রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের আগেই শুরু হয় পিটুনি

রকীবুল হক
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ২৪

নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে আন্দোলন ঘিরে পতিত আওয়ামী সরকারের আলেম-ওলামা নির্যাতনের অন্যতম স্পট ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ ঘটনায় একের পর এক মামলা ও হুলিয়া জারি করে গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতে ইসলামের সহ-প্রচার সম্পাদক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা গাজী মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানীকে। ঘটনার সময় এলাকায় না থেকেও তৎকালীন মন্ত্রী-এমপিদের তৎপরতায় তার বিরুদ্ধে ২০টি মামলা দেওয়া হয়। এসব মামলায় দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায় পুলিশ।

বিজ্ঞাপন

মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ে হাত-পা এবং চোখ বেঁধে বেদম পেটানো হয় ‘মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, কসবার’ চেয়ারম্যানকে। এতে বেহুঁশ হয়ে যান তিনি। কারাগারের সেলেও ১৯ মাস নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। এমনকি জামিনে বিলম্ব এবং জামিন পেলেও জেলগেট থেকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারারুদ্ধ করার ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার। মুক্তির পরও গোয়েন্দা সংস্থার নানা হুমকি ও নজরদারিতে ছিলেন তিনি।

মোদিবিরোধী আন্দোলন ঘিরে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ও পরবর্তী কয়েক দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে স্থানীয় আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে গণহারে মামলা ও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে ওই ঘটনার উসকানি ও মূলহোতা হিসেবে কাল্পনিক অভিযোগ সাজিয়ে মামলা এবং হুলিয়া জারি করা হয় মাওলানা গাজী মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানীর বিরুদ্ধে।

হেফাজতের নেতৃত্ব ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের কারণে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে এই হুলিয়া জারি করান বলে তিনি মনে করেন। সাবেক আইনমন্ত্রীর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গ্রেপ্তার এড়াতে ফেনী সদরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবার বাসিন্দা মাওলানা ইয়াকুব ওসমানী। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে গত ৬ মে র‌্যাব ও ডিবি পুলিশের যৌথ অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইয়াকুব ওসমানী জানান, গ্রেপ্তারকালে তিনি ইফতার করার জন্য সময় চাইলেও তাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাকে বলা হয়, ওপরের নির্দেশে তাকে দ্রুত নিয়ে যেতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি আলেম-ওলামা নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত ডিবির ওসি লোকমানের নেতৃত্বে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে তাকে নেওয়া হয় ফেনী ডিবি অফিসে। সেখানে মাগরিবের নামাজ শেষে তাকে নিয়ে রাত ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিবি অফিসে পৌঁছায় তারা। সেখানে তাকে হস্তান্তর করে গ্রেপ্তারকারী দল চলে যায়। তখন দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার দোয়া পড়তে বলে তাকে জানান, সারারাত সেখানে গ্রেপ্তার আলেমদের পেটানো হয়েছে। পা উল্টোদিকে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে অনেকের। আমাদের কিছু করার নেই, বড় অফিসাররা এই নির্যাতন করেন।

পরের দিন সকালে তাকে প্রথম দফায় পাঁচটি মামলায় জড়িয়ে আদালতে নেওয়া হয়। আদালত থেকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলে তাকে পাঠানো হয় জেলহাজতে। সেখান থেকে পরের দিন ডিবির রিমান্ডে আনা হয়। সেখানে নিয়েই তার হাত-পা এবং চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই শুরু হয় বেদম মারধর। কোনো জিজ্ঞাসা ছাড়াই নির্যাতন শুরুর কারণ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘তোকে শেষ করে দিতে ওপরের নির্দেশ আছে। তোকে শেষ করলে আমাদের প্রমোশন হবে।’ এ সময় শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে কুৎসিত ভাষায় গালাগালের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন করা হয় বেশি। তারা বলেন, তোরা সরকার উৎখাত করবি, হেফাজত সরকার গঠন করবি? তোকে কোন মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে? এসব কথা বলে নির্যাতন চালাতে থাকে। এতে বেহুঁশ হয়ে যান তিনি।

গাজী মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানী বলেন, রিমান্ডে সাধারণত সংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে কোনো জিজ্ঞাসা না করেই নির্যাতন শুরু করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলÑবিভিন্ন সরকারি অফিসে জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা। রিমান্ডে নির্যাতনের একপর্যায়ে তাকে বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করে পুলিশ। টাকা দিলে নির্যাতন কম হবে বলে জানানো হয়। সে সময় তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করাও সহজ ছিল না। কারণ তার পরিবারের সবাই আলেম ও পর্দানশিন। সে সময় টুপি-দাড়ি দেখলেই গ্রেপ্তার করত পুলিশ। যতটুকু সম্ভব তারা এসে দেখা করতেন। তবে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও শারীরিক নির্যাতন থামায়নি।

রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসা করা হতো, সরকার উৎখাত করতে কত টাকা, কোথা থেকে কার মাধ্যমে পেয়েছিস? মামুনুল হকের সঙ্গে যোগসাজশ আছে কি না? বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে গোপন কোনো বৈঠক হয়েছে কি না? বাবুনগরীকে কে শেল্টারিং করে? কওমি মাদরাসায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসী আছে কি না? অস্ত্র কোথা থেকে আসে ইত্যাদি। তিন দফায় ডিবি, থানা-পুলিশ এবং পিবিআই মিলে ১১ দিনের রিমান্ডে ছিলেন তিনি। সবাই একই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

এভাবে নির্যাতনের পরও কোনো মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেননি তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলোÑসে সময় পুলিশ মিডিয়ায় প্রচার করে, মাওলানা গাজী মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানী জ্বালাও-পোড়াওয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। অথচ সবটাই মিথ্যা এবং সাজানো স্বীকারোক্তি।

ইয়াকুব ওসমানী বলেন, ইসলামি অনুভূতি যেমনÑআল্লাহু আকবার তাকবির ধ্বনি, বিসমিল্লাহ বলা বা আলেম-ওলামাদের অনুসরণ করাÑএসব বিষয় নিয়ে পুলিশ বেশি তাচ্ছিল্য ও কুৎসামূলক। আল্লাহু আকবার ধ্বনি আর বাংলাদেশে চলতে দেওয়া হবে নাÑএমন কথা বলে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল থানার তৎকালীন সেকেন্ড ওসি এ কথাগুলো বলতেন। এই ওসির বাড়ি গোপালগঞ্জে। রিমান্ডে নিয়ে একবার বলা হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আল্লাহু আকবারের দিন শেষ। আল্লাহু আকবার ধ্বনি আর উচ্চারণ করতে দেওয়া হবে না। সেখানে পেছন দিক থেকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পায়ে রশি দিয়ে বেঁধে লাঠি দিয়ে হাঁটুর মধ্যে বসিয়ে দিত। পায়ের গোড়ালি ও পাতায় রুল দিয়ে জোরে আঘাত করা হতো। এই আঘাতের ব্যথা মাথা পর্যন্ত অনুভূত হতো। এ সময় অন্য একজন আলেমকে উল্টো করে ঝুলিয়ে পায়খানার রাস্তায় মোম গলিয়ে ফেলা হয়। তার সামনে আরেকজন হাফেজকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফ্লোরে ফেলে বুট দিয়ে মুখে চাপ দিয়ে জিহ্বা বের করা হয়।

রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হলে সেখানেও তাকে নির্যাতনের চরম মাত্রা সহ্য করতে হয়। তাকে একটি সেলে আবদ্ধ করে বাইরের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের সেলের বাইরে বের হতে দেওয়া হতো না। কারারক্ষীরা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন, তারা কোনো কথা বলতেন না। জেলের মধ্যে যে ক্যানটিন আছে, খাবার কিনে খাওয়া যায়Ñএটাও জানতে দেওয়া হয়নি। অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার দেওয়া হতো। সেখানে দিন না রাত তা বোঝার কোনো সুযোগ ছিল না। দীর্ঘদিন পর পরিবারের সঙ্গে যখন মোবাইলে কথা বলতে দেওয়া হতো, তখন পাশেই কারারক্ষীরা দাঁড়িয়ে থাকতেন। এতে মামলা বা অন্য সমস্যা নিয়ে কোনো কথা বলা যেত না। এভাবে অমানবিক আচরণ করা হয়। ওরা তাদের উন্মাদ বানিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্ত করেছিল বলে তিনি মনে করেন। একমাত্র আল্লাহর দয়ায় তারা বেঁচে আছেন।

নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা তাদের ভোগ করতে দেওয়া হয়নি জানিয়ে এই আলেম বলেন, প্রত্যেক আসামির মামলা অনুযায়ী জামিনের যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু আদালত এমন প্রহসনেরও কুক্ষিগত ছিল যে, হেফাজতের মামলা দেখলেই ফাইল ছুড়ে ফেলত। ন্যায়বিচার পাওয়ার চেয়ারগুলো থেকেই তাদের নিয়ে কুৎসা করা হতো। অনেক কষ্টে কোনো মামলার জামিন হলেও মুক্তি দেওয়া হতো না। জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করা হতো। ৯ মাস কারাভোগের পর দুটি মামলায় এবং পরের মাসে আরো তিনটি মামলায় জামিন দেয় আদালত। তবে বের হওয়ার সময় কারা কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে জানায়, আপনার নামে মামলা আছে, বের হওয়া যাবে না। সব মামলায় জামিনের কথা বললে তারা জানায়, নতুন মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। এভাবে তিন থেকে চারবার জামিনে মুক্তির সময় জেলগেট থেকে ফেরত দিয়ে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একে একে তার মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০টিতে। মামলাগুলোর মধ্যে ছিল-পুলিশের কাজে বাধা প্রধান, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট, জঙ্গিবাদে উসকানি দেওয়া ইত্যাদি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন দিন বিক্ষোভের সময় তিনি কুমিল্লার দেবিদ্বারে ছিলেন। গোয়েন্দাদের কাছেও সে তথ্য আছে। এরপরও ওই ঘটনার উসকানি ও অর্থদাতা হিসেবে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাবেক এমপি উবায়দুল মুক্তাদিরের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে হাফেজ মাসুদকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। এমনকি ২০০১ সালের একটি মামলায়ও তাকে জড়ানো হয়। প্রত্যেকটি মামলা ছিল মিথ্যা, কাল্পনিক এবং বানোয়াট। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর তার মুক্তি হয়। তবে ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত মামলাগুলোয় হাজিরা দিতে অধিকাংশ সময় কাটত আদালতের বারান্দায়। বর্তমানে মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে।

কারা নির্যাতনের পাশাপাশি তার পরিবার ও তাকে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করে প্রশাসন। তার পরিবারকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়িটিও ভেঙে তছনছ করে দেয়।

এদিকে মুক্তির পরও গোয়েন্দা সংস্থার হুমকি ও নজরদারিতে থাকতেন ইয়াকুব ওসমানী। এক ওয়াজ মাহফিলে তার ওপর নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরলে পরে ডিজিএফআই থেকে তাকে ফোন দিয়ে গুম করার হুমকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরেক দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক এমপি উবায়দুল মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় তাকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করেছিল পুলিশ। পরে তিনি কুমিল্লায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। দেবিদ্বারের বায়তুল আজগর সাত গম্বুজ জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্বে আছেন তিনি।

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত