কে এম মোবারক উল্ল্যাহ শিমুল
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিজিট ভিসার নামে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।কাগজে কলমে তারা যাচ্ছেন ঘুরতে, আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে কিংবা ব্যবসায়িক সফরে। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই যাচ্ছেন চাকরির আশায়, প্রবেশ করছেন বিদেশি শ্রমবাজারে অবৈধভাবে, আইন ভেঙে,জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এর পেছনে কাজ করছে এক অদৃশ্য, অথচ সুসংগঠিত পাচার সিন্ডিকেট, যা বর্তমানে পরিচিত ‘গ্রেটওয়ে পাচার চক্র’ নামে।
এই পাচার চক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট। সরকারের নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, নিয়ন্ত্রণহীন এয়ারপোর্ট ব্যবস্থাপনা এবং আত্মীয়স্বজন নির্ভর অসচেতন নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে এই চক্রটি এখন এক ধরনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
গ্রেটওয়ে সিন্ডিকেটের লাভের মূল উৎস হলো শ্রমিকদের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব ও নিরুপায় আশা। এই চক্র যেসব দেশে মানুষ পাঠায় তার মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, মিশর এবং লিবিয়া সহ তাদের পছন্দের দেশে। সেখান থেকে আবার এক গোপন সড়ক দিয়ে ইউরোপে পৌঁছে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়। প্রতিটি ধাপে থাকে ঘুষ, জাল কাগজপত্র, মানবপাচারকারী এবং কখনো কখনো প্রাণ হারানো কর্মী।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বাস্তবতা হলো আত্মীয়-স্বজননির্ভর পাচার কাঠামোর উত্থান এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয় দুর্নীতিবান্ধব একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। এই চক্র মূলত ভিজিট ভিসাধারীদের মধ্য থেকে শ্রমিক চিহ্নিত করে তাদের 'প্যাকেজ চুক্তি’র আওতায় দ্রুত বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। প্রকৃত ভিজিটরদের নানা অজুহাতে হয়রানি করা হলেও, ভিজিট ভিসার আড়ালে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে এই সিন্ডিকেট জামাই আদরে লাস্ট বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত বিদায় জানায়। সংশ্লিষ্ট কিছু অফিসার, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং স্টাফ ও ট্রাভেল চক্র মিলে একটি সমন্বিত চুক্তিভিত্তিক প্রক্রিয়ায় এই পাচার কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নভাবে পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘ বছর থেকে।
পাচারকারীরা এখন রিক্রুটিং এজেন্সির ভূমিকাও বাদ দিয়ে সরাসরি আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করছে। একজন সরলপ্রাণ মানুষ, যিনি প্রিয়জনের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পান, তিনি কখনোই সন্দেহ করেন না যে তাকে এক ভয়ঙ্কর অপরাধের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে।
এখানে BMET (ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং)-এর দীর্ঘসূত্রতা এক বড় সমস্যা। বিদেশি নিয়োগদাতারা সাধারণত এক মাসের মধ্যে কর্মী প্রত্যাশা করেন। অথচ BMET-এর নিয়মে একজন কর্মীকে পাঠাতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। দূতাবাস সত্যায়নের নামে হয়রানি, অপ্রয়োজনীয় ট্রেনিং, মেডিকেল পরীক্ষার ধাপ, অতিরিক্ত কাগজপত্র যাচাই, নিয়োগ অনুমতি ও বহির্গমন ছাড়পত্র সংগ্রহ, এই পুরো প্রক্রিয়া হয়ে পড়ে ধীর, ব্যয়বহুল ও অনুৎসাহজনক। এতে রিক্রুটিং এজেন্সি সময়মতো কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হয় এবং নিয়োগকর্তারা আগ্রহ হারায়। তখনই বিকল্প শর্টকাট হিসেবে সামনে আসে গ্রেটওয়ে সিন্ডিকেট।
এই টাইম ফ্রেম সংকট পাচারকারীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তারা সময় বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে কর্মীদের চোরাপথে পাঠায়, পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজ নিজেদের দখলে রাখে। যারা আইনি পথে যেতে চায়, তারাই বেশি বিপাকে পড়ে। অথচ যারা শর্টকাটে যাচ্ছে, তারাই পাচারকারীর চোখে 'সফল গ্রাহক'।
ভবিষ্যতের জন্য আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, রিসিভিং কান্ট্রির কিছু ইমিগ্রেশন অফিসার ও এই সিন্ডিকেটের শেকড় বিস্তার লাভ করেছে। যথাযথ ঘুষ দিলে ভিজিট ভিসাকে কাজের ভিসায় রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। অনেক সময় অবৈধ কর্মীদের দেশে ফেরত না পাঠিয়ে চাকরি করার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি এই পরিস্থিতিকে মৌন সম্মতি দেয়, তাহলে তা হবে মানবপাচারকে রাষ্ট্রীয় উৎসাহ দেওয়ার নামান্তর, যা ভয়াবহ আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
অভিবাসন বিষয়টি শুধু অর্থনীতির নয়, এটি জাতীয় মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। ভিজিট ভিসার আড়ালে মানবপাচার বন্ধ করতে হলে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আনতে হবে কৌশলগত সংস্কার। বৈধ অভিবাসনকে জনপ্রিয় করতে হলে তা সহজ, দ্রুত এবং বাস্তবতাভিত্তিক করতে হবে, যাতে অবৈধ পথ প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়।
প্রস্তাবনা
লেখক: জনশক্তি খাত বিশ্লেষক
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিজিট ভিসার নামে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।কাগজে কলমে তারা যাচ্ছেন ঘুরতে, আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে কিংবা ব্যবসায়িক সফরে। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেকেই যাচ্ছেন চাকরির আশায়, প্রবেশ করছেন বিদেশি শ্রমবাজারে অবৈধভাবে, আইন ভেঙে,জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এর পেছনে কাজ করছে এক অদৃশ্য, অথচ সুসংগঠিত পাচার সিন্ডিকেট, যা বর্তমানে পরিচিত ‘গ্রেটওয়ে পাচার চক্র’ নামে।
এই পাচার চক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট। সরকারের নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, নিয়ন্ত্রণহীন এয়ারপোর্ট ব্যবস্থাপনা এবং আত্মীয়স্বজন নির্ভর অসচেতন নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে এই চক্রটি এখন এক ধরনের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
গ্রেটওয়ে সিন্ডিকেটের লাভের মূল উৎস হলো শ্রমিকদের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব ও নিরুপায় আশা। এই চক্র যেসব দেশে মানুষ পাঠায় তার মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, মিশর এবং লিবিয়া সহ তাদের পছন্দের দেশে। সেখান থেকে আবার এক গোপন সড়ক দিয়ে ইউরোপে পৌঁছে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়। প্রতিটি ধাপে থাকে ঘুষ, জাল কাগজপত্র, মানবপাচারকারী এবং কখনো কখনো প্রাণ হারানো কর্মী।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বাস্তবতা হলো আত্মীয়-স্বজননির্ভর পাচার কাঠামোর উত্থান এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয় দুর্নীতিবান্ধব একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। এই চক্র মূলত ভিজিট ভিসাধারীদের মধ্য থেকে শ্রমিক চিহ্নিত করে তাদের 'প্যাকেজ চুক্তি’র আওতায় দ্রুত বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। প্রকৃত ভিজিটরদের নানা অজুহাতে হয়রানি করা হলেও, ভিজিট ভিসার আড়ালে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে এই সিন্ডিকেট জামাই আদরে লাস্ট বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত বিদায় জানায়। সংশ্লিষ্ট কিছু অফিসার, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং স্টাফ ও ট্রাভেল চক্র মিলে একটি সমন্বিত চুক্তিভিত্তিক প্রক্রিয়ায় এই পাচার কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নভাবে পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘ বছর থেকে।
পাচারকারীরা এখন রিক্রুটিং এজেন্সির ভূমিকাও বাদ দিয়ে সরাসরি আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করছে। একজন সরলপ্রাণ মানুষ, যিনি প্রিয়জনের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পান, তিনি কখনোই সন্দেহ করেন না যে তাকে এক ভয়ঙ্কর অপরাধের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে।
এখানে BMET (ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং)-এর দীর্ঘসূত্রতা এক বড় সমস্যা। বিদেশি নিয়োগদাতারা সাধারণত এক মাসের মধ্যে কর্মী প্রত্যাশা করেন। অথচ BMET-এর নিয়মে একজন কর্মীকে পাঠাতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। দূতাবাস সত্যায়নের নামে হয়রানি, অপ্রয়োজনীয় ট্রেনিং, মেডিকেল পরীক্ষার ধাপ, অতিরিক্ত কাগজপত্র যাচাই, নিয়োগ অনুমতি ও বহির্গমন ছাড়পত্র সংগ্রহ, এই পুরো প্রক্রিয়া হয়ে পড়ে ধীর, ব্যয়বহুল ও অনুৎসাহজনক। এতে রিক্রুটিং এজেন্সি সময়মতো কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হয় এবং নিয়োগকর্তারা আগ্রহ হারায়। তখনই বিকল্প শর্টকাট হিসেবে সামনে আসে গ্রেটওয়ে সিন্ডিকেট।
এই টাইম ফ্রেম সংকট পাচারকারীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তারা সময় বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে কর্মীদের চোরাপথে পাঠায়, পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজ নিজেদের দখলে রাখে। যারা আইনি পথে যেতে চায়, তারাই বেশি বিপাকে পড়ে। অথচ যারা শর্টকাটে যাচ্ছে, তারাই পাচারকারীর চোখে 'সফল গ্রাহক'।
ভবিষ্যতের জন্য আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, রিসিভিং কান্ট্রির কিছু ইমিগ্রেশন অফিসার ও এই সিন্ডিকেটের শেকড় বিস্তার লাভ করেছে। যথাযথ ঘুষ দিলে ভিজিট ভিসাকে কাজের ভিসায় রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। অনেক সময় অবৈধ কর্মীদের দেশে ফেরত না পাঠিয়ে চাকরি করার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি এই পরিস্থিতিকে মৌন সম্মতি দেয়, তাহলে তা হবে মানবপাচারকে রাষ্ট্রীয় উৎসাহ দেওয়ার নামান্তর, যা ভয়াবহ আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
অভিবাসন বিষয়টি শুধু অর্থনীতির নয়, এটি জাতীয় মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। ভিজিট ভিসার আড়ালে মানবপাচার বন্ধ করতে হলে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আনতে হবে কৌশলগত সংস্কার। বৈধ অভিবাসনকে জনপ্রিয় করতে হলে তা সহজ, দ্রুত এবং বাস্তবতাভিত্তিক করতে হবে, যাতে অবৈধ পথ প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়।
প্রস্তাবনা
লেখক: জনশক্তি খাত বিশ্লেষক
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১১ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে