অনেক দিন ধরেই আফ্রিকান তরুণদের এ কথা বলা হচ্ছে, এই মহাদেশে গণতন্ত্র হলো আমদানি করা, ধার করা, তাদের ধারণার বা পরিচয়ের বাইরের কিছু। কিন্তু ইতিহাস আমাদের সামনে ভিন্ন সত্য তুলে আনে। আর সেই সত্যটি হলো—আফ্রিকায় গণতন্ত্র পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসা কোনো ধারণা নয়। বরং এটি একটি মানবিক ধারণা এবং আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বের অনেক আগে থেকেই আফ্রিকায় গণতন্ত্রের অনুশীলন ছিল। আফ্রিকার গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকার ঔপনিবেশিক সীমানার চেয়েও পুরোনো, যে ঔপনিবেশিক শাসন মহাদেশটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল।
সোমালিয়ায় একটা সময় ছিল, যখন রাষ্ট্রের সামষ্টিক বিষয়গুলো নির্ধারণ করার জন্য প্রতিটি মানুষ উন্মুক্ত কাউন্সিলে দাঁড়াতে, তর্ক করতে এবং ভোট দিতে পারত। অন্যদিকে, ইথিওপিয়ার ওরোমো জনগণের একটি ঐতিহ্যবাহী শাসনব্যবস্থা ‘ওরোমো গাডা’ সিস্টেম, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্যবস্থাটি মূলত অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রতি আট বছর অন্তর নির্বাচন হয়। এর মধ্যে রয়েছে নেতৃত্ব নির্বাচন, শান্তি স্থাপন, সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি এবং নৈতিক আচরণ নিশ্চিত করা। ২০০১ সালে ইউনেসকো এটিকে মানবজাতির বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
ওরোমো গাডা সিস্টেমের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—এটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্ষমতা হস্তান্তর এবং জবাবদিহির ওপর জোর দেয়, যার মধ্যে আছে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—পর্যায়ক্রমিক শাসন পদ্ধতি। এখানে একটি নির্দিষ্ট বয়সের গোষ্ঠীকে নিয়ে নির্বাচন হয় এবং প্রতি আট বছরের ব্যবধানে একজন নেতা নির্বাচিত হন।
ওরোমো গাডা সিস্টেম শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, বরং ওরোমো সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ব্যবস্থাটি সংঘাত নিরসন, সামাজিক সংহতি এবং মানবাধিকার, বিশেষ করে মহিলাদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের অন্য কোথাও গণতন্ত্র ফ্যাশনেবল হওয়ার কয়েক শতাব্দী আগেই ওরোমো গাডা ব্যবস্থা ঘূর্ণায়মান নেতৃত্ব এবং শাসকের বা ক্ষমতার নির্দিষ্ট মেয়াদ তৈরি করেছিল। ইগবো সম্প্রদায়গুলো রাজার শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেরা গ্রাম সমাবেশের মাধ্যমে তাদের এলাকা শাসন করত এবং ঐকমত্যের ওপর জোর দিত।
আফ্রিকার আরেক দেশ বতসোয়োনায় জনসাধারণের বিতর্ক মঞ্চ তৈরি করা হতো, যেখানে নেতারা তাদের কথা বলার চেয়ে বেশি শুনতেন। এই ব্যবস্থাগুলো আধুনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে অভিন্ন মনে হয়নি, তবে নীতিটি ছিল অকাট্য : শাসক বা ক্ষমতাকে অবশ্যই সম্প্রদায়ের সেবা করতে হবে এবং সম্প্রদায়কেও শাসকের বা ক্ষমতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। কাজেই গণতন্ত্রের গল্প মোটেই পশ্চিমা নয়। এটি মানবিক এবং এতে আফ্রিকার অবদান অনস্বীকার্য।
গণতান্ত্রিক ধারণাগুলো কোনো একটি সভ্যতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রাচীন এথেন্স নাগরিক শাসনের নিজস্ব রূপ বা ধরন তৈরি করেছিল। ইসলামি শাসনব্যবস্থা শূরা, পরামর্শের ওপর জোর দিয়েছিল। পূর্ব এশিয়ায় কনফুসীয় মডেলগুলো ইউরোপের অনেক আগেই একটি মেধাতান্ত্রিক নাগরিক পরিষেবা তৈরি করেছিল।
আধুনিক গণতন্ত্র ১৮ শতকে যখন তার গতি ফিরে পেয়েছিল, তখন আমেরিকা শুধু এটি প্রতিষ্ঠা করেই নয়, বরং যুদ্ধ, সংকট এবং রাজনৈতিক বিভাজন থেকে বেঁচে থাকতে পারে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এটিকে টিকিয়ে রেখে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছিল। সেই উত্তরাধিকার বাস্তব এবং কখনোই তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।
আজ তরুণ আফ্রিকানরা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। তারা এমন একসময়ে বাস করছে, যেখানে যুক্তির চেয়ে ক্রোধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভুল তথ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবার কাছে পৌঁছে যায়। এই পরিবেশ নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। এটি প্রতিষ্ঠানের ম্যারাথনের পরিবর্তে শক্তিশালী ব্যক্তির দৌড়কে পুরস্কৃত করে। কিন্তু গণতন্ত্র দৌড়ের পরিবর্তে বরং ম্যারাথনকে জয় করে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের স্বল্পমেয়াদি আবেদন কখনোই জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জায়গা নিতে পারে না। আফ্রিকা স্বল্পমেয়াদি হতাশার জন্য কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি স্বাধীনতা নিয়ে বাণিজ্য করতে পারে না।
আধুনিক আফ্রিকান সমাজ শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করছে না। বতসোয়ানার গণতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতা, সেনেগালের শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর, ঘানার শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং কেনিয়ার বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা দেখায় যে, আফ্রিকান গণতন্ত্রগুলো নিজেদের মানিয়ে নিতে, বিকশিত হতে এবং সংশোধন করতে পারে। একই সঙ্গে, এই মহাদেশের অন্য দেশগুলোও বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে আছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বর্জন এবং পরিচয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। এসব সমস্যাকে সততার সঙ্গে নামকরণ করা দুর্বলতা নয়। কারণ, গণতন্ত্র এভাবেই বেড়ে ওঠে, এর ভিত শক্তিশালী হয়।
আজ আফ্রিকায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অর্থ হওয়া উচিত এটিকে আরো সম্প্রসারিত করা। অতীতের ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই নারী এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে বাদ দিয়েছিল। একটি আধুনিক আফ্রিকান গণতন্ত্রকে অবশ্যই নারী, তরুণ, সংখ্যালঘু এবং অতীতে যাদের কণ্ঠস্বরকে নীরব করে দেওয়া হয়েছিল, তাদের সবার সমান মর্যাদার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধারের অর্থ অতীতে ফিরে যাওয়া নয়। বরং এর অর্থ হলো, বৃহত্তর ন্যায়বিচারের সঙ্গে এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
প্রযুক্তি আফ্রিকার জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং উন্মুক্ত শিক্ষার সংস্থান তরুণ আফ্রিকানদের এমন কিছু দিতে পারে, যা পূর্ববর্তী প্রজন্ম কখনো পায়নি। আর সেই নতুন পাওয়াটা হচ্ছে—কোনো দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা না করে বা তার অনুমতি না নিয়ে বিশ্বব্যাপী শেখার এবং প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা অর্জন। তবে, কানেকটিভিটি বা সংযোগের ক্ষেত্র এখনো অসম। অবকাঠামো এখনো ব্যয়বহুল। নীতিগুলো উদ্ভাবনের চেয়ে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে আছে। কিন্তু সম্ভাবনা বিপুল।
মানব ইতিহাসের প্রতিটি বড় অগ্রগতি এর গ্রহণকারীদের পুরস্কৃত করেছে। মুদ্রণযন্ত্র, বাষ্পীয় শক্তি, বিদ্যুৎ, সবুজ বিপ্লব, ইন্টারনেট এবং এখন এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর উদাহরণ। বর্তমানে আফ্রিকার জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ। যদি তারা প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী নাগরিক মূল্যবোধ এবং স্পষ্ট সুরক্ষাব্যবস্থাসহ এআই গ্রহণ করে, তাহলে এই মহাদেশ এমন একটি অগ্রগতি অর্জন করতে পারে, যা কোনো অঞ্চল কখনো অর্জন করতে পারেনি।
গণতন্ত্র স্লোগানের মাধ্যমে নয়, বরং এটি অভ্যাস দ্বারা সুরক্ষিত হয়। তরুণ আফ্রিকানরা শুধু নির্বাচনে নয়, তাদের দৈনন্দিন অনুশীলনেও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে। তারা এটি করতে পারে স্থানীয় পরামর্শমূলক ফোরাম পুনরুজ্জীবিত ও ছাত্র সংসদ তৈরি করার মাধ্যমে। একই সঙ্গে সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠান পরিচালনা করার মাধ্যমেও গণতান্ত্রিক চেতনাকে জোরদার করা যায়। পাশাপাশি ভুল তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করা, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে রক্ষা করা, ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রচারণা জোরদার করতে হবে। এই ছোট অভ্যাসগুলো বৃহৎ সংস্কৃতি তৈরি করে।
আফ্রিকানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তাদের অবশ্যই এই ন্যারেটিভ বা আখ্যান প্রত্যাখ্যান করতে হবে যে, গণতন্ত্র তাদের কাছে অন্য কারো কাছ থেকে এসেছে। কর্তৃত্ববাদ আফ্রিকান সংস্কৃতি নয়। নীরবতাও আফ্রিকান সংস্কৃতির অংশ নয়। এই মহাদেশের ঐতিহ্য হলো বিতর্ক, সংলাপ, ঐকমত্য, জবাবদিহি এবং সম্প্রদায়গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এই মহাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার অর্থ হলো আফ্রিকা সর্বদা যা জানে তা পুনরুদ্ধার করা। এ কথা মনে রাখা যে, ক্ষমতা বিশ্বাসে ধারণ করতে হবে, জোর করে বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নেওয়া উচিত নয়।
আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই মহাদেশের তরুণদের ওপর। যদি এই তরুণরা তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের স্বাধীনতা, তাদের বৈচিত্র্য, তাদের সত্য এবং মর্যাদা রক্ষা করে, তাহলে তারা যেকোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির চেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবে। তারা এমন একটি মহাদেশ গড়ে তুলবে, যেখানে ঐক্য জাতিগুলোকে মুছে ফেলবে না এবং সার্বভৌমত্ব নাগরিকদের কণ্ঠকে চেপে ধরবে না। এমন একটি মহাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে আফ্রিকা অন্য কোওনো মডেলের অনুলিপি হবে না, বরং নিজেই উঠে দাঁড়াবে। গণতন্ত্র এমন কিছু নয়, যা আফ্রিকাকে ধার করতে হবে। এটি এমন কিছু, যা আফ্রিকায় আগেও ছিল এবং আগামীতেও আফ্রিকা এতে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী


ছয় কোটি নতুন মুখ দারিদ্র্যসীমার ঝুঁকিতে কেন?
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ও বাস্তবতা
লেবাননের যুবকদের জন্য আশার বার্তা দিলেন পোপ লিও