আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ক্ষমা করবেন ম্যাডাম

মাহমুদুর রহমান

ক্ষমা করবেন ম্যাডাম

বাংলাদেশের শেষ জননন্দিত নেতা আজ আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৯ সালে। শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে তিনি তখন বিরোধী দলের নেত্রী আর আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চাকরি করার ফাঁকে বিএনপি-সমর্থক প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (অ্যাব) সঙ্গে সবে যুক্ত হয়েছি। আমার ধানমন্ডি অফিসে প্রায়ই জাতীয়তাবাদী প্রকৌশলীদের মিটিং বসতো। সংগঠনের তখনকার সভাপতি ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ার এবং সাবেক মন্ত্রী এল কে সিদ্দিকী।

অনেকটা হঠাৎ করেই একদিন মিন্টো রোডের বিরোধী দলের নেতার সরকারি বাসভবনে এক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলাম। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের শেষে বিদায়বেলায় সিদ্দিকী ভাই বললেন, ‘মাহমুদ, ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হয়েছে?’ আমি ‘হয়নি’ বলতেই তিনি আমার হাত ধরে ম্যাডামের অফিসে নিয়ে গিয়ে আমার লেখাপড়া, চাকরি, রাজনৈতিক আদর্শ প্রভৃতি বিষয়ে বর্ণনা দিলেন। ম্যাডামের সৌজন্যে মুগ্ধ হয়ে সে রাতে বাসায় ফিরেছিলাম।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাওয়া ভবনে। সেবার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন অ্যাবের বর্তমান সভাপতি এবং ম্যাডামের বড় বোনের ছেলে প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম তুহিন। তার কিছুদিন আগে সরকারি দলের নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে ইউক্রেনের জনগণের অরেঞ্জ রেভোলিউশনে ক্ষমতাসীনদের পতন হয়েছিল। শেখ হাসিনাও আসন্ন নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টা করতে পারেন, সেই ধারণা থেকেই কারচুপি আটকানোর জন্য কী কী করা যেতে পারে, তার ওপর কয়েক পাতার একটা ‘পেপার’ কয়েক দিন খেটেখুটে তৈরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রস্তাবনা নিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। একজন অরাজনৈতিক পেশাজীবীর রাজনৈতিক বিষয়ে উৎসাহ দেখে ম্যাডাম খুব খুশি হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে দিনকাল অফিসে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।

২০০১ সালের নভেম্বরে তৃতীয় সাক্ষাৎকারের জন্য আমি একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। সেদিন বিকালে আমার ধানমন্ডি অফিসে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে হারিছ চৌধুরী আমার সেল ফোনে জানালেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে তখনই দেখা করতে বলেছেন। এর আগে আমি হারিছ চৌধুরীকে কোনোদিন দেখিনি। আমি সেখানে গেলে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে দেখতে পেলাম। তারা অন্য বিষয়ে আলাপ করছিলেন। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর ম্যাডাম আমাকে সরাসরি বিনিয়োগ বোর্ড যাকে আমরা এখন বিডা নামে চিনি, সেখানে নির্বাহী চেয়ারম্যানের পদে যোগ দিতে বললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি আমতা আমতা করে বললাম, তখনকার সময়ের তুলনায় আমার বেশ উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে অতি সামান্য সরকারি বেতনে সংসার চালাতে কষ্ট হবে। আমি সভয়ে এটাও বললাম, ২০০১ সালের নির্ধারিত সরকারি বেতনের তিনগুণ আমি তার বছর দশেক আগে পেতাম। প্রত্যুত্তরে ম্যাডাম যা বললেন, তাতে আমার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। আজও মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন, শহীদ জিয়া বলতেন, দেশের খাতিরে কিছু মানুষকে স্যাক্রিফাইস করতে হয় এবং ম্যাডাম আমার কাছে সেই স্যাক্রিফাইস চাচ্ছেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, আমার ছোট সংসারে মাও অধ্যাপনা করে কিছু টাকা রোজগার করছেন এবং স্ত্রী দেশের প্রখ্যাত শিল্পপতির কন্যা। পাশ থেকে খসরু ভাই যোগ করলেন, ‘মাহমুদকে আমি চট্টগ্রাম থেকে চিনি। সে নিশ্চয়ই রাজি হবে।’ আমি চট্টগ্রামে ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সে ডিরেক্টরের চাকরি করার সময় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি এবং স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। যৌথ আক্রমণের সামনে আমার আর কোনো উপায় রইল না। পরে জেনেছি, তারেক রহমানও আমার নিয়োগে ভূমিকা রেখেছিলেন। তার এক বগুড়ার বন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার ডা. ফিরোজ আমাকে ‘বড় ভাই’ সম্বোধন করতেন। সে আমাকে এসব কথা জানিয়েছিল।

শুরু হলো ম্যাডামের সঙ্গে আমার দীর্ঘ পথচলা। পাঁচ বছরের সরকারি দায়িত্ব পালনকালে তিনি সর্বদা ঢাল হয়ে আমাকে রক্ষা করেছেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি বেগম জিয়ার ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় ও আপসহীন লড়াইয়ের অন্যতম সাক্ষী। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রামে ম্যাডামের সমর্থন আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমিও তার বিশ্বাস ও আস্থার মর্যাদা রাখতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। প্রতিদানে যে স্নেহ পেয়েছি তার কোনো তুলনা হয় না। আমার দীর্ঘ জেলজীবনেও তিনি সর্বদা আমার পরিবারের পাশে থেকেছেন। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৮ সালের পর থেকে আমার সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। দলটির নতুন নীতিনির্ধারকদের কাছে আমার রাজনীতি ইসলামপন্থি, হঠকারী এবং অযৌক্তিকভাবে ভারতবিরোধী বিবেচিত হয়। আমাকে নানাভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপি বলয়ের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী বৃত্তে আমার যুক্ত না থাকাই উত্তম। কুষ্টিয়ার আদালতে আক্রান্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হওয়ার পর সেই দূরত্ব ক্রমেই অনতিক্রম্য বাধায় পরিণত হয়।

মহান জুলাই বিপ্লবের পর সেপ্টেম্বরের শেষে দেশে ফিরে ম্যাডামের সঙ্গে আমার দেখা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মোসাদ্দেক আলী ফালুর সহায়তায় মাত্র একবারের জন্য ম্যাডামের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাই। সেদিন ঘণ্টাখানেক ম্যাডামের সান্নিধ্যে ছিলাম। পুরোনো দিনের গল্প করেছি। তার স্নেহের কোনো পরিবর্তন ছিল না। গল্প করার সময় বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম কোকোর স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ম্যাডাম শেষবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী ম্যাডামের সঙ্গে একবার দেখা করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। আমার সহকর্মী বাছির জামালের ফোনে আমি বেগম জিয়ার একান্ত সচিব আবদুস সাত্তারকে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমাকে তারিখ ও সময় জানাবেন। কিন্তু আবদুস সাত্তার আমার কিংবা বাছির জামালের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেননি। বেগম জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হলে আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, সেখানে আমার তাকে দেখতে যাওয়াটা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মনঃপূত হবে কি না। শেষ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করলে সহকর্মী আবদাল আহমদকে নিয়ে ২১ ডিসেম্বর আমি ম্যাডামকে এভারকেয়ার হাসপাতালে দেখতে যেতে পেরেছিলাম। সেখানে উপস্থিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং পেশাজীবী আন্দোলনে আমার এক সময়ের সাথি ডা. জাহিদ আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত সদয় আচরণ করেছেন। ম্যাডামের অসুস্থতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। তাকে অশেষ ধন্যবাদ।

তুরস্ক থেকে দেশে ফেরার পর শারীরিক কারণে ঘরে আবদ্ধ ম্যাডামের সঙ্গে যতটা সময় কাটানো কিংবা খোঁজখবর রাখা উচিত ছিল, সেটা পরিস্থিতির কারণে আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। হয়তো এই ব্যর্থতা আমারই। ম্যাডাম, আমাকে ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে এই মহীয়সী এবং সংগ্রামী নারীর জন্য উত্তম পুরস্কারের আকুল ফরিয়াদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশে আর একজন শহীদ জিয়া যেমন আসেননি, তেমনই আর একজন খালেদা জিয়া সম্ভবত আসবেন না। আমাদের প্রজন্মের সৌভাগ্য, আমরা এই অসাধারণ দম্পতির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন এবং নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে অনবরত চর্চা করে যেতে হবে। অনন্ত জীবনে আল্লাহ যেন তাদের সৎ কর্মের প্রতিদান দেন।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন