আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

এক বছরেই যেভাবে আলোচনার কেন্দ্রে

ফিনিক্স পাখির মতো আমার দেশ-এর নতুন উন্মেষ

জাহেদ চৌধুরী

ফিনিক্স পাখির মতো আমার দেশ-এর নতুন উন্মেষ

গণমানুষের কণ্ঠস্বর আমার দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলে আমার দেশ। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের পক্ষে আমার দেশ। ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করে আমার দেশ। ভারতীয় হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আমার দেশ। আমার দেশ-এর লড়াই দুই দশকের। তিন দফায় কারাবরণকারী মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির সাড়া জাগানো রিপোর্ট আর আওয়ামী দুঃশাসন ও ভারতের আগ্রাসনবাদী নীতির বিরুদ্ধে দুরন্ত সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বারবার ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখে পড়েছে আমার দেশ। হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার দুদফায় বন্ধ করে দেয় পত্রিকাটি। তারও আগে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় কারারুদ্ধ তৎকালীন মালিকদের পক্ষ থেকে লে-অফ করে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল পত্রিকাটি। কিন্তু বারবার ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকে জেগে উঠেছে আমার দেশ। দুই দশকে পত্রিকাটি প্রায় এক যুগই আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু তাতে কি? একদল অদম্য সংবাদকর্মী আর মাহমুদুর রহমানের মতো অসীম সাহসী সম্পাদকের নেতৃত্বাধীন পত্রিকাকে ঠেকিয়ে রাখে কে? ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমার দেশকেও মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলার সুযোগ এনে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার দুঃশাসনে অন্যতম টার্গেট ছিল আমার দেশ। ভারতের ইন্ধনে হাসিনা সরকার আরো বেশি আক্রোশে ফেটে পড়েছিল আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে।

হাসিনার আক্রোশের কারণও ছিল। শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি আর ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে আমার দেশ যে দুঃসাহসী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। আর এ কারণেই আওয়ামী হায়েনারা বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার দেশ সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ওপর। জ্বালিয়ে ছাইভস্ম করে দেয় অফিস। গায়ের জোরে তালাবদ্ধ করা হয় ছাপাখানা। পুলিশ প্রহরায় প্রেস তালাবদ্ধ রেখে লুটেরা আওয়ামী লীগ লুটে নেয় প্রেসের সব মালামাল। পেশিশক্তির উন্মত্ততার পাশাপাশি সারা দেশে চলে সিরিজ মামলা।

শুধুমাত্র সত্য লেখার অপরাধে একজন সম্পাদকের প্রাণনাশের চেষ্টা, কারানির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা বিশ্বে নজিরবিহীন। কুষ্টিয়ার আদালত অঙ্গনে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাচেষ্টায় রক্তাক্ত করা হয় মাহমুদুর রহমানকে। কেবলমাত্র আমার দেশ-এ চাকরি করার ‘অপরাধে’ এর সংবাদকর্মীদের সব যোগ্যতা থাকার পরও ফিরিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মিডিয়ার দুয়ার থেকে। সিনিয়র সাংবাদিকদের কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়। এক যুগ কোথাও চাকরি করতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী সরকার।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে আমার দেশ। ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী মইন-ফখরুদ্দীনের শাসনে ২০০৮ সালে চরম ক্রান্তিকালে আমার দেশ-এর দায়িত্ব নেন অকুতোভয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম আঘাত হানে পত্রিকাটির ওপর।

হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুর্নীতি নিয়ে তৎকালীন বিশেষ প্রতিনিধি এম আবদুল্লাহর আলোচিত রিপোর্টের জেরে হামলে পড়ে সম্পাদক, সাংবাদিক ও পত্রিকার ওপর। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রতিবেদক এম আবদুল্লাহর গাড়িতে বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটে। সারা দেশে সিরিজ মামলা করানো হয় দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে।

কমান্ডো স্টাইলে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে ৩৯ দিন রিমান্ডে রেখে চলে নির্যাতন। আয়নাঘরে চলে হত্যাচেষ্টা। বন্ধ করা হয় পত্রিকার প্রকাশনা। পত্রিকাটি যাতে কোনোভাবেই প্রকাশ না হয়, সেজন্য বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, প্রধান সহকারী সম্পাদক প্রয়াত সঞ্জিব চৌধুরী, ক্রাইম রিপোর্টার আলাউদ্দিন আরিফ, অফিস সহকারী সাইফুল ইসলামসহ ছয় সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা হিসেবে ৪০০ সাংবাদিকের নামে ঢালাও মামলা দেওয়া হয়। অভিযোগ আনা হয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারে পুলিশকে বাধা দেওয়ার। মাহমুদুর রহমানকে আটকের পর আইনগতভাবে তাকে যখন জেলে আটকে রাখা যাচ্ছিল না, তখন বিচার বিভাগ নিয়ে সম্পাদকের একটি মন্তব্য প্রতিবেদন ও ‘চেম্বার মানে সরকারপক্ষে স্টে’—এ প্রতিবেদনের জন্য আপিল বিভাগের সুয়োমোটো রুল ও রায়ে সাত মাস জেলে আটকে রাখা হয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। একই মামলায় সিনিয়র সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকেও সাত মাস কারাবরণ করতে হয়।

Zahed-Chowdhury-Amar-Desh

সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রথম দফায় ৯ মাস জেল খেটে আইনি লড়াইয়ে মুক্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে তার নেতৃত্বে ফের পাঠক সমাদৃত হয় আমার দেশ। কিন্তু থামেনি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন।

২০১২ সাল। শাহবাগে তখন চেতনার মাতম আর চরম উন্মাদনা। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আমার দেশ আলোচিত সেই ব্যানার হেডিং করে ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। অল্প দিনের মধ্যেই আমার দেশে সাড়া জাগানো স্কাইপ কেলেংকারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ধারাবাহিকভাবে। অলিউল্লাহ নোমানের লেখা ওই প্রতিবেদনে তোলপাড় শুরু হয় দেশ-বিদেশে। উন্মোচিত হয় জুড়িশিয়াল কিলিংয়ের নীলনকশা। এতে আওয়ামী সরকার বেসামাল হয়ে আবার হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশ ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচান সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান।

সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে প্রথমে কয়েক মাস বন্দি করে রাখা হয় পত্রিকা অফিসে। ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল পুলিশের পোশাকাধারী ক্যাডাররা ভোরে আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে মাহমুদুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায় কমান্ডো কায়দায়। এবার আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে প্রেসে তালা লাগিয়ে দ্বিতীয় দফায় আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার পর থেকে প্রায় ১২ বছর আলোর মুখ দেখেনি পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা সংবাদপত্র আমার দেশ।

দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে দীর্ঘ সময় নির্যাতন ও সাড়ে তিন বছর দুঃসহ জেলজীবন কাটিয়ে ২০১৬ সালে আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হন মাহমুদুর রহমান। কিন্তু হুমকির মুখে পড়ে তার জীবন। কুষ্টিয়ার আদালতে জামিন চাইতে গেলে চেষ্টা করা হয় প্রাণনাশের। রক্তাক্ত অবস্থায় দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দেন—স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে একাই জীবন দেবেন, তবু দিল্লির দাসদের কাছে নতিস্বীকার করবেন না।

এতে ভারতের মদতে শেখ হাসিনার হয়রানি ও নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। রাতের পর রাত বাসায় পুলিশি হানা ও হয়রানি চলতে থাকে। চলে জীবননাশের বিভিন্ন চেষ্টা। এমন অবস্থায় অসুস্থ মাহমুদুর রহমান উন্নত চিকিৎসা করার জন্য দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেননি। প্রথমে মালয়েশিয়ায় এবং পরে তুরস্কে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় তাকে।

ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় জুলাই বিপ্লবে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে টানা ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষে মুক্ত-স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন মাহমুদুর রহমান। শেখ হাসনিার দেওয়া ১২৪ মামলা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আইনকে সম্মান দেখিয়ে আদালতে হাজির হয়ে তৃতীয়বারের মতো জেলে যান তিনি।

জেল থেকে মুক্তি পেয়েই জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ঘোষণা দেন নতুন করে আমার দেশ পত্রিকা চালুর।

মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশ আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দিলেও সেখানে লোহার স্ক্র্যাপ ও কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু মেলেনি। আওয়ামী দুর্বৃত্তরা লুটে নিয়ে যায় সব মালামাল।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে আবার ডানা মেলে আমার দেশ।

এক যুগ পর রক্তস্নাত জুলাই বিপ্লবের বছর চব্বিশের ২২ ডিসেম্বর মাহমুদুর রহমানের সম্পাদনায় ‘স্বাধীনতার কথা বলে’ স্লোগান নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হয় আমার দেশ। নব উদ্দীপনায় নতুন করে স্বপ্ন বুনছে আমার দেশের মজলুম কর্মিবাহিনী।

নতুন অফিসে নতুন উদ্যমে একঝাঁক দুরন্ত সাহসী সংবাদকর্মী আবারও কর্মমুখর হয়ে ওঠেন। এই কর্মিবাহিনীর হাত ধরেই মাহমদুর রহমানের আমার দেশ আবার ফিরে আসে পাঠকের হাতে।

এবার শুধু প্রিন্ট নয়, সঙ্গে অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়া—তিন সেকশনেই আমার দেশ গত এক বছরে দেশে নতুন করে আলোড়ন তোলে।

গতকাল পর্যন্ত পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাল্টিমিডিয়ার নিউজ চ্যানেলে আমার দেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রিন্টে মূলধারার পত্রিকার মধ্যে আমার দেশ-এর অবস্থান দ্বিতীয়। কম পাতার একটি পত্রিকা ধরলে তৃতীয় আর অনলাইনেও আমাদের উপরে মাত্র তিনটি জাতীয় দৈনিকের অবস্থান।

মাত্র এক বছরের মধ্যে এত সীমিতসংখ্যক স্টাফ নিয়ে আমার দেশ-এর উত্থানের পেছনে আমাদের আন্তরিক একঝাঁক পরিশ্রমী সংবাদকর্মী এবং আমাদের বিপুলসংখ্যক পাঠক-শ্রোতার অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সবার উপরে আমাদের সম্পাদকীয় নীতি, যেটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, ভারতীয় আধিপত্যবাদসহ সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, ইসলামি মূল্যাবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত সাহসী এক নীতি। আর নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের যিনি নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সেই সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি সাংবাদিকতায় এখন ফুলটাইম দিচ্ছেন এবং জীবনের লাস্ট ইনিংস হিসেবে এটিকে গ্রহণ করেছেন।

পাঠক-দর্শকরা জানেন মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে দেশে ফেরেন। তখন আমার দেশ-এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সম্পাদক-প্রকাশক ছিলেন না, প্রেস ছিল না, অফিস ছিল না। মায়ের অসুস্থতার কারণে মাহমুদুর রহমান অনেকটা আকস্মিকভাবেই দেশে আসেন কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। বিমানবন্দরে তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও আমার দেশ-এর সহকর্মীরা বিশাল সমাবেশ করে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান তাকে। তারপর স্বৈরাচারের মিথ্যা মামলায় মাহমুদুর রহমানকে পাঁচদিন জেল খাটতে হয়। সম্পাদক হিসেবে তৃতীয় দফায় কারাভোগের পর মুক্ত হয়েই জাতীয় প্রেস ক্লাবে হাজির হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। ঘোষণা দেন দুই মাসের মধ্যে আবার আমার দেশ বের করার। সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নিয়োগ ২০০৯ সালেই আটকে দিয়েছিল হাসিনা সরকার। সেজন্য এতদিন মাহমুদুর রহমান ছিলেন আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও সাবেক প্রকাশক হাসমত আলীই ছিলেন প্রকাশক। ডিসি অফিসে নতুন করে আবেদন করে মাহমুদুর রহমানকে প্রকাশক (তথা মালিক) ও সম্পাদক করার প্রক্রিয়া শুর হয় হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে। বাদসাধে এসবি। মাহমুদুর রহমান তিনটি সাজানো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তারা ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছিল না। কিন্তু আইনে নৈতিক স্খলনের অপরাধ ছাড়া ডিক্লারেশন আটকানোর কোনো সুযোগ ছিল না। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আইনসংগতভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অবশেষে আমার দেশ-এর ডিক্লারেশন দেন মাহমুদুর রহমানের নামে।

শুরু হয় অফিস খোঁজার পালা। অবশেষে আগের অফিসের পাশেই ৯৯, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজারের ঢাকা ট্রেড সেন্টারের অষ্টম ফ্লোরে ঠিকানা হয় আমার দেশ-এর।

নতুন অফিস নেওয়ার পরপরই অফিস স্পেসে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আমার দেশ-এর সাবেক সহকর্মীরা হাজির হন মধ্যাহ্নভোজে। সবাই জানিয়ে দেন তারা মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আছেন আমার দেশ-এর নবযাত্রায়। নতুন করে শুরুর জন্য সাবেক প্রায় অর্ধেক কর্মী পেয়ে যায় আমার দেশ। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে বাকি লোকজনও জোগাড় করা হয়। সাহস করে ছোট আকারে মাল্টিমিডিয়া ও অনলাইন টিমও দাঁড় করানো হয়।

বন্ধ প্রেস খুলে দেখা যায়, স্বৈরাচারের দোসররা সব লুটে নিয়েছে। ভাড়ায় নতুন প্রেসও ঠিক করা হয়। নিউজপ্রিন্টের জোগাড়ও চলে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও লেখকদের লেখা সংগ্রহের কাজও চলে। কিন্তু বাদসাধে অফিস। কারণ, কোনোভাবেই অফিস ডেকোরেশন গুছিয়ে আনা যাচ্ছিল না। মাত্র একটি রুমে ক্যাম্প অফিস বসিয়ে আমরা ৪৮ পৃষ্ঠার একটি এবং ৩২ পৃষ্ঠার তিনটি বিশেষ উদ্বোধনী ক্রোড়পত্র গুছিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করি। সফলও হই। নির্ধারিত দিনে ২২ ডিসেম্বর আমার দেশ নিয়মিত ১৬ পৃষ্ঠার পাশাপাশি ৪৮ পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্রসহ পাঠকের হাতে আমরা তুলে দিতে সক্ষম হই। এবার আমার দেশ-এর নতুন করে পথচলার বর্ষপূর্তিতে নিয়মিত ১৬ পৃষ্ঠার সঙ্গে আজ প্রথম দিনে আরো ২৪ পৃষ্ঠা এবং কাল ও পরশু দুদিনের প্রতিদিন ১৬ পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে।

ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভস্ম থেকে আবার পুনর্জন্ম লাভ করে আমার দেশ। দেশের গণমানুষের পত্রিকা আমার দেশ গত এক বছর থেকে পাঠকের হাতে হাতে, মানুষের মুখে মুখে। গণমানুষের এ ভালোবাসা নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

বাংলাদেশে সাহসী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক অনন্য নাম এখন আমার দেশ। নবযাত্রার এক বছরে পত্রিকাটি পাঠকের মন জয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। একই সঙ্গে গণমাধ্যম জগতেও সৃষ্টি করেছে তুমুল আলোড়ন। বিশেষ করে পত্রিকার প্রতিদিনের সাড়া জাগানো ‘লিড নিউজ’ পাঠকের কাছে খবরের হটকেক বা বাড়তি এক আকর্ষণ।

সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে পুনঃপ্রকাশের প্রথম দিনেই দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে আমার দেশ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালানো, বিগত সাড়ে ১৫ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতি, টাকা পাচার, গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনীতি ধ্বংস ও ব্যাংকিং সেক্টরের লুটপাটসহ অপশাসনের বিষয়গুলো এক বছর ধরে ‍ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছে আমার দেশ। পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে পত্রিকাটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ, সংবিধান সংশোধন এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের ওপর জোরালো রিপোর্ট করে যাচ্ছে। দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য, ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষা, আলেমসমাজকে গুরুত্ব দেওয়া এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলার ব্যাপারেও পত্রিকাটি সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

আমার দেশ ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি ই-ভার্সন, অনলাইন পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুকের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও ভালো করছে। এসব প্ল্যাটফর্মে পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত সংবাদ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। শুধু সংবাদই নয়; খেলাধুলা, বিনোদন, শিক্ষা, সাহিত্য ও জীবনযাপন-বিষয়ক বিভিন্ন পাতা নানা বয়সি পাঠককে আকর্ষণ করছে। পত্রিকাটিতে দেশের স্বনামধন্য লেখক, গবেষক এবং একঝাঁক মেধাবী তরুণ সাংবাদিক কাজ করছেন, যে কারণে সংবাদ ও লেখার গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করছে। আমার দেশ বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী ও জনপ্রিয় পত্রিকা হওয়ার পেছনে রয়েছে পত্রিকাটির নির্ভরযোগ্য সাংবাদিকতা।

এছাড়া পত্রিকার সত্যনিষ্ঠ সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও পত্রিকাটি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ। তার প্রতি বুধবারের মন্তব্য প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয়। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনই পত্রিকাটিকে পাঠকের আস্থা অর্জন করতে সাহায্য করেছে। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সামাজিক অনিয়মের বিরুদ্ধে আমার দেশ-এর সাহসী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো পত্রিকাটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে।

খবরের ক্ষেত্রে শুধু লিড নিউজই নয়, আমার দেশ-এর ধারাবাহিক সিরিজ রিপোর্টও পাঠকপ্রিয়তা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে। এসব রিপোর্টের মধ্যে রয়েছে—জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন, আওয়ামী শাসনামলে আলেম নিপীড়ন, ঢাকাসহ জেলায় জেলায় রাজনৈতিক নিপীড়ন, ৩০০ আসনের নির্বাচনি চিত্র এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর রিপোর্ট। আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন শীর্ষক ৪০টি রিপোর্ট আলেমসমাজের প্রশংসা পায়। তেমনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের নামে লাখ লাখ মামলা, গুম, খুন ও গায়েবি মামলার বিষয়গুলো পত্রিকায় তুলে ধরা হলে তা সাড়ে ১৫ বছরের অত্যাচারের নিষ্ঠুর বিবরণের চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ইস্তানবুল থেকে দেশে ফিরেই ঘোষণা দেন—আমার দেশ বের করা হবে। দীর্ঘ ১১ বছর বন্ধ থাকার পর মাত্র দুই মাসের প্রস্তুতিতে দেশব্যাপী পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া হয় পত্রিকাটি।

পত্রিকা প্রকাশের আগে রিপোর্টিং টিমকে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, পত্রিকার প্রথম দিন বা উদ্বোধনী সংখ্যায় এমন একটি লিড নিউজ থাকবে, যা পাঠকদের আলোড়িত করবে। প্রথম দিনের লিড নিউজের শিরোনাম ছিল ‘দিল্লিকে ঢাকা অ্যাটাক করতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা’। ওই রিপোর্ট সেদিন দেশব্যাপী ছিল একটি আলোচিত রিপোর্ট। শুধু দেশেই নয়, বিদেশে বাংলাভাষী পাঠকদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগায় রিপোর্টটি। পাঠকরা কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে সেদিন আমার দেশ সংগ্রহ করেন। ঢাকার অনেক পাঠক প্রথম দিন রাতে আমার দেশ-এর প্রেসে গিয়েও ভিড় জমান পত্রিকা হাতে পেতে। ইউটিউব চ্যানেলে লিড নিউজটির ভিউ হয় ৩৭ লাখ। প্রথম পাতায় জুলাই শহীদদের ছবি নিয়েও একটি রিপোর্ট করা হয়। এভাবে নবযাত্রার প্রথম দিনেই আমার দেশ সারা দেশে বাজিমাত করে।

নবযাত্রার এক বছরে আমার দেশ ৩৫০টিরও বেশি লিড নিউজ করেছে। এসব লিড নিউজ গণমাধ্যম জগতে যেমন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ পাঠককেও অভিভূত করে। আজকের পত্রিকা পাঠ করে পাঠকরা আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন কী লিড নিউজ আসে আমার দেশ-এ, সেটা পড়ার জন্য। আগেই বলেছি, শেখ হাসিনার পলায়নের অজানা কথা দিয়ে পত্রিকার লিড নিউজ শুরু হয়। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের বড় বড় কেলেঙ্কারি, গুম, গণহত্যা, চাঞ্চল্যকর ঘটনা, টাকা পাচার, ব্যাংক লুট ইত্যাদি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় রিপোর্টের মূল বিষয়। রিপোর্টারদের একটি ‘ভাইব্র্যান্ট টিম’ বা দক্ষ ও উৎসাহী দল লিড নিউজগুলো পত্রিকার জন্য তুলে আনেন।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আমার দেশ-এর ই-ভার্সন বা ই-পেপার, অনলাইন পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ রয়েছে। নিউজ পোর্টালটি মাত্র এক বছরে ৪ নম্বর অবস্থানে চলে এসেছে। আমার দেশ-এর ফেসবুক পেজের ভিউ প্রতি মাসে প্রায় ৪০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুকের ফলোয়ার এক বছরে ১৪ লাখে পৌঁছেছে। ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ১৫ লাখ ছাড়িয়েছে কয়েক দিন আগেই। পত্রিকার উদ্বোধনী দিনে আমার দেশ-এর লিড নিউজ ছিল ‘দিল্লিকে ঢাকা অ্যাটাক করতে বলেছিলেন হাসিনা’। ইউটিউব চ্যানেলে ওই নিউজটি তামান্না মিনহাজ পড়ে শোনালে এর ভিউ হয় প্রায় ৩৭ লাখ। এছাড়া সাড়া জাগানো অন্তত ৩২টি রিপোর্টের প্রতিটির ভিউ হয়েছে এক মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ লাখের বেশি। গত এক মাসে ইউটিউবের ভিউ দাঁড়ায় প্রায় ৬ কোটি। আর আমার দেশ-এর ওয়েবসাইটে মাসিক ভিউ প্রায় ১০ কোটি।

নবযাত্রায় পথচলার এক বছর পার করায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এজন্য আমরা শুকরিয়া আদায় করছি। আমার দেশকে নিয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, গত এক বছরে আমরা তার কতটা পূরণ করতে পেরেছি—দেশের মানুষ, আমাদের পাঠক ও দর্শকরা তা মূল্যায়ন করবেন।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, আমার দেশ

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন