ভাষা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অন্যতম উৎস। এটি কেবল শব্দের সমষ্টি নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রতীক। কিন্তু পুঁজিবাদ ও রাজনৈতিক শাসনযন্ত্রের সম্প্রসারণের পথে ভাষার বৈচিত্র্যকে বারবার বাধা হিসেবে দেখা হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী তাই নিজেদের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার স্বার্থে ভাষার বৈচিত্র্যকে সংকুচিত করে একক ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আজকের দক্ষিণ এশীয় পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবণতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিশেষত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বাংলাভাষীরা হিন্দুত্ববাদী পুঁজিবাদ ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের চাপে তাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হারানোর ঝুঁকিতে দাঁড়িয়ে আছে।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেন তাদের উপনিবেশে শাসন ও বাণিজ্যের সুবিধার্থে নিজস্ব ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষার আগ্রাসনের ফলে অনেক স্থানীয় ভাষা হারিয়ে যায় বা বিলুপ্ত হয়।
আজকের বিশ্বায়িত যুগেও একই কৌশল বহাল আছে। আন্তর্জাতিক করপোরেট পুঁজিবাদ ইংরেজিকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও প্রযুক্তির একচ্ছত্র ভাষা বানিয়েছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী, প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে একটি ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে; এরই মধ্যে আড়াই হাজারের মতো ভাষা বিপন্ন তালিকাভুক্ত।
ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষা বিলুপ্তির হার আশঙ্কাজনক। ২০১০ সালে গণেশ এন দেবীর গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে প্রায় এক হাজার ভাষা হারিয়ে গেছে। বর্তমানে ছয় শতাধিক ভাষা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর পেছনে একদিকে আধুনিক জীবনধারা ও শহরমুখিতা যেমন কাজ করছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ভাষানীতি এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আগ্রাসন প্রধান ভূমিকা রাখছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি’ নীতিকে সামনে এনে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের ভাষাগত জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দিতে চাইছে। এর লক্ষ্য স্পষ্ট—উত্তর ভারতের ক্ষমতাকাঠামোকে শক্তিশালী করা এবং ভাষার বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে হিন্দি-ভাষিক অভিন্নতাকে জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক বানানো।
এই কৌশল নিছক সাংস্কৃতিক নয়; বরং এটি একটি পুঁজিবাদী-রাজনৈতিক প্রকল্প। করপোরেট বাজার ও প্রশাসনিক শাসনকে সহজতর করতে তারা বহুভাষিক ভারতের ওপর হিন্দিকে একক ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছে। ভাষাগত বৈচিত্র্য, যা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মৌল ভিত্তি হওয়া উচিত, সেটিকেই ধ্বংস করা হচ্ছে।
এই আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় আঘাত আসছে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বাংলাভাষীদের ওপর। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের শিল্পক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে মন্দা চলছে। চা-শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত, কৃষি অলাভজনক এবং কর্মসংস্থান সীমিত, ফলে অনেক মানুষ অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধান করছে। কিন্তু বাংলাভাষী হওয়ার কারণে তাদের প্রায়ই ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। তরুণ প্রজন্মকে বোঝানো হচ্ছে, হিন্দি বা ইংরেজি শিখলেই কেবল উন্নত শিক্ষা ও ক্যারিয়ার সম্ভব। ফলে মাতৃভাষা বাংলা প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। কলকাতার তরুণ সমাজে হিন্দি সিনেমা, গান ও বিনোদনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলার সাহিত্য, নাটক বা গান সাংস্কৃতিক মূলধারায় নিজের অবস্থান হারাচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে তরুণদের মধ্যে বাংলা ভাষা চর্চা কমে যাচ্ছে। আসামে বাংলাভাষীদের প্রায়ই বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত করা হয়। রাজনৈতিক প্রচারণার মাধ্যমে তাদের জীবন ও কর্মের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হয়। এটি কেবল ভাষাগত বৈষম্য নয়, বরং রাজনৈতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে এক ধরনের জাতিগত নিপীড়ন।
ভারতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা নতুন নয়। ১৯৬৫ সালে তামিলনাড়ুতে হিন্দি বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ ছাত্র-আন্দোলনের জন্ম দেয়। একই ধরনের প্রতিরোধ মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও দেখা গেছে। কিন্তু দিল্লির শাসকগোষ্ঠী এখনো একই নীতিতে অটল। হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা একদিকে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চাইছে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী করপোরেট স্বার্থ পূরণে একক ভাষার বাজার তৈরি করছে।
আজ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বাংলাভাষীরা এক অদৃশ্য সাংস্কৃতিক যুদ্ধের মুখোমুখি। ভাষার বৈচিত্র্য ধ্বংস করা মানে কেবল একটি ভাষা নয়, একটি জাতির আত্মপরিচয় ধ্বংস করা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে আজ বাংলাভাষীরা হিন্দুত্ববাদী পুঁজিবাদ ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের মুখে পড়েছে। এই আগ্রাসন প্রতিহত করতে না পারলে বাংলা ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে পড়বে এবং একসময় ভাষাটির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য এখন দরকার ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক চেতনা, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ। ভাষার উপযোগিতা ধরে রাখাই পারে একটি ভাষাকে জীবিত রাখতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

