১৬ বছর ধরে বাংলাদেশ একটা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে, যেটা কখনো সেরে ওঠেনি। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি যে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, স্বাধীনতার পর সেটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ট্র্যাজেডি। ৭৪ জন মানুষ সেখানে নিহত হন। এদের মধ্যে ছিলেন ৫৭ জন শীর্ষপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা, যারা বিডিআরে কর্মরত ছিলেন। বিডিআর সদর দপ্তর সেদিন বধ্যভূমি হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল। দেশ একটা প্রশ্নবিদ্ধ সময়ে প্রবেশ করেছিল। যে প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর ছিল না। এক দশকের বেশি সময় ধরে নিহত কর্মকর্তারের পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভ করেছে। শোক করেছে। প্রশ্ন করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করেছে। অপেক্ষা করেছে। এ সময়টায় গুজব গল্পে রূপ নিয়েছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আর রাজনীতি মিলেমিশে গেছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ড এমন একটা বিষয় হয়ে উঠেছে, যেটি বাংলাদেশ কখনো ভুলতে পারেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীন তদন্ত কমিশন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই কমিশন ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা তথ্য অনুসন্ধানী টিম। অনেকেই ভেবেছিল, এই প্রতিবেদন কখনো আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এটি। অনেক কিছু এখানে উঠে এসেছে। রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে এই প্রতিবেদন। ভূরাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এটি। ফেব্রুয়ারির ওই সকালটাকে আমরা কীভাবে দেখব, এই প্রতিবেদন সেটা বদলে দিয়েছে। মৃত্যু থেকে কারা লাভবান হয়েছে, সেটাও উঠে এসেছে এখানে। কোন ভুলে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেটাও আছে প্রতিবেদনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে বিডিআর সদস্যদের হত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে, এই প্রতিবেদনে অভিযোগের আঙুল তাদের উপর থেকে সরে গেছে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে রাজনৈতিক নেতা, কর্মকর্তা এবং বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ওপর, যারা এ ঘটনায় সাহায্য করেছে, পরিকল্পনা করেছে বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করেছে।
প্রতিবেদন পড়তে রীতিমতো আতঙ্ক লাগে। কীভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, অন্যদের সাহায্য বা ব্যর্থতা—সব আছে এখানে। নিয়মকানুন, বেসামরিক-সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক এবং বাংলাদেশে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে এই প্রতিবেদন।
হত্যাকাণ্ডের নতুন ব্যাখ্যা
কঠোর পরিশ্রম আর ব্যাপক তদন্তের পর কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ২০০৯ সালের পর প্রমাণাদি তেমন আর নেই। বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এএলএম ফজলুর রহমান। তারা জানিয়েছেন, পূর্ণ পেশাদারিত্ব এবং সম্পূর্ণ পক্ষপাতমুক্ত হয়ে কাজ করেছেন তারা। কমিশনের সদস্যরা সাক্ষীদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছেন। পুরোনো দলিলপত্র জোগাড় করেছেন। আর্কাইভ থেকে ভিডিও পরীক্ষা করেছেন। ঘটনার সময়কালের গোয়েন্দা প্রতিবেদন পরীক্ষা করেছেন। প্রতিবেদনের অনুসিদ্ধান্ত একেবারে পরিষ্কার। হত্যাকাণ্ড আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটা অংশ এর সঙ্গে জড়িত ছিল।
প্রতিবেদনে মূল সমন্বয়কারী হিসেবে নাম এসেছে সাবেক এমপি শেখ ফজলে নূর তাপসের। বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই সবকিছু ঘটানো হয়েছে। অভিযুক্তদের তালিকায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শেখ সেলিম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামও এসেছে। প্রতিবেদনে সাবেক ডিজিএফআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফজলে আকবর এবং সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের নামও এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের থেকে শুরু করে ২০০৯ সালে সরকারের নিযুক্ত শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাসহ অনেকের নাম প্রতিবেদনে এসেছে।

সবচেয়ে চমকে দেওয়া তথ্য হলো—প্রতিবেদনে এই বিদ্রোহের ঘটনায় বাইরের সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখান থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ভারত। প্রতিবেদনে অবশ্য সরাসরি বলা হয়নি যে ভারত এটি পরিচালনা করেছে। কিন্তু ঘটনাগুলো যেভাবে এসেছে, সেখানে নয়াদিল্লির জন্য সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুর্বল ও শোকাহত হয়ে পড়েছিল। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বদলে ফেলা হয়। তাদের ক্ষমতাও কমে যায়। ঢাকার সরকার ঘটনার পরপরই ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজায়।
এই অনুসন্ধান রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরোনো ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ঘটনা বাংলাদেশের ক্ষতি করেছে; কিন্তু একটি বিদেশি শক্তিকে সাহায্য করেছে।
অদৃশ্য হাত : বিদেশি স্বার্থ ও ভারত প্রশ্ন
কমিশন ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় লাভবান হয়েছে। এই তথ্য মারাত্মক ও সাহসী। সাধারণ একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে : বাংলাদেশে একদিনে বহু শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় জিত হলো কার? প্রতিবেদনে ভারত প্রশ্নে পূর্ণাঙ্গ উত্তর দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেখানে কিছু সংযোগ ও সময়ের কথা বলা হয়েছে, যেটি একটা শক্তিশালী প্যাটার্নের ইঙ্গিত দেয়।
প্রথম পয়েন্টটি খুবই সাধারণ। নিহত বহু কর্মকর্তা জাতীয় অধিকার, সীমান্ত ইস্যু এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। এসব অবস্থান কখনো কখনো ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছে। ২০০১ সালের বড়ইবাড়ি সংঘর্ষে ভারতের ১৬ জন বিএসএস সদস্য নিহত হন। ২০০৯ সালে যারা হত্যার শিকার হন, এদের মধ্যে কেউ কেউ ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন। পরিবারের সদস্য ‘ওয়্যার অ্যান্ড পিস নেটওয়ার্ক’কে বলেছে, এটা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নিহত বিডিআরপ্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভুঁইয়া এটি সরাসরি বলেছেন। তিনি দাবি করেন, যারা ভারতকে অপছন্দ করত, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।
বিদ্রোহের পর রাজনীতি নয়াদিল্লিকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ঘটনার কিছু সপ্তাহ আগে ক্ষমতায় বসেছিল আওয়ামী লীগ। তারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের অনুকূলে এমনভাবে বদলায়, যেটি আগে কখনো ছিল না। নিরাপত্তা সম্পর্ক বাড়তে থাকে। ট্রানজিট অধিকার বাড়ানো হয়। বাণিজ্যে সুবিধা পায় ভারত। এসব কি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত? না কি এগুলো ভারতের সৌভাগ্য? এই বিতর্ক থাকবে। কিন্তু দুটোর সংযোগটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তৃতীয়ত, প্রতিবেদনে বড় ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে, যেটি অস্বাভাবিক মনে হয়। এই কারণে ক্ষমতার একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। বিশৃঙ্খলার সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেনাবাহিনী কিছুই করেনি। এত বড় নিরাপত্তা ঘাটতির অর্থ হলো সেখানে বাইরের হস্তক্ষেপ ছিল অথবা রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগুলো চক্রান্তে জড়িত ছিল।
প্রতিবেদনে বাইরের ভূমিকা সামনে চলে এসেছে। বিদেশিরা সব নিয়ন্ত্রণ করেছে, এমন প্রমাণ অবশ্য সেখানে নেই। কিন্তু একটা প্যাটার্ন বোঝা যায়। দুর্বল বাংলাদেশ অন্য কাউকে সাহায্য করেছে। প্রতিবেদনে পুরো নাম বলা হয়নি। কিন্তু তথ্যগুলো বাংলাদেশের বাইরে ইঙ্গিত করছে।
পিলখানার অভ্যন্তর : নীরবতা, আতঙ্ক এবং ক্ষোভকে অস্ত্র করে তোলা
পিলখানার ভেতরে সেদিনের সকাল নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল দ্রুত ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। তরুণ অফিসাররা চোখের সামনে সিনিয়রদের মরতে দেখেছেন। পরিবারগুলো জিম্মি হয়েছে। ড্রেন দিয়ে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে সেনা কর্মকর্তারা অহংকারের প্রতীক ছিলেন, তারা ক্ষোভ, চক্রান্ত আর পরিকল্পিত হামলায় জীবন দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হঠাৎ ক্ষোভ থেকে বিদ্রোহ হয়নি। ডাল-ভাত কর্মসূচি ও বেতন নিয়ে ক্ষোভ আগে থেকেই ছিল। বিদ্রোহীরা সেগুলোকে ব্যবহার করেছে। এই ক্ষোভ দিয়ে হয়তো সামান্য মাত্রার সহিংসতার ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সত্যিকারের অভিযোগগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোকে অস্ত্রে রূপ দেওয়া হয়েছে এবং পরিকল্পিত বিদ্রোহের ছক আঁকা হয়েছে।
প্রতিবেদনের কাহিনিটা বেশ পরিষ্কার। ২৫ ফেব্রুয়ারি কোনো দাঙ্গা বা হামলা দেখা যায়নি। ২০ থেকে ২৫ জনের মতো মানুষ পিলখানায় প্রবেশ করেছিল। তারা দুই শতাধিক ব্যক্তিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে বোঝা যায়, পালানোটা ছিল পরিকল্পিত এবং তারা রাজনৈতিক সুরক্ষা পেয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বিদ্রোহীদের সাহায্য করেছেন। অ্যাকটিভিস্টরা পুলিশকে আটকে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বিডিআরের যে বৈঠক, তার রেকর্ড মুছে ফেলা হয়েছে অথবা বদলে দেওয়া হয়েছে। শুরুর দিকের তদন্তও উদ্দেশ্যমূলকভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নিরাপত্তা পদক্ষেপ নিতে কেন এত দেরি হলো? প্রতিবেদনে সিস্টেমের ব্যর্থতা, নেতৃত্বের অযোগ্যতা এবং রাজনীতিকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু আরো গভীর কিছু প্রশ্ন তারা এড়িয়ে গেছে। বাহিনীকে কি আটকে রাখা হয়েছিল? তারা কি আদেশের অপেক্ষায় ছিল? না কি এটাও পরিকল্পনা ছিল যে, তারা একটা ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করবে? প্রতিবেদনে কিছু আকার-ইঙ্গিত থাকলেও বিষয়টা নিশ্চিত করা হয়নি।
পরিবারের কথা : শোক, অভিযোগ এবং সত্য উন্মোচনের দাবি
বহু বছর ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নীরব ও আতঙ্কিত ছিল। আগের সরকারগুলো তাদের চুপ করে রেখেছিল। তারা প্রশ্ন করতে ভয় পেয়েছে। কিন্তু নতুন প্রতিবেদন তাদের শক্তি জুগিয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পরিবারগুলো সংবাদ সম্মেলন করেছিল। তারা জোরালো বক্তব্য রেখেছিল। হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেওয়ার জন্য তারা শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছে। তারা বলেছে, ভারতকে সাহায্য করে ক্ষমতায় থাকার জন্য হাসিনা এটা করেছে। তারা বলেছে, প্রতিবেদনে কিছু নাম গোপন রাখা হয়েছে। কিন্তু রহস্য উন্মোচন আর পরিষ্কার যোগাযোগগুলো প্রকাশের জন্য তারা কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়েছে। পরিবারগুলো অনেক আগে থেকেই হুমকির কথা বলে এসেছে। অনেককে মিথ্যা বলতে বাধ্য করা হয়েছিল, যাতে সরকারের ওপর দোষ না যায়।
একটি জায়গায় সবাই ঐক্যবদ্ধ। তারা বাংলাদেশের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীকে স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও এই চক্রান্তের সমাপ্তি টানতে বলেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করুন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করুন। হুমকি বন্ধ করুন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের ভূমিকার জন্য তাদের নিষিদ্ধ করতে বলেছে। অন্যরা বলেছেন, এখান থেকে কোনো দলের সুবিধা নেওয়া উচিত নয়। পরিবারগুলো প্রতিশোধ চায় না। তারা চায় দোষারোপ বন্ধ হোক।
ভারত, হাসিনা এবং ক্ষমতা কাঠামো
এই প্রতিবেদন শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ভারত এখান থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে—এই কথাটা মারাত্মক। এটা বিগত ১৫ বছরের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। আওয়ামী লীগ যেভাবে সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা এবং অর্থনীতিকে ভারতের কাছাকাছি নিয়ে গেছে, সেই বিষয়টি এখানে নতুন আলোয় উন্মোচিত হয়েছে। কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পরপরই যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থা এমন হয়ে যায়, যেখান থেকে ভারত শুধু লাভবানই হয়েছে।
শেখ হাসিনা কি একাই সক্রিয় ছিল? ভারতের চাপে? না কি অন্যদের সাহায্য পেয়েছে তারা? এটা নিয়ে আরো তদন্ত দরকার। কিন্তু প্রতিবেদনের ধারাটা বেশ পরিষ্কার : সেনাবাহিনীকে দুর্বল করো। ভারতবিরোধী অফিসারদের সরিয়ে দাও। ক্ষমতা দখল করো। নিরাপত্তাকে ভারতের অস্ত্রে পরিণত করো।
বাংলাদেশিদের জন্য এই তথ্যগুলো মারাত্মক। নেতাদের টার্গেট করে এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে। লক্ষ্যটাও বোঝা গেছে। কারা লাভবান হয়েছে, সেটাও পরিষ্কার। অধিকার আর ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর এই ঘটনার যে প্রভাব, সেটা বিশাল।
সত্য উদঘাটনে ১৬ বছর লেগে গেল। অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, যখন সম্ভব হয়েছে কমিশন গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে তদন্ত হয়েছিল ভাঙাচোরা। অথবা তথ্য লুকানো হয়েছিল তখন। পুরোনো গল্পে বলা হয়েছে, এগুলো ছিল অভিযোগ মাত্র। সেনাবাহিনীর তদন্ত গোপনই রাখা হয়েছে। সিআইডি বড় ধরনের বিচার সাজিয়েছে। কিন্তু শুধু নিচের দিকের লোকদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। রাজনৈতিক বা বিদেশি বসদের করা হয়নি।
নতুন সরকারের ন্যায্যতার ও গভীর অনুসন্ধানের দায় রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা এই প্রতিবেদনকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আখ্যা দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য এটা শিক্ষা হবে।
কিন্তু একটা পুরো প্রজন্ম এই অন্ধকার সময়টার ব্যাপারে খুব সামান্য তথ্য নিয়ে বড় হয়েছে।
ন্যায়বিচারের পথে : এরপর কী?
এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার মাত্র শুরু হলো, শেষ নয়। চিফ প্রসিকিউটর বলেছেন, এর একাংশ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটা দেশ ও দেশের বাইরে বড় ঘটনা হয়ে উঠবে। ৩৩ জনের সফরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আদালতের আরো পদক্ষেপ সামনে দেখা যাবে।
চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। চলমান তদন্তের জন্য প্রতিবেদনে কিছু নাম গোপন করা হয়েছে। অভিযুক্ত কেউ কেউ দেশের বাইরে রয়েছে। রাজনীতিও এখন উত্তপ্ত। বড় ধরনের পদক্ষেপ চালু থাকলে অস্থিরতার ঝুঁকি থেকেই যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন আর স্থিতিশীলতার অজুহাতে সত্য গোপন করে রাখতে পারবে না।
ন্যায়বিচার হবে কি না—এটা আর ইস্যু নয়। প্রশ্ন হলো, এর আগে আমরা যেমনটা দেখেছি, সে রকম ন্যায্য, খোলামেলা এবং কোনো কূটকৌশল ছাড়া বিচারটা হবে কি না।
শেষ কথা : সত্যের দ্বারপ্রান্তে জাতি
বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল বিদ্রোহের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। জাতির মননে এটা আঘাত করেছে। রাষ্ট্র আর জনগণের আস্থা, সেনাবাহিনী ও আইন, অধিকার এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ—সবকিছুতেই আঘাত হেনেছে এটি। কমিশনের প্রতিবেদনে এগুলো শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা চিরদিনের জন্য বদলে গেছে।
এখানে নেতাদের নাম এসেছে। সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা ও বাহিনীগুলোর ব্যর্থতা উঠে এসেছে। যেটাকে অভ্যন্তরীণ মনে হয়েছিল, সেটাকে ভেতর আর বাইরের সম্মিলিত চক্রান্ত হিসেবে এটা হাজির করেছে। এই প্রতিবেদন জাতিকে অতীতের মুখোমুখি স্বচ্ছতা নিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। সত্য কঠিন হলেও জাতিকে উপশম দেবে। কারণ অনেক দীর্ঘ সময় প্রশ্ন, ভয় আর অনুমানের আধো অন্ধকারে আটকে ছিল জাতি।
এখন প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ স্বচ্ছতার দিকে হাঁটবে। সামনের পথে আইন, রাজনীতি আর কূটনীতির লড়াই অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপে দোষারোপ করা হয়েছে। পরিবারগুলোর কণ্ঠ আছে। নীরব প্রশ্নগুলো মানুষ শুনতে পেয়েছে। বাংলাদেশকে অবশ্যই এই নীরবতা থেকে ন্যায়বিচারের পথে হাঁটতে হবে।
একমাত্র সাহসিকতা, স্বচ্ছতা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই বাংলাদেশের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব, যাতে পিলখানা আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত না হয়।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক


আট দলের ঐক্য আরো ‘সুদৃঢ়’, উজ্জীবিত নেতাকর্মী
আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া ও দুটি ঘটনা
সিরিয়ার দখল করা ভূখণ্ড ছাড়বে না ইসরাইল: নেতানিয়াহু
৮৫ হাজার ইসরাইলি সেনার মানসিক চিকিৎসা গ্রহণ
আবেদন দেড় হাজার, নিষ্পত্তি ৯০০
শিথিল করা হচ্ছে আচরণবিধি, প্রচারে সুবিধা পাবেন প্রার্থীরা
মতলবে ধনাগোদা নদীর সেতুতে ভাঙন, ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল