বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে লালমনিরহাট, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার চর এবং নিম্নাঞ্চলগুলোর মানুষের জন্য তিস্তা নদী জীবন ও জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। সীমান্তের ওপারের সিদ্ধান্তে এই বন্ধন সর্বদাই নড়বড়ে। হঠাৎ করে উজানে ভারতের দিক থেকে গজলডোবা বা তিস্তা ব্যারাজের যে জলকপাট বা গেটগুলো খোলা হয়, তা আমাদের নিম্নাঞ্চলের মানুষের জীবনে এক ধাক্কার মতো কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর কিছু ঘটনা ও প্রতিবেদন দেখিয়ে দিয়েছে এই কৃত্রিম বন্যার দুর্গতি কত ভয়াবহ।
কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, এমনকি সামাজিক রীতিনীতিও গড়ে উঠেছে এই নদীকে ঘিরে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তিস্তায় ভারতের জলকপাট হঠাৎ খুলে দেওয়ার কারণে যে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয়, তা অববাহিকার কোটি মানুষের জীবনে এক গভীর বেদনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বেদনা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য নয়; বরং ভারতের জলবৈষম্যমূলক নীতির কূটকৌশলও এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ফি বছর হঠাৎ জলকপাট খোলার ধাক্কা কয়েকবার করে ধেয়ে আসতে থাকে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় গজলডোবা ব্যারাজে তিস্তায় একাধিক জলকপাট রয়েছে। বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি জমলে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ সেসব জলকপাট খুলে দেওয়া হয়। এর ফলে মুহূর্তেই বিশাল পানির ঢল নেমে আসে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়। ফসলের মাঠ, বসতভিটা, গবাদি পশু, রাস্তাঘাটÑসবকিছু মুহূর্তেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরেই শুধু কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিকবার গজলডোবার জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও আদিতমারী উপজেলার ৩০ হাজারের বেশি মানুষ তিস্তায় আকস্মিক পানির ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ডুবে নষ্ট হয়ে যায়।
এ ধরনের আকস্মিক বন্যার কারণে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। বর্ষার শেষভাগে যখন আমন ধানে শিষে আসে, ঠিক তখন তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের এক মৌসুমের পরিশ্রম নষ্ট হয়ে যায়। ২০২৩ সালে তিস্তার ঢলে প্রায় ২০ হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল। এছাড়া অবকাঠামো নষ্ট হচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে কাঁচা ঘরবাড়ি, ভেঙে পড়ছে রাস্তা ও বাঁধ। হাতীবান্ধা উপজেলার মাত্র এক মৌসুমেই ২৫ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
পানির স্রোতে ভেসে গেছে গরু-ছাগল। ২০২৪ সালের বন্যায় লালমনিরহাটে দুই হাজারের বেশি গবাদি পশু মারা গিয়েছিল বলে স্থানীয় প্রশাসনের হিসাব। বন্যাক্রান্তদের ঘরে খাবার মজুত থাকে না, স্কুল-কলেজে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়, পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে প্রতিবছর।
তিস্তাপাড়ের মানুষ জানে বর্ষায় বন্যা আসতে পারে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে পারে না, যখন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়, ঘর ছাড়ার সময় পায় না, গবাদি পশু সরানোর সময় পায় না, শিশু-বৃদ্ধরা অসহায় হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা বলেন, ‘আমরা প্রাকৃতিক বন্যাকে ভয় পাই না, কিন্তু হঠাৎ ছেড়ে দেওয়া এই পানির ঢল আমাদের সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে।’
তিস্তায় পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির খসড়া প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে ৩৭ শতাংশ এবং ভারতকে ৪৩ শতাংশ পানি দেওয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতায় সেই চুক্তি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বর্ষায় হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়া আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব দুটোই ভোগাচ্ছে বাংলাদেশকে।
প্রতিবছর কৃত্রিম বন্যায় মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। অতিরিক্ত স্রোতে নদীর চর ভেঙে যাচ্ছে, বাড়ছে নদীভাঙন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে তিস্তাপাড়ের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছে। কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, ফলে উত্তরাঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
তিস্তা সমস্যা সমাধানের পথ কোথায়, তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। একটি সুষ্ঠু পানি চুক্তি ও তার বাস্তবায়ন দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে দুই দেশের মধ্যে ন্যায়সংগত পানিবণ্টন নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই?
তবে উজানে গজলডোবার জলকপাট খোলার আগে বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হবে, যাতে মানুষ প্রস্তুত হতে পারে। তিস্তার অববাহিকার মানুষ বছরের পর বছর একই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে। তারা জানে, প্রকৃতির নিয়মে বন্যা আসবে। কিন্তু কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই বন্যা, যা প্রতিবছর তাদের ঘরবাড়ি, ফসল ও জীবন কেড়ে নিচ্ছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটি একদিকে মানবিক সংকট, অন্যদিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রতিফলন।
সাম্প্রতিক ঘটনা ও পরিসংখ্যান থেকে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা যাক। সাম্প্রতিক একটি সংবাদ মতে, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। এতেই সম্পূর্ণ ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়। এতে নিম্নাঞ্চল কিছু ইউনিয়ন দ্রুত বন্যায় নিমজ্জিত হয়। ২০২১-এ তিস্তা নদীর একটি এক্সট্রিম ফ্ল্যাশ ফ্লাড ঘটেছিল, যেখানে প্রায় ১৩৬,০০০ জন মানুষ জলবন্দি হয়েছিল এবং ৩৩ শতাংশেরও বেশি কৃষিজমি বন্যায় ঢেকে গিয়েছিল বালি, মাটি ও সেডিমেন্টে।
২০২১ সালের আরো একটি ঘটনা ছিলÑসে সময় তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছিল, যখন নদী বিপৎসীমার প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তখন প্রায় ১০,০০০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফসল ও জমি বালিয়াড়ির সম্মুখীন হয়েছে তিস্তা। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যার পানিতে বহিত বালি ও বালুকামাটি অনেক ক্ষেত্রেই ফসলযোগ্য জমি অযোগ্য হয়ে গেছে। অনেকে জমিতে কাজ শুরু করেও বালির নিচে পড়ে গেছে, জমির উর্বরতা কমে গেছে।

তিস্তা বেসিনে শুকনো মৌসুমে নদীর পানি দ্রুত কমে যায়। একটা খবর বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা নদী দ্রুত শুকিয়ে পড়েছে গাইবান্ধা এলাকায়, ভরাট চরব-মাঠ হয়ে গেছে, লোকজন নৌকা বা ট্রলারে যেতে পারছেন না, যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই তথ্যগুলো শুধু সংখ্যার খেলায় সীমাবদ্ধ নয়। তাদের পেছনে মানুষের জীবনের কষ্ট ও বেদনা নিহিত।
ফসলের ধরন পরিবর্তন অনেকে এখন কম পানি-সংক্রান্ত ফসল চাষ করছেন। সেখানে ধান কম, শাকসবজি ও এমনকি খরিফ ফসল পেঁয়াজ, রসুন, তিল ও তরমুজ বেশি। যেসব ফসল বেশি পানির প্রয়োজন, সেসব ফসল সেই অঞ্চলে বর্জনযোগ্য হয়ে উঠেছে। সেচ পাম্প, সার, বীজ ও শ্রমের ব্যয় বেড়ে গেছে, কারণ বন্যায় কিছু অংশ নষ্ট হয়, আবার খরায় কাজ শুরু করা যায় না।
ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ ও অন্য বাঁধগুলো উজানে থাকায় যেগুলো ভারত নিয়ন্ত্রণ করে। বন্যার সময় পানির চাপ বেড়ে গেলে হঠাৎ গেট খোলা হয়, বাংলাদেশে সতর্কবার্তা নাও পাওয়া যেতে পারে বা সময়ও না পাওয়া যেতে পারে। উজানে হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে পানির পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়, যা ডাউনস্ট্রিমে নদীবাহিত হয়ে আসে। যখন গেট খোলা হয়, তখন স্রোতের ক্ষিপ্রতা ও পানির পরিমাণ একসঙ্গে বেড়ে যায়। বারবার বন্যা মানে বারবার হতাশা, উদ্বেগ, ভবিষ্যতের অস্থিরতা।
তিস্তাপাড়ের মানুষ রাতের অন্ধকারে হঠাৎ ভারী ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে কীভাবে তাদের জীবন ভেসে যাচ্ছে। যে জমিতে তারা জন্মেছে, বাস করেছে, তাদের স্বপ্ন গড়ে তুলেছে, সেসব কিছু নিচে চলে যাচ্ছে পানির স্রোতে। ক্ষতির পরিমাণ, মানুষের মানসিক ভুক্তভোগিতা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাÑসবই বড় বিষয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি স্থায়ী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এই বেদনা দিনের পর দিন বাড়তে থাকবে।
এই নদী আজ মানুষের জন্য আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ হয়ে উঠছে। কারণ, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সীমান্তের ওপার থেকে হঠাৎ করেই জলকপাট খুলে দেওয়া হয়। ফলে মুহূর্তেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যা। ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু, মানুষের স্বপ্নÑসবকিছু ভেসে যায় পানির স্রোতে। প্রশ্ন জাগে, তিস্তার এই কৃত্রিম বন্যার দুঃখগাথা আর কতদিন চলবে? চীনের সহায়তায় তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের কথা চারদিকে চাউর হলেও গত এক বছরে এর কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি।
তবে যেভাবেই হোক এখনই সময় তিস্তা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান বের করার। শুধু ত্রাণ দিয়ে বা সাময়িক অভিযোজনের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা। অন্যথায় তিস্তার কৃত্রিম বন্যার দুঃখগাথা উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
E-mail: fakrul@ru.ac.bd

