মাহবুব উল্লাহ
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি দলিল। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন জনগোষ্ঠী, ভূখণ্ড, আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব। একটি ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী তাদের যৌথ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নেয়।
জনগণের যৌথ ইচ্ছার দলিল হলো রাষ্ট্রীয় সংবিধান। সংবিধান একটি সামাজিক চুক্তি বই আর কিছু নয়। একটি ভূখণ্ডে জনগোষ্ঠী তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় সংবিধানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় জীবনে নাগরিকরা তাদের আচার-আচরণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে সংবিধান দলিল প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। অনেকের মতে, এই সংবিধানটি একটি আদর্শ দলিল। কিন্তু এই সংবিধান বারবার সংশোধন করা হয় এবং এর ধারা-উপধারা কাটাছেঁড়া করা হয়। এই মুহূর্তে সংবিধানের যে রূপ দাঁড়িয়েছে, তা দেখে এটাকে ১৯৭২ সালের সংবিধান রূপে চেনা যায় না। এই সংবিধানের সবচাইতে ভয়ংকর সংশোধনী করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার দলিলে পরিবর্তিত করে।
সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি সরকারি দল গঠন করা হয়। দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সব সংবাদপত্র বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কেবল চারটি সংবাদপত্র রাখা হয়। বাকশালী সংবিধান প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের একটি বড় বন্দিশালার বন্দি হিসেবে ভাবতে শুরু করে।
কথা বলা ও প্রতিবাদ করার অধিকার রহিত করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি আমলে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন; তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে বসে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের সংবিধানে যে পরিবর্তন আনেন, তার ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয় একটি একনায়কত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।
সৌভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষকে বাকশালী শাসনের লা’নত খুব বেশি দিন ভোগ করতে হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুজিবি শাসনের পতন ঘটে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে পায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়।
গভীরভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করলে বুঝতে কষ্ট হবে না যে, ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনা করা হয়েছিল এক ব্যক্তি মুজিবকে সামনে রেখে। তা ছাড়া এই সংবিধান যে গণপরিষদ প্রণয়ন করে, সেই গণপরিষদ নিয়েও ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নকালে আপত্তি উঠেছিল।
পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়। অথচ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য তাদের কোনো ম্যানডেট ছিল না। মওলানা ভাসানীসহ বিরোধী দলের নেতারা একটি জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এসব কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। বাংলাদেশে এখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। এই সরকার গণঅভ্যুত্থান থেকে তার বৈধতা পেয়েছে। সুপ্রিম কোর্টও এই সরকারকে বৈধ ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়ার পর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন। সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম বাংলায় জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাখার প্রস্তাব করেছে। তবে রাষ্ট্রের ইংরেজি নামে কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় রাষ্ট্রের নাম ‘People’s Republic of Bangladesh’ বহাল থাকবে। কমিশনের এই সুপারিশে অনেকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য দেখতে পেয়েছেন। কমিশন যে কারণে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে, তার মূলে রয়েছে ‘প্রজা’ শব্দটি নিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীর আপত্তি। এই শব্দটি ব্যবহারের ফলে মনে হয় রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাজার অধীনে প্রজা মাত্র।
প্রজাতন্ত্র শব্দটি নিয়ে আপত্তির কারণেই ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পরিবর্তনে কোনো দোষ দেখি না, বরং সমর্থন করি। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন তরুণ নেতা (এই লেখকসহ) পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার যে কর্মসূচি ঢাকার পল্টন ময়দানে উত্থাপন করেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচি’।
এদিক থেকে ভেবে আনন্দ পাই, আমরা কজন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, অন্তত নামের দিকে হলেও তার এক ধরনের স্বীকৃতি দেখতে পাচ্ছি। তবে আমাদের স্বপ্নের জনগণতন্ত্র বাংলাদেশে কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একসময়কার পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো জনগণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিল। এখনো চীন, ভিয়েতনাম ও লাওস জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।
কমিশন পাঁচটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। এখন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলনীতিতে যে পরিবর্তন আনেন, তাতে ছিল আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি মূলনীতি যথাক্রমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বিতর্কের মধ্যে পড়ে যায়। নাগরিকদের অনেকে ভাবতে থাকেন, ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মহীনতা।
এ কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার বলতে হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বলে মানুষকে যেভাবে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, মানুষ তাতে আস্থা রাখতে পারেনি। তার কারণ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো বাংলাদেশে এমন কিছু সাংস্কৃতিক প্রতীকের প্রচলন করতে চেয়েছে, যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই বিতর্ক দীর্ঘ হয়েছে। বর্তমান কমিশন ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় বহুত্ববাদের সুপারিশ করেছে।
এতেও যথেষ্ট বিতর্ক হচ্ছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশের মুসলমান নাগরিকরা একত্ববাদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী, তারা বহুত্ববাদী হতে পারে না। যতদূর বুঝতে পারছি, তা হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন ইংরেজি ‘প্লুরালিজম’ শব্দটির বাংলা অনুবাদ করেছে ‘বহুত্ববাদ’। এতেই গোল বেধেছে। প্লুরালিজমের বাংলা তর্জমা হতে পারত বহুবাচনিকতা। তাহলে হয়তো এমন আপত্তি উঠত না। এ কথা মানি, আধুনিক গণতন্ত্রের অভিধানে প্লুরালিজম শব্দটি বহুল ব্যবহৃত।
তবে এদেশের অনেকে ভাবতে শুরু করেছে বহুত্ববাদ দিয়ে LGBT ধারণা সুকৌশলে সংবিধানে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা নানামুখী বিতর্কে এতই জর্জর যে আমরা আর নতুন করে কোনো বির্তকের জন্ম দিতে চাই না। সবচেয়ে নিরাপদ হলো ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। অপরদিকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে অনেকে ‘আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস’ নীতিটির পুনঃপ্রবর্তন চাইছেন।
কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে এক ধরনের জাতীয় সহমত সৃষ্টি হয়েছে। এই আইনসভার উচ্চকক্ষে জ্ঞানী, গুণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা থাকবে বলে ধারণা করি। তারা নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। জানা যায়নি উচ্চকক্ষের সদস্যরা কাদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। ধারণা করি, নিম্নকক্ষের সদস্যদের ভোটে তারা নির্বাচিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ চার বছরে নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেভাবেই হোক আমরা পাঁচ বছরের নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
পাঁচ বছরকে চার বছর করার কোনো জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়নি। মেয়াদ পাঁচ বছর রাখলে নির্বাচিত সরকার তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে সন্তোষজনক সময় পাবে। এ সময়টা দেওয়া অযৌক্তিক নয়। তবে মনে হয়, কমিশন ভেবেছে আইনসভার মেয়াদ এক বছর কমিয়ে আনলে ক্ষমতাসীনদের মৌরসিপাট্টা প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সংকুচিত হবে। কমিশন আরও বলেছে, ১০ শতাংশ আসনে রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে।
কোটা প্রথার বিরুদ্ধে সফল আন্দোলনের পর কেন নতুন করে তরুণ-তরুণীদের জন্য কোটার সুপারিশ করা হলো, তা বোধগম্য নয়। নির্বাচন প্রার্থীর বয়স ২৫ বছর থেকে ২১ বছরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের যা বাস্তব অবস্থা, তাতে বর্তমান শিক্ষা কাঠামোয় ২৩ বছরের আগে মাস্টার্স ডিগ্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া সেশন জটের সমস্যা থাকলে শিক্ষাজীবন আরও প্রলম্বিত হতে পারে। এই অবস্থায় প্রার্থিতার বয়স ২১ বছর হলে প্রার্থীদের উচ্চশিক্ষা সমাপন না করেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রলুব্ধ করা হচ্ছে।
কমিশন সুপারিশ করেছে, অর্থ বিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখবেন। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সংবিধানের ৭০ ধারা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তার অবসান হবে। সংসদ সদস্যরা নিজ বিবেকে প্রণোদিত হয়ে অনেক প্রশ্নে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবেন। এর ফলে আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সুরক্ষিত হবে।
তবে কী কী ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন, তা স্পষ্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। কমিশন নারী আসনেও সরাসরি ভোট প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবটি গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশের নারীদের মধ্য থেকে অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ফলে তাদের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দুরূহ কিছু হবে না। কিন্তু নারী আসন যেভাবে নির্ধারিত হবে, তা একটি জটিল প্রক্রিয়ার জন্ম দেবে। রোটেশন পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। এই পদ্ধতি খুবই জটিল।
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কেউ দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এই সুপারিশের মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হওয়ার যে অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করেছি, তার অবসান ঘটবে বৈকি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কালচারে এই ব্যবস্থা চালু করা দুরূহ হয়ে উঠতে পারে।
সংবিধান সংস্কার করে অথবা পুনর্লিখন করে একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে উপনীত হওয়া জাতির অস্তিত্বের জন্য খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। বেগম খালেদা জিয়া তার ভিশন-২০৩০ দলিলে কারারুদ্ধ হওয়ার আগেই বলেছিলেন, ‘একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে আমাদের উপনীত হতে হবে।’
তবে প্রশ্ন ওঠে—সামাজিক চুক্তির দলিলটি, অর্থাৎ সংবিধান দলিলটি কোন প্রক্রিয়ায় গৃহীত হবে? এটা কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেবে, অথবা একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হবে? সে ক্ষেত্রে সংসদের স্ট্যাটাস কী দাঁড়াবে? এটা কি শুধুই গণপরিষদ হবে, অথবা যুগপৎ গণপরিষদ ও আইনসভাও হবে? আমি ধারণা করি, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ তৈরি হবে, সেটি যুগপৎ আইনসভা ও গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করলে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সহজ হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে। আইনসভার নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে হবে নিম্নকক্ষ। এর মধ্যে ৩০০ সদস্য নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর ১০০ নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলার নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এই ব্যবস্থা হলে বেশ কিছু এলাকায় পুরুষ ও নারী মিলিয়ে দুই প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন।
ফলে এক ধরনের ওভারল্যাপ অবস্থার সৃষ্টি হবে। গণতন্ত্রের অনুশীলনে এই ওভারল্যাপ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সংবিধান কমিশন রাষ্ট্রপতির মেয়াদও চার বছর করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া নির্বাচন করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এটি মূলত কাজের দিক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। এ বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো হলো—কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগপ্রাপ্ত হবে এবং সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন। এ ছাড়া কমিশন সাংবিধানিক কাউন্সিল, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে গভীর ও বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। আশা করি এ বিষয়ে সুধীজনরা নিজ নিজ মতামত তুলে ধরবেন, যার উদ্দেশ্য হবে একটি জাতীয় সহমত প্রতিষ্ঠা। অনেকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছেন।
বিশেষ করে এই বক্তব্যের প্রবক্তা হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অর্থনীতি বিভাগের বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. মুস্তাক খান। তার দৃষ্টিতে নতুন এই বন্দোবস্ত সফল হতে পারে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন ঘটেছে। এমন একটি সংবিধান চাই, যে সংবিধান ক্ষমতার এই কেন্দ্রায়নকে ক্রমান্বয়ে শিথিল করতে সক্ষম হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনি দলিল। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন জনগোষ্ঠী, ভূখণ্ড, আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব। একটি ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী তাদের যৌথ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নেয়।
জনগণের যৌথ ইচ্ছার দলিল হলো রাষ্ট্রীয় সংবিধান। সংবিধান একটি সামাজিক চুক্তি বই আর কিছু নয়। একটি ভূখণ্ডে জনগোষ্ঠী তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় সংবিধানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় জীবনে নাগরিকরা তাদের আচার-আচরণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে সংবিধান দলিল প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। অনেকের মতে, এই সংবিধানটি একটি আদর্শ দলিল। কিন্তু এই সংবিধান বারবার সংশোধন করা হয় এবং এর ধারা-উপধারা কাটাছেঁড়া করা হয়। এই মুহূর্তে সংবিধানের যে রূপ দাঁড়িয়েছে, তা দেখে এটাকে ১৯৭২ সালের সংবিধান রূপে চেনা যায় না। এই সংবিধানের সবচাইতে ভয়ংকর সংশোধনী করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার দলিলে পরিবর্তিত করে।
সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি সরকারি দল গঠন করা হয়। দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। সব সংবাদপত্র বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কেবল চারটি সংবাদপত্র রাখা হয়। বাকশালী সংবিধান প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের একটি বড় বন্দিশালার বন্দি হিসেবে ভাবতে শুরু করে।
কথা বলা ও প্রতিবাদ করার অধিকার রহিত করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি আমলে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন; তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে বসে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের সংবিধানে যে পরিবর্তন আনেন, তার ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয় একটি একনায়কত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।
সৌভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষকে বাকশালী শাসনের লা’নত খুব বেশি দিন ভোগ করতে হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুজিবি শাসনের পতন ঘটে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে পায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়।
গভীরভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করলে বুঝতে কষ্ট হবে না যে, ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনা করা হয়েছিল এক ব্যক্তি মুজিবকে সামনে রেখে। তা ছাড়া এই সংবিধান যে গণপরিষদ প্রণয়ন করে, সেই গণপরিষদ নিয়েও ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নকালে আপত্তি উঠেছিল।
পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়। অথচ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য তাদের কোনো ম্যানডেট ছিল না। মওলানা ভাসানীসহ বিরোধী দলের নেতারা একটি জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এসব কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। বাংলাদেশে এখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। এই সরকার গণঅভ্যুত্থান থেকে তার বৈধতা পেয়েছে। সুপ্রিম কোর্টও এই সরকারকে বৈধ ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়ার পর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন। সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
কমিশন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম বাংলায় জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাখার প্রস্তাব করেছে। তবে রাষ্ট্রের ইংরেজি নামে কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় রাষ্ট্রের নাম ‘People’s Republic of Bangladesh’ বহাল থাকবে। কমিশনের এই সুপারিশে অনেকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য দেখতে পেয়েছেন। কমিশন যে কারণে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে, তার মূলে রয়েছে ‘প্রজা’ শব্দটি নিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীর আপত্তি। এই শব্দটি ব্যবহারের ফলে মনে হয় রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাজার অধীনে প্রজা মাত্র।
প্রজাতন্ত্র শব্দটি নিয়ে আপত্তির কারণেই ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পরিবর্তনে কোনো দোষ দেখি না, বরং সমর্থন করি। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন তরুণ নেতা (এই লেখকসহ) পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার যে কর্মসূচি ঢাকার পল্টন ময়দানে উত্থাপন করেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচি’।
এদিক থেকে ভেবে আনন্দ পাই, আমরা কজন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, অন্তত নামের দিকে হলেও তার এক ধরনের স্বীকৃতি দেখতে পাচ্ছি। তবে আমাদের স্বপ্নের জনগণতন্ত্র বাংলাদেশে কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একসময়কার পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো জনগণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিল। এখনো চীন, ভিয়েতনাম ও লাওস জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।
কমিশন পাঁচটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। এখন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলনীতিতে যে পরিবর্তন আনেন, তাতে ছিল আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি মূলনীতি যথাক্রমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বিতর্কের মধ্যে পড়ে যায়। নাগরিকদের অনেকে ভাবতে থাকেন, ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মহীনতা।
এ কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার বলতে হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। শেখ মুজিবুর রহমান এ কথা বলে মানুষকে যেভাবে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, মানুষ তাতে আস্থা রাখতে পারেনি। তার কারণ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো বাংলাদেশে এমন কিছু সাংস্কৃতিক প্রতীকের প্রচলন করতে চেয়েছে, যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই বিতর্ক দীর্ঘ হয়েছে। বর্তমান কমিশন ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় বহুত্ববাদের সুপারিশ করেছে।
এতেও যথেষ্ট বিতর্ক হচ্ছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশের মুসলমান নাগরিকরা একত্ববাদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী, তারা বহুত্ববাদী হতে পারে না। যতদূর বুঝতে পারছি, তা হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন ইংরেজি ‘প্লুরালিজম’ শব্দটির বাংলা অনুবাদ করেছে ‘বহুত্ববাদ’। এতেই গোল বেধেছে। প্লুরালিজমের বাংলা তর্জমা হতে পারত বহুবাচনিকতা। তাহলে হয়তো এমন আপত্তি উঠত না। এ কথা মানি, আধুনিক গণতন্ত্রের অভিধানে প্লুরালিজম শব্দটি বহুল ব্যবহৃত।
তবে এদেশের অনেকে ভাবতে শুরু করেছে বহুত্ববাদ দিয়ে LGBT ধারণা সুকৌশলে সংবিধানে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা নানামুখী বিতর্কে এতই জর্জর যে আমরা আর নতুন করে কোনো বির্তকের জন্ম দিতে চাই না। সবচেয়ে নিরাপদ হলো ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। অপরদিকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে অনেকে ‘আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস’ নীতিটির পুনঃপ্রবর্তন চাইছেন।
কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে এক ধরনের জাতীয় সহমত সৃষ্টি হয়েছে। এই আইনসভার উচ্চকক্ষে জ্ঞানী, গুণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা থাকবে বলে ধারণা করি। তারা নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। জানা যায়নি উচ্চকক্ষের সদস্যরা কাদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। ধারণা করি, নিম্নকক্ষের সদস্যদের ভোটে তারা নির্বাচিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ চার বছরে নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেভাবেই হোক আমরা পাঁচ বছরের নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
পাঁচ বছরকে চার বছর করার কোনো জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়নি। মেয়াদ পাঁচ বছর রাখলে নির্বাচিত সরকার তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে সন্তোষজনক সময় পাবে। এ সময়টা দেওয়া অযৌক্তিক নয়। তবে মনে হয়, কমিশন ভেবেছে আইনসভার মেয়াদ এক বছর কমিয়ে আনলে ক্ষমতাসীনদের মৌরসিপাট্টা প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সংকুচিত হবে। কমিশন আরও বলেছে, ১০ শতাংশ আসনে রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে।
কোটা প্রথার বিরুদ্ধে সফল আন্দোলনের পর কেন নতুন করে তরুণ-তরুণীদের জন্য কোটার সুপারিশ করা হলো, তা বোধগম্য নয়। নির্বাচন প্রার্থীর বয়স ২৫ বছর থেকে ২১ বছরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের যা বাস্তব অবস্থা, তাতে বর্তমান শিক্ষা কাঠামোয় ২৩ বছরের আগে মাস্টার্স ডিগ্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া সেশন জটের সমস্যা থাকলে শিক্ষাজীবন আরও প্রলম্বিত হতে পারে। এই অবস্থায় প্রার্থিতার বয়স ২১ বছর হলে প্রার্থীদের উচ্চশিক্ষা সমাপন না করেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রলুব্ধ করা হচ্ছে।
কমিশন সুপারিশ করেছে, অর্থ বিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখবেন। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সংবিধানের ৭০ ধারা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তার অবসান হবে। সংসদ সদস্যরা নিজ বিবেকে প্রণোদিত হয়ে অনেক প্রশ্নে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবেন। এর ফলে আইন প্রণয়নে সংসদ সদস্যদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সুরক্ষিত হবে।
তবে কী কী ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন, তা স্পষ্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। কমিশন নারী আসনেও সরাসরি ভোট প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবটি গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশের নারীদের মধ্য থেকে অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ফলে তাদের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দুরূহ কিছু হবে না। কিন্তু নারী আসন যেভাবে নির্ধারিত হবে, তা একটি জটিল প্রক্রিয়ার জন্ম দেবে। রোটেশন পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। এই পদ্ধতি খুবই জটিল।
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কেউ দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এই সুপারিশের মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হওয়ার যে অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করেছি, তার অবসান ঘটবে বৈকি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কালচারে এই ব্যবস্থা চালু করা দুরূহ হয়ে উঠতে পারে।
সংবিধান সংস্কার করে অথবা পুনর্লিখন করে একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে উপনীত হওয়া জাতির অস্তিত্বের জন্য খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। বেগম খালেদা জিয়া তার ভিশন-২০৩০ দলিলে কারারুদ্ধ হওয়ার আগেই বলেছিলেন, ‘একটি নতুন সামাজিক চুক্তিতে আমাদের উপনীত হতে হবে।’
তবে প্রশ্ন ওঠে—সামাজিক চুক্তির দলিলটি, অর্থাৎ সংবিধান দলিলটি কোন প্রক্রিয়ায় গৃহীত হবে? এটা কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেবে, অথবা একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হবে? সে ক্ষেত্রে সংসদের স্ট্যাটাস কী দাঁড়াবে? এটা কি শুধুই গণপরিষদ হবে, অথবা যুগপৎ গণপরিষদ ও আইনসভাও হবে? আমি ধারণা করি, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ তৈরি হবে, সেটি যুগপৎ আইনসভা ও গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করলে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সহজ হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে। আইনসভার নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে হবে নিম্নকক্ষ। এর মধ্যে ৩০০ সদস্য নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর ১০০ নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলার নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এই ব্যবস্থা হলে বেশ কিছু এলাকায় পুরুষ ও নারী মিলিয়ে দুই প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন।
ফলে এক ধরনের ওভারল্যাপ অবস্থার সৃষ্টি হবে। গণতন্ত্রের অনুশীলনে এই ওভারল্যাপ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সংবিধান কমিশন রাষ্ট্রপতির মেয়াদও চার বছর করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া নির্বাচন করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এটি মূলত কাজের দিক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। এ বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো হলো—কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগপ্রাপ্ত হবে এবং সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন। এ ছাড়া কমিশন সাংবিধানিক কাউন্সিল, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে গভীর ও বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। আশা করি এ বিষয়ে সুধীজনরা নিজ নিজ মতামত তুলে ধরবেন, যার উদ্দেশ্য হবে একটি জাতীয় সহমত প্রতিষ্ঠা। অনেকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলেছেন।
বিশেষ করে এই বক্তব্যের প্রবক্তা হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অর্থনীতি বিভাগের বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. মুস্তাক খান। তার দৃষ্টিতে নতুন এই বন্দোবস্ত সফল হতে পারে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন ঘটেছে। এমন একটি সংবিধান চাই, যে সংবিধান ক্ষমতার এই কেন্দ্রায়নকে ক্রমান্বয়ে শিথিল করতে সক্ষম হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১১ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে