বাংলাদেশে কেমন নির্বাচন চায় ভারত

আলফাজ আনাম
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৫, ১১: ১৩
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ১২: ৪৯

বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রকাশ্য নানা ধরনের মন্তব্য করছে। তাদের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশে দ্রুত একটি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে ভারত। অতীতে ভারতের সামরিক নেতৃত্ব প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি।

কিন্তু এবার ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তার অভিমত তুলে ধরছেন। তিনি সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য যথেষ্ট সময় এখনো হয়নি। আগে একটি নির্বাচিত সরকার আসুক, তারপর দেখা যাক সম্পর্ক কোনো দিকে যায়। তারপর দেখা যাবে কী করা যায়।’ (High Degree Of Collusivity : Army Chief On Pakistan, China NDTV MARCH 8, 2025)

বিজ্ঞাপন

ভারতের সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তারা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তার দেশ আগ্রহী নয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হবে নির্বাচনের পর যে সরকার গঠিত হবে সে সরকারের সঙ্গে।

যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে এটাই স্বাভাবিক। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা প্রকৃতপক্ষে সে দেশের জনগণের প্রতিনিধি। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কেমন নির্বাচন ভারত অতীতে দেখতে চেয়েছে আর এখন বা কেমন দেখতে চায়?

এই প্রশ্নের খানিকটা জবাব আমরা পাব ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বলেছেন, ভারত সব সময় স্থিতিশীল, প্রগতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের সমর্থক। ভারত চায়, তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব বিষয়ের নিষ্পত্তি করুক। পাঠকদের ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের দুটি শব্দের দিকে লক্ষ রাখতে বলব, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অন্যটি প্রগতিশীল, যা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।

অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, তা দেখা যাক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির। এর আগে বিচারপতি খায়রুল হকের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হয়। বিরোধী দলগুলো সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছিল।

নির্বাচনের আগে ৪ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং এক ঝটিকা সফরে ঢাকা আসেন। তিনি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন। এসব বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ’সংখ্যক দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন দেখতে চায় ভারত, যার ফলাফল হবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য।

সুজাতা যখন ঢাকায়, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। তিনি যখন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন, সেদিন ছয়জন বিরোধী দলের নেতাকর্মী পুলিশ ও র‌্যাবের গুলিতে নিহত হন। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণে অসম্মতির কথা জানালে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়া থমকে যায়।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে সুজাতার বৈঠকের পর জেনারেল এরশাদ সাংবাদিকদের জানান, তার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন না হলে ‘অগণতান্ত্রিক শক্তি কিংবা জামায়াত-শিবিরের’ উত্থান ঘটতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সুজাতা। ‘আমি তাকে বলেছি, জামায়াত-শিবিরের উত্থান হোক, এটা আমিও চাই না। যদি উত্থান ঘটে, তাহলে সে দায় সরকারের, আমার নয়।’

ভারত সরকার বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে সুজাতা জানিয়েছেন এরশাদকে। জবাবে এরশাদ বলেছেন, ‘এ অবস্থায় দেশে নির্বাচন সম্ভব নয়। এ সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। দেশের মানুষ শেখ হাসিনার পক্ষে নেই।’ (ভোটে ‘সর্বোচ্চ’সংখ্যক দলকে চায় ভারত, বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকম, ৪ ডিসেম্বর-২০১৩)

তিনি আরো জানান, সুজাতা নির্বাচনে অংশ নিতে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর সুজাতার ঢাকা ত্যাগের পর এরশাদকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়। এরপর ১৫৩ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ সময় সুজাতা কোনো অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলেননি, বলেছেন বেশিসংখ্যক দল যাতে ভোটে অংশ নেয়। বিশেষ করে এরশাদের অংশ নেওয়ার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করতে ঢাকা সফর করেন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তখন অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে।

এবার আসা যাক আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ডামি ভোটের আগে ভারতের অবস্থান কী ছিল। ডামি নির্বাচন হয় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। এর আগে নভেম্বরের ১০ তারিখে নয়াদিল্লিতে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টুপ্লাস টু মন্ত্রিপর্যায়ের সংলাপ হয়। সংলাপের পর প্রেস ব্রিফিংকালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেন, ‘আমরা আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছি এবং বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন থাকায় সংলাপে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছি।’

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে সংলাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে কোয়াত্রা বলেন, ‘একটি তৃতীয় দেশের নীতির বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য এটা আমাদের (ভারত) কোনো স্থান নয়। বাংলাদেশে নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে।’

বিনয় মোহন কোয়াত্রা আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করি এবং একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল জাতি হিসেবে দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকবে।’ (India terms Bangladesh’s election ‘internal matter’ TBS 10 November 2023) বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া হাসিনার ডামি নির্বাচনকে ভারত অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করছে। তখন ভারতের রাজনৈতিক বা সামরিক নেতৃত্বের মনে হয়নি, বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা দরকার। অন্যদিকে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের এখন পর্যন্ত তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বলা হয়নি, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না কিংবা নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তাগিদ আছে, যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার। হাসিনার আমলে ভোট ডাকাতির নির্বাচনগুলোয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও, তখন ভারত বলেনি সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। দিল্লির তখন অবস্থান ছিল, বেশিসংখ্যক দলের অংশগ্রহণ, কখনো সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন প্রয়োজন, আবার কখনো বলা হতো নির্বাচন একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে ভারত কেন এখন আগামী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করার দাবি তুলেছে। কারণ একটাই, গণধিকৃত পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট দলটিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে গণধিকৃত ফ্যাসিস্টদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের কৌশল নিয়েছে ভারত। আগামীতে ভারতের অনুগত রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির দিক থেকে এমন দাবি উঠতে পারে। সেই ক্ষেত্র এখন তৈরি করা হচ্ছে।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ভারত তার হার্ড ও সফট পাওয়ারের মাধ্যমে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে, যাতে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এ জন্য রাজনৈতিক দল, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এক ধরনের যোগসাজশ তৈরি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত ও ন্যাচারাল অ্যালাই হিসেবে পরিচিত সাবেক বামপন্থি নেতাদের তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের মুখে বারবার আমরা যে প্রগতিশীল বাংলাদেশের কথা শুনছি, সেটি বামপন্থি রাজনীতির বয়ান। আওয়ামী লীগ সব সময় দাবি করত দলটি প্রগতিশীল ও মধ্যবামপন্থি একটি দল। যদিও এ পরিচয়ের আড়ালে আওয়ামী লীগ বারবার ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। এর শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে একদলীয় বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে। শেখ মুজিবকে তখন সমর্থন দিয়েছিল সিপিবির মতো বামপন্থি দলগুলো। শেখ হাসিনা চূড়ান্তভাবে ফ্যাসিবাদী শাসনের শুরু শাহবাগে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে, যার উদ্যোক্তা ছিল বামপন্থিরা। আমরা আবার দেখছি শাহবাগ ফিরে আনার চেষ্টা চলছে। শাহবাগের নষ্ট তরুণদের সামনে এনে ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে।

যারা আওয়ামী লীগকে ভোটের মাঠে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চেষ্টা করবে, তারা যে আগামী দিনে জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে অংশ নেওয়া তরুণদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন ভারতের অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের নামে আওয়ামী পুনর্বাসনের প্রকল্প নিয়ে তাদের সচেতন হতে হবে। না হলে আবার ভিন্ন নামে ভিন্ন আঙ্গিকে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত