আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

আগামী নির্বাচন ও গণতন্ত্রের উত্তরণ

দিলারা চৌধুরী

আগামী নির্বাচন ও গণতন্ত্রের উত্তরণ

১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি মানবিক, সাম্যভিত্তিক, ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল। যেখানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, আইনের শাসন কাজ করবে এবং একটি শক্তিশালী তৃণমূলভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছরের পথচলায় বারবারই এই স্বপ্ন ব্যাহত হয়েছে। বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী শাসন অথবা সরাসরি সামরিক শাসন দ্বারা। এই শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশের সিংহভাগ জনসাধারণ চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্র শব্দটি বারবার উচ্চারিত হলেও বাস্তবতায় কখনো এর বাস্তবায়ন দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনগণের ইচ্ছা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাবে নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা হারিয়েছে। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলতার মধ্যে জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা। গণঅভ্যুত্থানের শক্তি ছিল তৃণমূলের মানুষের ক্ষোভ, বঞ্চনা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও জেঁকে থাকা জনবিরোধী এলিট শ্রেণির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নতুন রাষ্ট্রের কাঠামো প্রস্তুত করা।

অভ্যুত্থানের ফলে যে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে সেখানে পুরোনো কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, স্বৈরশাসনের প্রভাব, দুর্নীতি দূরীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারের দ্বারা একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রয়োজন। তবে তা কেবল একটি নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে সম্ভব নয় বরং এটি ধারাবাহিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুনর্গঠন এবং দায়িত্বশীল আচরণের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

তবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। নির্বাচন এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ভোটাররা নিশ্চিন্ত মনে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোট দিতে পারে, কোনো ভয়, জবরদস্তি বা অনিয়ম ছাড়াÑএমন নির্বাচন কেবল ভোট প্রদান নয়, একটি নাগরিক অধিকার, নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও রাষ্ট্রের বৈধতার উৎস।

কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে নির্বাচন ঘিরে জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ এবং অকার্যকরতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে। সুতরাং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রথম পদক্ষেপ হবে একটি সুষ্ঠু, মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করা। এমন নির্বাচন আয়োজন করার জন্য এখানে বহুবিধ প্রতিষ্ঠানের দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তত পাঁচটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান অপরিহার্যÑ নিরপেক্ষ সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ প্রশাসন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা।

এসব প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্তম্ভ এবং এগুলো সঠিকভাবে কার্যকর হলে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়। তবে বাস্তবতা হলো গত একযুগের বেশি সময় ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল করা হয়েছে। ফলে এখন প্রয়োজন গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য হলো রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ। নির্বাচনি অঙ্গন সহিংসতামুক্ত রাখার জন্য দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি প্রয়োজন হবে একটি অবাধ স্বাধীন গণমাধ্যম। এ ক্ষেত্রে সবার আগে আসে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রসঙ্গ। কারণ কমিশন নির্বাচনের নিয়ম, আচরণবিধি, প্রার্থী বাছাই, ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার দায়িত্ব পালন করে। সংবিধানের ৬৫-৭৩ অনুচ্ছেদ ও ১৯৭২-এর রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপলস অর্ডার অনুযায়ী এগুলো নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের সংস্কার কমিশনের জুলাই চার্টারে প্রস্তাবিত অনেক সংস্কার প্রস্তাবই নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করেছে যা ২০২৬ সালের নির্বাচনকে পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর তুলনায় ভিন্ন ও অধিকতর কাঠামোগত রূপান্তর করেছে বলে মনে হয়। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উপেক্ষিত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ স্বাধীন কনস্টিটুয়েন্সি ডিলিমিটেশন কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। অথচ নির্বাচনি এলাকার জনসংখ্যার অনুপাত, ভৌগোলিক বাস্তবতা রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে সুষ্ঠু সীমা নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি। ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে নির্বাচন ফলাফল প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে এটি একটি সংবেদনশীল বিষয়। এটিকে গ্রহণ করলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা আরো বেশি দৃঢ় হতো।

ঠিক তেমনি ‘না ভোট’ বা রিকল ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিত হয়েছে। রিকল ব্যবস্থা থাকলে জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তাকে প্রত্যাহার করতে পারে যা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিমূলক আচরণে বাধ্য করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো রিকল বা ‘না ভোট’ ব্যবস্থাকে সমর্থন না করায় একে জুলাই চার্টারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাছাড়া পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনা, রাতের ভোট ইত্যাদি নানা বিতর্কের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করার যে প্রস্তাব ছিল সেটিও গৃহীত হয়নি। এছাড়া যদিও নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি প্রচারণার আচরণবিধি, ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ এবং প্রার্থীর হলফনামা বাধ্যতামূলক করার মতো কিছু সংস্কার গ্রহণ করেছে। তবু বড় প্রশ্ন হলো কমিশন কি নির্বাচনকে কালো টাকা, পেশিশক্তি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে পারবে?

ঢাকার বিলবোর্ডগুলোর একতরফা অগ্রিম বুকিং থেকে শুরু করে প্রার্থীর মনোনয়ন বাণিজ্যÑএসব গভীরভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকের সঙ্গে জড়িত। কেবল আইন দ্বারা এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ অর্থনৈতিক শক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের প্রভাব আইনকে অনেক ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন কালো টাকার প্রভাব বন্ধ করতে পারবে কিনা সে সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেছে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, নির্বাচনে টাকার খেলা চলছে। তফসিল ঘোষণার আগেই যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে তার কোনো লাগাম টেনে ধরতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। কোনো পলিটিক্যাল পার্টির অডিট রিপোর্ট জমা নেওয়া হয়নি। এসব কারণে ইতোমধ্যেই যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে মোকাবিলা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।

এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতা খুব বড় ভূমিকা রাখে। তৃণমূল থেকে প্রার্থী নির্বাচন, দায়িত্বশীল আচরণ, সহিংসতা পরিহার এবং প্রচারণায় কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ এসব রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে। নির্বাচন কমিশন যতই নিয়ম করুক রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতান্ত্রিক আচরণ না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কখনোই তৈরি হবে না।

গণতন্ত্রের উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে হচ্ছে। কারণ তারা একে অপরের প্রতি নির্বাচন-পূর্ববর্তী যে ধরনের আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করছে তা নির্বাচনি অঙ্গনকে সহিংস করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস থেকে কেন্দ্র দখলের মতো মারাত্মক প্রবণতা জন্ম নিতে পারে। এছাড়া পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী যারা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তারাও এই নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। সীমান্ত থেকে অবাধে অস্ত্র প্রবাহ, জেল থেকে মুক্ত হওয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যক্রম এবং বিদেশ থেকে নাশকতামূলক কার্যক্রমের আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

এই আশঙ্কা গভীর হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরীফ ওসমান হাদির উপর গত ২২ তারিখে হামলার মধ্য দিয়ে। এটি একটি অশনি সংকেত। সারা দেশে সম্ভাব্য গুপ্ত হামলার যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে তাতে যে শুধু প্রার্থীদের প্রচারণা ব্যাহত হবে তাই নয়, এই শঙ্কায় ভোটার উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

এস আলমদের মতো অলিগার্কদের অবাধ টাকার বিস্তার রোধ করার তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রশাসনও একইভাবে দলীয়করণের শিকার। ডিসি, রিটার্নিং অফিসার ও পুলিশের ভূমিকা যে কোনো নির্বাচনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতার অভাব, দলীয় আনুগত্য এবং প্রশাসনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক জটিলতার কারণে অনেক সময় নিষ্ক্রিয় থাকে। সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কারের জন্য যে খসড়া প্রস্তুত করেছিল সে অনুসারে সংস্কার হলেও পুলিশের ভূমিকা আগের মতোই থাকবে।

এক্ষেত্রে পুলিশকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত করতে পুলিশ আইন ১৮৬১-এর আইনগত কিছু পরিবর্তন করা জরুরি ছিল, যা হয়নি। এটা নিয়ে পুলিশ কমিশনসহ বিভিন্ন স্তরে বেশ আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেভাবে আইনটির সংশোধন হয়নি। এখনো তাকিয়ে থাকতে হবে রাজনৈতিক সরকারের দিকে। যদি রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা থাকে তবে পুলিশ বাহিনী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে এর বাইরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং পুলিশ যেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চেয়েছিল সেটি হচ্ছে না। পুলিশের অপসংস্কৃতি রয়েই যাবে। যারাই ক্ষমতায় যাবে তারাই পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তাদের ব্যবহার করবে। জনগণ পুলিশের বন্ধু আর হয়ে হয়ে উঠতে পারবে না।

গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল যুগে সংবাদ, লাইভ কাভারেজ, সামাজিক মাধ্যমের পোস্টÑ সবই ভোটারদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে। কিন্তু গণমাধ্যম যদি কোনো সংস্থার প্রভাবাধীন হয় তবে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না। বিশেষ করে এক্সিট পোল রিপোর্টটি ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই এটিকে স্বাধীন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

জনগণের ধারণা, এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যমকে কেন্দ্র করে যে নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে তাও মোকাবিলা করতে হবে। ভুয়া তথ্য, ভুয়া ভিডিও, অনলাইন প্রোপাগান্ডা ও বিদেশি শক্তির সাইবার হামলা মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ প্রযুক্তি সেল দরকার। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো কতটা শক্তিশালী সে বিষয়ে আমরা এখনো অনিশ্চিত।

তবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য শুধু একদিনের একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। নির্বাচিত সরকারের চ্যালেঞ্জ হবে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।

বাংলাদেশ একটি ক্লাসিক্যাল পোস্ট কলোনিয়াল রাষ্ট্র। এখানে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে যে জাতীয় আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ছিল সেগুলো সব সময় জনগণের বিরুদ্ধেই কাজ করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যেখানে কলোনিয়াল স্টেটগুলো স্বাধীন হয়েছে তারা পরবর্তী পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চার দ্বারা এই জাতীয় আইন ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, অথবা সাংবিধানিক ও রাজনীতির চর্চার দ্বারা তারা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটিয়েছে।

সুতরাং বাংলাদেশে যদি আমরা গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে চাই তাহলে আমাদের সংস্কারগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং আইন বদলাতে হবে। সেই লক্ষে সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো গ্রহণ করা হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম যাতে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন অথবা যারা আহত হয়েছেন অথবা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়িত হবে।

সুতরাং নতুন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষে এই সংস্কারগুলো শুধু কাঠামোগত আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নয়। এই পরিবর্তনের ফলে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হবে তা জনগণের স্বার্থে কাজ করবে। পোস্ট কলোনিয়াল প্রতিষ্ঠানে যারা শক্তিশালী ছিল জনগণের তুলনায় তাদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসবে।

কাজেই নতুন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের রূপান্তরের অন্যতম প্রধান এবং প্রথম শর্ত হবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অতীতের গুম, খুন, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিচার নিশ্চিত করা। বিচারহীনতা ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাকে উসকে দেয়। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যাতে আর না ফিরে আসতে পারে তা নিশ্চিত করাই জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ছিল। দার্শনিক জন লক অথবা রুশো যে সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের কথা বলেছেন সে অনুসারে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা নেয় তাদের প্রধান দায়িত্ব হলো মানুষের জীবন, সম্পদ এবং স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা। এছাড়া বাংলাদেশের পোস্ট কলোনিয়াল (post colonial) রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও কাঠামো ইত্যাদির পরিবর্তন করে আইনের শাসন, সুশাসন ও নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে, অযোগ্যতা ইত্যাদি বদলে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত প্রজাতন্ত্র বা জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে।

রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে বিচারহীনতা অন্যতম প্রধান কারণ। কাজেই গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য প্রধান কাজ হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে তা দূরীভূত করা। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের সবাইকে বিচার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে আমরা দেখেছি, সামরিক শাসনের সময় ভীষণভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল এবং পরবর্তী পর্যায়ে যখন সেই সরকারগুলোর পতন ঘটল তখন তাদের প্রধান কাজই ছিল এই মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা।

অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারকার্য সাফল্যজনকভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বহুল প্রত্যাশিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। একটি অধ্যাদেশের দ্বারা তারা বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করেছে। নির্বাচিত সরকারের উচিত হবে, যে বিচারকার্যগুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে সেগুলো সম্পন্ন করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

মানবাধিকারের অংশ হিসেবে মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের সুযোগ এবং সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা রক্ষা করা অপরিহার্য। এর উপর আছে মৌলিক অধিকার যা রাষ্ট্রের সামাজিক দায়বদ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু।

গণতন্ত্র কী অবস্থায় আছে তা নির্ভর করবে অধিকতর অর্থে এই সমস্ত স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কিনা তার উপর। এছাড়া নতুন বাংলাদেশে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রধান অঙ্গীকার।

এজন্য সাংবিধানিক সংস্কারকে যথার্থ রূপ দেওয়া অপরিহার্য। যে সরকারই আসুক না কেন সেই সরকারের উপর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সংস্কার কমিশনের আলোচনা চলাকালে রাজনৈতিক দলগুলো কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মতভিন্নতা প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এমন কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে যা ক্ষমতার ভারসাম্য দুর্বল করতে পারে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার জন্য সাংবিধানিক কাউন্সিলের মতো পর্ষদ অত্যন্ত জরুরি ছিল। এ ক্ষেত্রেও নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের নির্বাচন ও উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ আছে। বিএনপির মতো বড় দল উচ্চকক্ষ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। যদিও তারা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে, কিন্তু এমনভাবে এটা গঠিত হচ্ছে যেখানে কার্যত নিম্ন কক্ষের উপরে উচ্চকক্ষের নজরদারি আর থাকছে না। ইতালিসহ বহু দেশে ইউনিটারি গভমেন্ট থাকা সত্ত্বেও উচ্চকক্ষে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন রয়েছে যেখানে নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় সে সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত।

ফলে উচ্চকক্ষের মূল উদ্দেশ্যÑ আইন পর্যালোচনা, বিল আটকে রেখে জনমত সৃষ্টি ইত্যাদি কার্যকরভাবে পূরণ হবে বলে মনে হয় না। এছাড়া সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পুনর্বণ্টনও উদ্বেগজনক। প্রেসিডেন্ট যদি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হন তবে সেই ক্ষমতার খুব একটা মূল্য নেই। একটি নির্বাচিত কলেজের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলে সেটা গ্রহণযুক্ত হতো। কিন্তু নির্বাচিত না হয়ে ক্ষমতা পেলে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীই নির্ধারণ করবেন তিনি ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করবেন। এতে পদটির রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

অপরদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে প্রকৃত সংস্কার না হলে গণতান্ত্রিক রূপান্তর দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আগেই বলা হয়েছে, পুলিশের উপরে সরকার প্রভাব কমাতে যে কমিশন করার কথা তা পুরোপুরি স্বাধীন হতে হবে, যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তা স্বাধীনভাবে গঠন করা হয়নি। দুদকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও সুপারিশকৃত বাছাই এবং পর্যালোচনামূলক কাঠামো কার্যকর হয়নি।

সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচিত সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যানেল হবে ভঙ্গুর অর্থনীতির পুনর্গঠন। খেলাপি ঋণের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে তাদের স্থানীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা উচিত। আমরা আশা করেছিলাম ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এই কাজটি করে যাবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। নির্বাচিত সরকারকে এ কাজটি আঞ্জাম দিতে হবে।

দুর্নীতি নতুন বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটা এমন একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে, বাংলাদেশের জিডিপির ২-৩ শতাংশ এই দুর্নীতির জন্য নষ্ট হয়। এই দুর্নীতির জন্যই ইনস্টিটিউশন ও প্রতিষ্ঠানগুলো সাংবিধানিক কার্যগুলো যথাযথভাবে করতে পারে না। এক্ষেত্রে দুদকের সংস্কার কাজ সঠিকভাবে শেষ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

দেশের তরুণরা বেকার। বিদেশে গিয়ে তারা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখলেও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করেছে। দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও সমান সুযোগের পরিবেশ অর্থনৈতিক উন্নতির অপরিহার্য।

আরেকটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তা হচ্ছে দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ। গণঅভ্যুত্থানের পরেও এক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করিনি। এটা হতাশাজনক। নারীর সংখ্যা দেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন ও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে কোনো সংস্কারই অর্থবহ হবে না এবং গণতন্ত্রের উত্তরণও সম্ভব হবে না।

পরিশেষে যেটা বলা জরুরি তা হলো গণতন্ত্র উত্তরণে বা পুরোনো ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরিত করার যে সংকট দেখা দিয়েছে তা বাংলাদেশে গণতন্ত্রে উত্তরণে প্রধান বাধা হয়ে উঠতে পারে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য দরকার গণভোট এবং সেই সনদের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু গণভোট ও নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে প্রচারের অভাব ও দুটি ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান প্রক্রিয়ায় ভোটাররা বিভ্রান্ত হতে পারে। এছাড়া যদি জুলাই সনদের অধীনে নির্বাচন না হয়ে ১৯৭২-এর সংবিধানের দ্বারা সংগঠিত হয় তবে বিজয়ীদল দাবি করতে পারে যে যেহেতু সেই সংবিধানে গণভোট নেই সেহেতু গণভোটের ফলাফল মাত্রা না মানা তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেমন বহুবিদ কঠিন বাধার সম্মুখীন তেমনি গণতন্ত্রের উত্তরণও বাংলাদেশের একটি সমষ্টিগত প্রচেষ্টা।

লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন