নাম দিয়ে ব্যক্তির চরিত্র নির্ণয় করা না গেলেও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কে দিব্যি ধারণা করা যায়।
সে কারণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে কেন্দ্রকে এখন বলা হয় ‘সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র’, কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র’ প্রভৃতি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নাম বদলের সঙ্গে কাজ বদলের দৃশ্য না দেখে তিনি হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত হতেন। নাম বদলের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষ যতটা তৎপর ছিল, এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মানোন্নয়নে তাদের অনুরূপ তৎপরতা দেখা যায়নি। তাহলে কি শেক্সপিয়ারের কথাই সত্য হয়ে যায়?
কিন্তু যুক্তরাজ্যে চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তা ডেভিড ক্যারিকের ১২ নারীকে ধর্ষণসহ বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের যৌন অপরাধ সংঘটনের বিষয়কে যদি আমরা ‘নারী নির্যাতন’ হিসেবে আখ্যা দিতে চাই, সেটা কি যৌক্তিক হবে, নাকি ধর্ষণকে ধর্ষণ ও যৌন অপরাধকে যৌন অপরাধ আখ্যা দিলেই ডেভিডের কুকর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে? গোলাপকে যে নামেই ডাকুন, সুবাস সে ছড়াবেই। এটি যেমন ঠিক, তেমনি ধর্ষককে নির্যাতনকারী বললে সে কোন নির্যাতনের অপরাধে অপরাধী তা বুঝতে সাধারণ মানুষ যেমন ব্যর্থ হবে, তেমনি তার অপরাধের স্বরূপ নির্ণয়ে আদালত হবে দ্বিধাগ্রস্ত। যারা ধর্ষণকে নির্যাতনের ব্র্যাকেটে বন্দি করে স্বস্তি বোধ করতে চান, তারা সম্ভবত রাহেলার কথা ভুলে গেছেন। অবশ্য ২১ বছর আগের কথা। মনে রাখারই বা কারণ কোথায়? কিঞ্চিৎ মনে করিয়ে দেওয়া যাক রাহেলার কথা।
২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট। গার্মেন্টকর্মী রাহেলাকে গণধর্ষণের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএইচ হল-সংলগ্ন একটি এলাকায় ঝোপের আড়ালে ফেলে রেখে চলে যায় ধর্ষকেরা। যাওয়ার সময় কুপিয়ে তার স্পাইনাল কর্ড ভেঙে দিয়ে যায়। তিন দিন পর আবার তারা সেখানে এলে দেখতে পায়, রাহেলা তখনো মরেননি। খোলা আকাশের নিচে আহত-বিধ্বস্ত অবস্থায় তিন দিন ধরে পড়ে থাকা রাহেলারে মুখে এবার তারা দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যেন মারা যাওয়ার পর তার চেহারা চেনা না যায়। তারও অনেক পরে ঘাস কাটতে আসা কোনো এক স্থানীয় ব্যক্তি গোঙানি শুনে এভাবে পড়ে থাকা রাহেলাকে উদ্ধার করেন।
রাহেলা তখনো বেঁচে ছিলেন। থানা-পুলিশ-হাসপাতাল সবকিছু হলো। হাসপাতালে ৩৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মূল আসামি লিটনসহ সবার নাম বলা তিনি শেষ করেননি, ততক্ষণ তার মৃত্যু হয়নি। বিচার শুরু হয়, মূল আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়; কিন্তু সে অধরা রয়ে যায়। তার তিন সহযোগী ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে আদালত রায় দেওয়ার সময় জানিয়েছিল, তদন্ত কর্মকর্তা ভালোভাবে তদন্ত করলে মূল আসামিকে ধরা যেত। কিছুদিন পর অবশ্য সহ-আসামিরাও খালাস পেয়ে যায়। অর্থাৎ নিছক বোকার মতোই রাহেলা তাদের নাম বলার জন্য ৩৫ দিন কষ্ট সহ্য করে বেঁচে ছিলেন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত মোটামুটিভাবে রাহেলার কেসটি গণমাধ্যম ও অনলাইনে আলোচনায় ছিল। তারপর আমরা রাহেলাকে আলোচনার বিষয় থেকে বাদ দিয়েছি। এর মধ্যে আরো কত রাহেলা চলে গেছেন পৃথিবী থেকে, কোনোটিরই হিসাব আমাদের রাখার সুযোগ হয়নি। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে অপরাধের পরিসংখ্যানে নারী ও শিশু নির্যাতনের কথা বলা আছে। কী কী নির্যাতন, তা বলা নেই। ফলে জানা যায় না, আসলে কত শিশু ও কত নারী ধর্ষণের এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কিন্তু ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’, কিংবা ‘দণ্ডবিধি ১৮৬০’-এর অধ্যায় ১৬, ধারা ৩৭৫-এ একাধিকবার ধর্ষণকে ধর্ষণ হিসেবেই লেখা হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, এর পরও রাহেলাদের ধর্ষকদের বিচার হয় না। ২১ বছর চলে যায়। তাহলে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি কারো ‘অপছন্দের’ শব্দ হওয়ায় এর পরিবর্তে ‘নির্যাতন’ শব্দটি ব্যবহার করা হলে কি রাহেলাদের ‘নির্যাতনকারী’দের বিচার হবে—এ প্রশ্ন আইনের শিক্ষক ও বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টার কাছে রইল।
লিটনদের কেন ধরা যায়নি? কে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে আশ্রয় দিয়ে আইনের আওতার বাইরে রেখেছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যে আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। লিটনকে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন আশ্রয় দিয়েছে এবং শাস্তি থেকে বাঁচিয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এটা এজন্য সম্ভব হলো যে, বাংলাদেশে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। ধর্ষকের শাস্তির নামে যা হয় তা ধর্ষিতার সঙ্গে প্রহসন। মাত্র গুটিকয়েক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশে ধর্ষণের হার জিরোতে না এলেও উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসত—এ কথা বলার জন্যও আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমরা শুনতে পাই, ১৫ দিনে বিচার শুরু হবে, ৯০ দিনে বিচার শেষ হবে প্রভৃতি ঘোষণা। ধর্ষকের শাস্তি কার্যকর করার জন্য আসলেই কি ১৫ দিন থেকে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ধর্ষিতার পরিবার, তথা সাধারণ মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে? কেন রাহেলার ধর্ষণ মামলার বিচারককে বলতে হয়েছিল, তদন্ত কর্মকর্তা ভালোভাবে তদন্ত করলে লিটনকে খুঁজে পাওয়া যেত? প্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসমক্ষে কেন ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সেদিন সম্ভব হয়নি, আজও সম্ভব হচ্ছে না? আমাদের আইন-আদালত ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেননি বলেই আছিয়া তথা ‘মাগুরার সেই শিশুটির’ মতো শিশুদেরও ধর্ষণের শিকার হতে হয়।
শাস্তির মাত্র অল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে অনেককে শাস্তি দিতে হয় না। ধর্ষক কেন ধরা পড়ার পর বা বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর জেলের ভেতর বসে আরামে খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমের মাঝে দিন কাটাবে, যেখানে রাহেলা-আছিয়াদের পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি শুকায় না? সিঙ্গাপুরে কেমন করে রাত দুটোর সময় কোনো কিশোরী একাকী নির্ভয়ে হেঁটে যেতে পারে? সে দেশে কেমন করে আমেরিকান নাগরিককে অপরাধের জন্য জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করার শাস্তি কার্যকর হয়, যা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অনুরোধেও পরিবর্তনযোগ্য নয়? আমরা কেন এই সংস্কৃতি তৈরি করতে পারছি না যে, ধর্ষকের হয়ে কোনো উকিল লড়বেন না, ধর্ষকের মামলা নেওয়ার জন্যে কোনো আইনজীবী ও কর্মকর্তা- কর্মচারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না?
শব্দ শুনতে খারাপ লাগে কি ভালো লাগে, আমরা সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব—ধর্ষককে ধর্ষক বলব, নাকি নির্যাতনকারী বলব, নাকি জনসমক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করার মাধ্যমে আট বছরের শিশুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্বর ঘটনা যেন আর একটাও না ঘটতে না দিই, সে জন্য প্রতিজ্ঞা করব? রাহেলার ধর্ষকদের যদি ২০০৪ সালেই ফাঁসি কার্যকর হয়ে যেত, তা হলে আছিয়াকে এভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হতো না।
জেলখানার ভেতরে দিন কাটানোর সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে ধর্ষকের শাস্তি হয়েছে, এ কথা বলার সুযোগ নেই। জনসমক্ষে স্টেডিয়ামে সামাজিকভাবে তার ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আছিয়ার মতো আরো অনেক শিশুকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে। শাস্তির সংখ্যা বাড়ানোর মাঝে অপরাধ কমানোর সূত্র নিহিত থাকে না। কাজেই মামলা পরিচালনার গতি যতই ত্বরিত করার ঘোষণা হোক না, এতে ধর্ষণের কেসের সংখ্যা আর ধর্ষিতার সংখ্যাই কেবল বাড়বে। ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার ফর্মুলা এটা নয়। আমরা জানি, কোনো একটি অপরাধের ঘটনায় অপরাধী বিশিষ্ট পরিবারের সদস্য হওয়ায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে সহানুভূতি চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনা যদি আমার মেয়ে ফাতেমা ঘটাত, আমি তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিতাম। এ কারণেই তার সময়ে অপরাধ কমিয়ে আনা গিয়েছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের আইনকে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগের দৃঢ়তা রাখে কি? কার কোন শব্দ পছন্দ-অপছন্দ সে চিন্তায় সময় ব্যয় না করে ধর্ষণকে জনসমক্ষে ফাঁসিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সক্ষমতা রাখে কি?
অবশ্য ফাঁসির কথায় মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত কারো কারো পিলে চমকে ওঠারই কথা। এই পিলে চমকানোর খোরাক দেয় পশ্চিমা জগতের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সমাজব্যবস্থা, যেখানে স্ত্রীকে পেটানো থেকে শুরু করে ধর্ষণ—সবকিছুতেই নিজেরা তালিকার শীর্ষে অবস্থান করলেও অন্যদের ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে হুমকি দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ধর্ষণের সংখ্যায় সারা বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। কারণ সেখানে সামাজিক শাস্তির বিধান নেই। তাদের আছে যাবজ্জীবন কারাভোগের বিধান। যুক্তরাষ্ট্রের Sentencing Commission-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে যৌন নিপীড়নের অপরাধে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ অপরাধীর গড়ে ১৯১ মাস কারাবাসের রায় হয়েছে। কিন্তু কারাবাস যৌন নিপীড়নের অপরাধ কমাতে পারেনি মোটেও। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের সহায়তায় পরিচালিত ওয়েবসাইটে দেখা যায়, প্রতি পাঁচ নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হন। এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো কথা বলার অবস্থায়ই নেই। বাংলাদেশের ব্যাধির নিরাময় রয়েছে বাংলাদেশের উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করার মধ্যে। আমরা হয় ধর্ষককে সামাজিকভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব, অথবা রাহেলা-আছিয়াদের নির্মমভাবে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেব।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
শেক্সপিয়ার বেঁচে থাকলে আজ সম্ভবত তার উক্তি ‘নামে কী-বা আসে-যায়’ প্রত্যাহার করে নিতেন। নাম দিয়ে ব্যক্তির চরিত্র নির্ণয় করা না গেলেও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কে দিব্যি ধারণা করা যায়।
সে কারণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে কেন্দ্রকে এখন বলা হয় ‘সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র’, কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র’ প্রভৃতি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নাম বদলের সঙ্গে কাজ বদলের দৃশ্য না দেখে তিনি হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত হতেন। নাম বদলের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষ যতটা তৎপর ছিল, এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মানোন্নয়নে তাদের অনুরূপ তৎপরতা দেখা যায়নি। তাহলে কি শেক্সপিয়ারের কথাই সত্য হয়ে যায়?
কিন্তু যুক্তরাজ্যে চাকরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তা ডেভিড ক্যারিকের ১২ নারীকে ধর্ষণসহ বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের যৌন অপরাধ সংঘটনের বিষয়কে যদি আমরা ‘নারী নির্যাতন’ হিসেবে আখ্যা দিতে চাই, সেটা কি যৌক্তিক হবে, নাকি ধর্ষণকে ধর্ষণ ও যৌন অপরাধকে যৌন অপরাধ আখ্যা দিলেই ডেভিডের কুকর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে? গোলাপকে যে নামেই ডাকুন, সুবাস সে ছড়াবেই। এটি যেমন ঠিক, তেমনি ধর্ষককে নির্যাতনকারী বললে সে কোন নির্যাতনের অপরাধে অপরাধী তা বুঝতে সাধারণ মানুষ যেমন ব্যর্থ হবে, তেমনি তার অপরাধের স্বরূপ নির্ণয়ে আদালত হবে দ্বিধাগ্রস্ত। যারা ধর্ষণকে নির্যাতনের ব্র্যাকেটে বন্দি করে স্বস্তি বোধ করতে চান, তারা সম্ভবত রাহেলার কথা ভুলে গেছেন। অবশ্য ২১ বছর আগের কথা। মনে রাখারই বা কারণ কোথায়? কিঞ্চিৎ মনে করিয়ে দেওয়া যাক রাহেলার কথা।
২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট। গার্মেন্টকর্মী রাহেলাকে গণধর্ষণের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএইচ হল-সংলগ্ন একটি এলাকায় ঝোপের আড়ালে ফেলে রেখে চলে যায় ধর্ষকেরা। যাওয়ার সময় কুপিয়ে তার স্পাইনাল কর্ড ভেঙে দিয়ে যায়। তিন দিন পর আবার তারা সেখানে এলে দেখতে পায়, রাহেলা তখনো মরেননি। খোলা আকাশের নিচে আহত-বিধ্বস্ত অবস্থায় তিন দিন ধরে পড়ে থাকা রাহেলারে মুখে এবার তারা দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যেন মারা যাওয়ার পর তার চেহারা চেনা না যায়। তারও অনেক পরে ঘাস কাটতে আসা কোনো এক স্থানীয় ব্যক্তি গোঙানি শুনে এভাবে পড়ে থাকা রাহেলাকে উদ্ধার করেন।
রাহেলা তখনো বেঁচে ছিলেন। থানা-পুলিশ-হাসপাতাল সবকিছু হলো। হাসপাতালে ৩৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মূল আসামি লিটনসহ সবার নাম বলা তিনি শেষ করেননি, ততক্ষণ তার মৃত্যু হয়নি। বিচার শুরু হয়, মূল আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়; কিন্তু সে অধরা রয়ে যায়। তার তিন সহযোগী ধরা পড়ে। পরবর্তী সময়ে আদালত রায় দেওয়ার সময় জানিয়েছিল, তদন্ত কর্মকর্তা ভালোভাবে তদন্ত করলে মূল আসামিকে ধরা যেত। কিছুদিন পর অবশ্য সহ-আসামিরাও খালাস পেয়ে যায়। অর্থাৎ নিছক বোকার মতোই রাহেলা তাদের নাম বলার জন্য ৩৫ দিন কষ্ট সহ্য করে বেঁচে ছিলেন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত মোটামুটিভাবে রাহেলার কেসটি গণমাধ্যম ও অনলাইনে আলোচনায় ছিল। তারপর আমরা রাহেলাকে আলোচনার বিষয় থেকে বাদ দিয়েছি। এর মধ্যে আরো কত রাহেলা চলে গেছেন পৃথিবী থেকে, কোনোটিরই হিসাব আমাদের রাখার সুযোগ হয়নি। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে অপরাধের পরিসংখ্যানে নারী ও শিশু নির্যাতনের কথা বলা আছে। কী কী নির্যাতন, তা বলা নেই। ফলে জানা যায় না, আসলে কত শিশু ও কত নারী ধর্ষণের এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কিন্তু ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’, কিংবা ‘দণ্ডবিধি ১৮৬০’-এর অধ্যায় ১৬, ধারা ৩৭৫-এ একাধিকবার ধর্ষণকে ধর্ষণ হিসেবেই লেখা হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, এর পরও রাহেলাদের ধর্ষকদের বিচার হয় না। ২১ বছর চলে যায়। তাহলে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি কারো ‘অপছন্দের’ শব্দ হওয়ায় এর পরিবর্তে ‘নির্যাতন’ শব্দটি ব্যবহার করা হলে কি রাহেলাদের ‘নির্যাতনকারী’দের বিচার হবে—এ প্রশ্ন আইনের শিক্ষক ও বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টার কাছে রইল।
লিটনদের কেন ধরা যায়নি? কে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে আশ্রয় দিয়ে আইনের আওতার বাইরে রেখেছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যে আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। লিটনকে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন আশ্রয় দিয়েছে এবং শাস্তি থেকে বাঁচিয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এটা এজন্য সম্ভব হলো যে, বাংলাদেশে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। ধর্ষকের শাস্তির নামে যা হয় তা ধর্ষিতার সঙ্গে প্রহসন। মাত্র গুটিকয়েক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশে ধর্ষণের হার জিরোতে না এলেও উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসত—এ কথা বলার জন্যও আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমরা শুনতে পাই, ১৫ দিনে বিচার শুরু হবে, ৯০ দিনে বিচার শেষ হবে প্রভৃতি ঘোষণা। ধর্ষকের শাস্তি কার্যকর করার জন্য আসলেই কি ১৫ দিন থেকে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ধর্ষিতার পরিবার, তথা সাধারণ মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে? কেন রাহেলার ধর্ষণ মামলার বিচারককে বলতে হয়েছিল, তদন্ত কর্মকর্তা ভালোভাবে তদন্ত করলে লিটনকে খুঁজে পাওয়া যেত? প্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসমক্ষে কেন ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সেদিন সম্ভব হয়নি, আজও সম্ভব হচ্ছে না? আমাদের আইন-আদালত ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেননি বলেই আছিয়া তথা ‘মাগুরার সেই শিশুটির’ মতো শিশুদেরও ধর্ষণের শিকার হতে হয়।
শাস্তির মাত্র অল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে অনেককে শাস্তি দিতে হয় না। ধর্ষক কেন ধরা পড়ার পর বা বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর জেলের ভেতর বসে আরামে খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমের মাঝে দিন কাটাবে, যেখানে রাহেলা-আছিয়াদের পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি শুকায় না? সিঙ্গাপুরে কেমন করে রাত দুটোর সময় কোনো কিশোরী একাকী নির্ভয়ে হেঁটে যেতে পারে? সে দেশে কেমন করে আমেরিকান নাগরিককে অপরাধের জন্য জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করার শাস্তি কার্যকর হয়, যা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অনুরোধেও পরিবর্তনযোগ্য নয়? আমরা কেন এই সংস্কৃতি তৈরি করতে পারছি না যে, ধর্ষকের হয়ে কোনো উকিল লড়বেন না, ধর্ষকের মামলা নেওয়ার জন্যে কোনো আইনজীবী ও কর্মকর্তা- কর্মচারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না?
শব্দ শুনতে খারাপ লাগে কি ভালো লাগে, আমরা সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব—ধর্ষককে ধর্ষক বলব, নাকি নির্যাতনকারী বলব, নাকি জনসমক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করার মাধ্যমে আট বছরের শিশুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্বর ঘটনা যেন আর একটাও না ঘটতে না দিই, সে জন্য প্রতিজ্ঞা করব? রাহেলার ধর্ষকদের যদি ২০০৪ সালেই ফাঁসি কার্যকর হয়ে যেত, তা হলে আছিয়াকে এভাবে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হতো না।
জেলখানার ভেতরে দিন কাটানোর সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে ধর্ষকের শাস্তি হয়েছে, এ কথা বলার সুযোগ নেই। জনসমক্ষে স্টেডিয়ামে সামাজিকভাবে তার ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আছিয়ার মতো আরো অনেক শিশুকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে। শাস্তির সংখ্যা বাড়ানোর মাঝে অপরাধ কমানোর সূত্র নিহিত থাকে না। কাজেই মামলা পরিচালনার গতি যতই ত্বরিত করার ঘোষণা হোক না, এতে ধর্ষণের কেসের সংখ্যা আর ধর্ষিতার সংখ্যাই কেবল বাড়বে। ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার ফর্মুলা এটা নয়। আমরা জানি, কোনো একটি অপরাধের ঘটনায় অপরাধী বিশিষ্ট পরিবারের সদস্য হওয়ায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে সহানুভূতি চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনা যদি আমার মেয়ে ফাতেমা ঘটাত, আমি তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিতাম। এ কারণেই তার সময়ে অপরাধ কমিয়ে আনা গিয়েছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের আইনকে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগের দৃঢ়তা রাখে কি? কার কোন শব্দ পছন্দ-অপছন্দ সে চিন্তায় সময় ব্যয় না করে ধর্ষণকে জনসমক্ষে ফাঁসিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সক্ষমতা রাখে কি?
অবশ্য ফাঁসির কথায় মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত কারো কারো পিলে চমকে ওঠারই কথা। এই পিলে চমকানোর খোরাক দেয় পশ্চিমা জগতের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সমাজব্যবস্থা, যেখানে স্ত্রীকে পেটানো থেকে শুরু করে ধর্ষণ—সবকিছুতেই নিজেরা তালিকার শীর্ষে অবস্থান করলেও অন্যদের ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে হুমকি দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ধর্ষণের সংখ্যায় সারা বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। কারণ সেখানে সামাজিক শাস্তির বিধান নেই। তাদের আছে যাবজ্জীবন কারাভোগের বিধান। যুক্তরাষ্ট্রের Sentencing Commission-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে যৌন নিপীড়নের অপরাধে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ অপরাধীর গড়ে ১৯১ মাস কারাবাসের রায় হয়েছে। কিন্তু কারাবাস যৌন নিপীড়নের অপরাধ কমাতে পারেনি মোটেও। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের সহায়তায় পরিচালিত ওয়েবসাইটে দেখা যায়, প্রতি পাঁচ নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হন। এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো কথা বলার অবস্থায়ই নেই। বাংলাদেশের ব্যাধির নিরাময় রয়েছে বাংলাদেশের উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করার মধ্যে। আমরা হয় ধর্ষককে সামাজিকভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব, অথবা রাহেলা-আছিয়াদের নির্মমভাবে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেব।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে