ফরিদা পারভীন: লালনকন্যা থেকে লোকসংগীতের কিংবদন্তি

কামরুননেসা হাসান
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ১৬

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল এক ঐতিহাসিক ফোক ফেস্টিভ্যাল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর নবীন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের সময়ে আয়োজিত এই উৎসব শুধু লোকসংগীতের বৈচিত্র্যকেই সামনে নিয়ে আসেনি, বরং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক নতুন দিকনির্দেশনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।সেদিন সারা দেশ থেকে আসা শিল্পীরা নিজেদের আঞ্চলিক সংগীতের সুরে-তালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

সেই ফোক ফেস্টিভ্যালে কুষ্টিয়ার লালন আখড়া থেকে এসেছিলেন মরমি গানের বিখ্যাত সাধক মোকশেদ আলী শাই। তার সঙ্গে ছিলেন এক কিশোরী শিষ্যা। মঞ্চে যখন তরুণীটির আবির্ভাব হলো, তখন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মনে এক অদ্ভুত শিহরন জাগল। তার কণ্ঠে লালনগীতি যেন নতুন প্রাণ পেয়েছিল, যেন যুগ-যুগান্তরের সাধনা সেই কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। সেই কিশোরীই পরে সীমানা ভেদ করে খ্যাতি অর্জন করেন ‘লালনকন্যা’ ফরিদা পারভীন নামে।

ফরিদা পারভীন তার কণ্ঠে লালন শাহর আধ্যাত্মিক ও মরমি গানের এক অনন্য ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন। তার গায়কিতে ছিল নিখাদ ভক্তি, গভীর আবেগ আর একধরনের অদ্ভুত আধ্যাত্মিক টান। ফলে শ্রোতার মনে এই অনুভূতি জন্মাত, এই গীতিই যেন শুধু তার জন্য, অন্য কারো জন্য নয়।

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’

‘বাড়ির কাছে আরশী নগর’

‘মিলন হবে কত দিনে’

‘সময় গেলে সাধন হবে না’

এমন গানগুলো তার কণ্ঠে শুধু পরিবেশিত হতো না, বরং শ্রোতার হৃদয়ে শেকড় ছুঁয়ে যেত। মনে হতো, সুদূর সুরলোকে বন্দি কোনো অচিন পাখি মুক্তির জন্য ছটফট করছে, আর তার কণ্ঠ সেই আর্তি প্রকাশ করছে।

যদিও লালনগীতিই তাকে বিশ্বজনীন খ্যাতি এনে দেয়, ফরিদা পারভীনের শিল্পীসত্তা শুধু লালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি আধুনিক গান, দেশাত্মবোধক গান, এমনকি বিরহের গানেও অনন্য দ্যুতি ছড়িয়েছেন।

আবু জাফরের লেখা ও সুরে তার কণ্ঠে গাওয়া দেশাত্মবোধক গান—

‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীর তটে, আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়’

বাংলার প্রকৃতি, নদী আর জনজীবনের এক অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছিল।

আবার তিনি গেয়েছেন—

‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম, সে এখন ঘোমটা পরা কাজল বধূ কোন গাঁয়’

‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিধিঁল গায়, প্রেমের কি দাম আছে বলো’

এসব গানে তার গায়কি মর্মে মর্মে দাগ কেটে গেছে, যেমনভাবে আধ্যাত্মিক লালনগীতি মানুষকে আলোড়িত করে। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ শুধু গানেই নয়, নাটকের পর্দাতেও এক অনন্য আবহ সৃষ্টি করেছিল। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ও আমার প্রযোজিত নাটক ‘আলতা’-তে নেপথ্য সংগীতে তিনি গেয়েছিলেন—

‘আট বেহারা পালকি চড়ে বেনারসি ঘোমটা তুলে, চোখের জলে ভেসে ভেসে কিশোরী বউ যায়।’

গ্রামের ধূসর মেঠোপথে পালকি নিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য আর ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গাওয়া গান—সব মিলিয়ে যেন পুরো বাংলাদেশের আকাশ ভারী হয়ে গিয়েছিল করুণ আবেগে। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনে একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ অনুষ্ঠানে, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পীদের অংশগ্রহণে তিনি গেয়েছিলেন—

‘ঘুমের দেশে ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা, জ্বলছে স্মৃতি আলোর বুকে ভোরের করুণ তারা।’

এই পরিবেশনা শুধু একটি গান ছিল না, বরং এক অমর স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে।

শিল্পী হিসেবে যেমন তিনি ছিলেন অনন্য, তেমনি মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা এক কিশোরী কীভাবে আধ্যাত্মিক সুরের মায়াবী জগতে সমগ্র দেশকে মোহিত করল, তার জীবন্ত উদাহরণ ছিলেন ফরিদা পারভীন। শত কষ্ট, দুঃখ, শারীরিক যন্ত্রণা তিনি নীরবে সহ্য করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোনো আড়ম্বর ছিল না, কখনো কারো কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশ করেননি।

তার অমায়িক ব্যবহার, সদা হাস্যময় মুখ, মায়াভরা দৃষ্টি—সবাইকে মুগ্ধ করত। তিনি ছিলেন নিরহংকার, সহজ-সরল অথচ গভীর মনের অধিকারিণী। ফরিদা পারভীন শুধু একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগের প্রতীক, লোকসংগীতের এক জীবন্ত ইতিহাস। তার কণ্ঠে লালনগীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে গান শুধু বিনোদন নয়, গান হলো ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্মৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক।

আজ যখন তার গান শোনা যায়, তখন মনে হয় তিনি কোথাও আছেন, সুরলোকে বসে এখনো গান করে যাচ্ছেন। তার কণ্ঠে লালন শাহর গীতিকবিতা নতুন করে প্রাণ পায় আর শ্রোতার মনে শেকড়-সন্ধানী অনুভূতি জাগায়। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন এক অবিনশ্বর উত্তরাধিকার—বাংলার মরমি গানের ভান্ডারকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠার গৌরবময় ইতিহাস।

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক

বাংলাদেশ টেলিভিশন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত