ড. যোবায়ের আল মাহমুদ
গণঅভ্যুত্থানের বৈপ্লবিক কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ সাধন করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা। এটা অবশ্যই একটা বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা এবং তার প্রতি জনমত আছে শুধু না, জনগণ রক্ত দিয়েছে এ জন্যই। জনগণের সেই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক রূপরেখা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়াই বিপ্লবী কাজ। এর জন্য দরকার হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় ধাপ ত্বরান্বিত করা।
বিপ্লব সব সময় সমাজতান্ত্রিক বা ধর্মীয় হতে হবে এমন নয়; এটি উদার গণতান্ত্রিক বিপ্লবও হতে পারে। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানটি ছিল ফরাসি এবং মার্কিন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণাকে ধারণ করে গড়ে ওঠা একটি স্বতন্ত্র বাংলাদেশি গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যার রয়েছে নিজস্ব কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য, গতিশীলতা এবং আকাঙ্ক্ষা। এই গণ-আন্দোলনটি ছিল একটি ফ্যাসিবাদী-কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে চলমান সংবিধানের ভিত্তিতেই দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের পথ খুঁজছেন, তাতে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ডিপ স্টেট, আঞ্চলিক পরাশক্তি ও গ্লোবাল পরাশক্তির সঙ্গে আপসে গিয়ে দেশের বিদ্যমান সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো এবং সিস্টেম বজায় রেখে চলার রাজনীতি শুরু করেছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে দিয়ে পুরানা ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’ অব্যাহত রাখার দিকেই দেশকে নিয়ে গেলে সংকট সমাধান তো হবেই না, উল্টো আরো ঘনীভূত হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব মানে গণসার্বভৌমত্ব নেই, এর মানে এই সংবিধান আসলে সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক নয়। বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সরকার ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার জন্যই সমস্ত প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ঢেলে সাজাবে, অর্থাৎ গণসার্বভৌমত্বই হবে মূল কথা।
অথচ ৭২-এর পর থেকেই বাংলাদেশে ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’ চালু আছে, যেখানে সংসদকে বা সরকারকেই সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষাই এই সংবিধানের মূলশাঁস।
সংসদকে সার্বভৌমত্ব দিয়ে এসব মৌলিক অধিকার দলনের জন্য সব আইনকানুন প্রবর্তনের সুযোগ রেখেছে। ফলে এই সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে এখানে জনগণের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষাই হবে রাষ্ট্র- সরকার-রাজনৈতিক দলের মূল কাজÑ এ রকম প্রস্তাবনা রাখতে হবে। এর ভিত্তিতেই দেশের রাষ্ট্রকাঠামো এবং সরকার ও ক্ষমতা-কাঠামো নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
ছাত্ররা দাবি জানাচ্ছে, জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর গুরুত্ব এখানেই যে, গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে এই প্রোক্লেমেশনের মূল কথা। একে দেশের গঠনতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে হবে। এ রকম বৈপ্লবিক সংস্কার বা নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে অবশ্যই নির্বাচিত সংবিধান সভার মাধ্যমে।
বিএনপিসহ অনেক বুদ্ধিজীবী এখন দাবি করছেন এই সংবিধান সংস্কার করবে জাতীয় সংসদ। যেখানে সংবিধানের ভিত্তিতেই সংসদ গঠন হয়, সেখানে সেই সংসদের হাতে সংবিধান রদবদলের সুযোগ রাখা সংসদকেই সার্বভৌম করে তোলে, জনগণকে নয়। কারণ আমরা দেখেছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচিত হয়ে কীভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী গণনিপীড়নমূলক আইনকানুন সংবিধানসম্মতভাবেই প্রণয়ন করে। ফলে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এই অন্তর্বর্তী সময়েই সংবিধান সভা করে সংবিধানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর না করলে নির্বাচিত দলীয় বা জাতীয় সরকার তা করবে বলে আস্থা রাখা কঠিন।
গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাস পর এভাবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে হাইজ্যাক করার জন্য বাংলাদেশি করপোরেট অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডিপ স্টেট ও বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখন বিদেশি শক্তির সঙ্গে একজোট হয়েছে। এটি স্পষ্ট যে, বর্তমানে এজেন্সি পলিটিকসই নিয়ন্ত্রণের আসনে বসে রয়েছে এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গতিপথকে প্রভাবিত করছে।
ডিপ স্টেট, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো এই গণঅভ্যুত্থানকে শুধু রেজিম চেঞ্জ মনে করছে এবং শুধু ক্ষমতার হাতবদলেই আগ্রহী, যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বাংলাদেশ, যা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে, তা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ অলিগার্কদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে বলেই তারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর সে জন্যই ৯০-এর মতো ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে হাইজ্যাক করার সব আয়োজন চলছে।
পুঁজিতান্ত্রিক গ্লোবাল অর্ডারে প্রান্তিক দুর্বল রাষ্ট্রের সত্যিকারের সার্বভৌমত্ব একদিকে যেমন গ্লোবাল এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধক, অন্যদিকে তা দেশীয় করপোরেট অলিগার্ক গোষ্ঠীর লুটপাটের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রকাঠামো বহুজাতিক কোম্পানির হাতে দেশের সেবা খাতসহ শিল্প খাতকে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে জাতীয় অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। ফলে দেশি-বিদেশি করপোরেট কোম্পানির পুঁজির অবাধপ্রবাহ এবং লুণ্ঠন ও শোষণভিত্তিক অর্থনীতি চালু রাখার উপযোগী করে যে রাষ্ট্রকাঠামো এবং প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো বাংলাদেশে চালু রয়েছে, তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন বাংলাদেশের ডিপ স্টেট এবং বিদেশি শক্তিগুলো এখন সমর্থন করছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আসলে একই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে বলে এই সিস্টেম অব্যাহত রাখার পক্ষে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে সংবিধানের গুণগত পরিবর্তনের বিপক্ষে তাদের এই অবস্থান নেওয়াকে মূলত সাংবিধানিক যে রাষ্ট্রীয়-আইনি-প্রশাসনিক ক্ষমতা-কাঠামো দেশে চালু রয়েছে, তার ভিত্তিতেই শাসনকাজ পরিচালনার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের কনসেনসাস হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে করে দেশের ডিপ স্টেট যেমন নিজেদের লুটেরা মাফিয়া নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারবে এবং বিদেশি পরাশক্তির জিওপলিটিক্যাল স্বার্থও অক্ষুণ্ণ থাকবে। আবার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল তার নিজের গণতান্ত্রিক সংস্কার না করেই শাসনকাজ পরিচালনার নিশ্চয়তা পাবে। নিজ নিজ স্বার্থ সুরক্ষার জন্য ডিপ স্টেট, রাজনৈতিক দল এবং বিদেশি পরাশক্তির যে ঐকমত্য অথবা বোঝাপড়া দেশের বিদ্যমান কাঠামো রক্ষায় কাজ করে, তাকেই তারা নাম দিয়েছে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’।
এই ধারাবাহিকতা রক্ষার রাজনীতি ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যেমন দেখা গেছে, এখন আবার একই রাজনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। ফলে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের যে গণ-অভিপ্রায় মানে দেশের বিদ্যমান সিস্টেমের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, তা আবার হুমকির মুখে পড়েছে।
এখন দায়িত্ব এসে পড়েছে দেশের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ওপর। তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বর্তমান সংবিধান এবং রাষ্ট্রের কাঠামোকে গণতান্ত্রিকীকরণের কৌশল নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রনেতাদের উচিত জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে মানুষ শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলের দিকে মনোযোগ না দিয়ে অগণতান্ত্রিক এবং ‘ফ্যাসিবাদী’ কাঠামো উচ্ছেদ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। পাশাপাশি, শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে সংহতি বাড়ানোও জরুরি। গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় ধাপের এই আন্দোলন ছাড়া আমাদের আর আশা নেই এবং তা সফল না হলে আমরা আবার ‘পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদে’ বন্দি হয়ে যেতে পারি, যা নামমাত্র গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হবে।
গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো এখন দেশি-বিদেশি এজেন্সি পলিটিকসের মুখে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের দাবি থেকে পিছিয়ে গেলে এই অভ্যুত্থান হাইজ্যাক হয়ে যাবে। ছাত্রসমাজ এবং দেশের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শক্তি এখন কীভাবে নতুন করে সংঘটিত হতে পারে, তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে নিজেদের গঠন করে একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার ভবিষ্যৎ। তবে আবার চলমান সংবিধান এবং শাসনতন্ত্র চালু রেখে দেশে লুটপাট-দুর্নীতি-জননিপীড়নের রাজনীতি চালু রাখার দিকেই চলে যাওয়ার বিপদ দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কোনো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি আগে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর একটা বড় সুযোগ ছিল; কিন্তু তখন স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ব্লকের প্রভাবের কারণে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কোনো কাঠামোই আমরা গড়তে পারিনি। সমাজতন্ত্রের নামে স্টেট ক্যাপিটালিজমও কায়েম করা যায়নি, কায়েম হয়েছিল স্টেট লুণ্ঠনতন্ত্র, যেখানে সব শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করলেও জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ হয়নি বরং সবকিছুতে দলীয় মাফিয়াদের লুটপাট কায়েম করে দেশের অর্থনীতির ১২টা বাজিয়ে দেওয়া হয়। আর একটা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র তৈরি করা হয়নি, যেখানে ব্যক্তির বিকাশ এবং অধিকার সুরক্ষাকেই পুরো রাষ্ট্রের এবং রাজনীতির মূল লক্ষ ধরে সব ঢেলে সাজানো হবে। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আরেকটা সুযোগ আসছিল; কিন্তু সেখানেও এ দেশের রাজনীতিবিদরা এবং চিন্তাবিদরা নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে ব্যক্তিকেই সার্বভৌম ধরে ব্যক্তি নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার এবং দৈহিক, আত্মিক এবং স্পিরিচুয়াল বিকাশকেই রাষ্ট্র এবং তার সব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ধরে সবকিছুকে সাজানো এবং তাকে ঘিরেই রাজনীতির আবর্তন, এভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা যায় গণসার্বভৌমত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা গঠনতন্ত্রে এ বিষয়টি ট্রান্সলেট করতে পারিনি। বাংলাদেশে যে বুর্জোয়া লিবারেল ডেমোক্রেসির বিকাশ হয়নি, তার প্রধান কারণ, এখানে সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হলেও গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কাঠামো নেই বরং কলোনিয়াল এবং সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো রয়ে গেছে। ফলে এখানকার রাজনৈতিক দল, শিল্প-কারখানা, বাজার সিস্টেম, বিশ্ববিদ্যালয়, সেবা খাত সব জায়গায় দেখবেন মাফিয়াতন্ত্র অথবা সামন্ততন্ত্র কিংবা কলোনিয়াল নিপীড়নযন্ত্র। দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে না তুলেই যখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নিওলিবারেল পলিসি কায়েম শুরু হয়েছে এ দেশে, তখন তা জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে যেমন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, একইভাবে গণমানুষের অধিকারকে আরো নেই করে দিচ্ছে।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে যদি আমরা একটা লিবারেল ডেমোক্রেটিক রেভলেশনেও রুপান্তরিত করতে পারি, যেখানে দেশের সব নাগরিকের বিকাশের সুরক্ষার জন্য রাজনীতি, অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার কাঠামো, সংসদÑ সবকিছুকে আমূল পরিবর্তন করে একটা গণমুখী সমাজ রাষ্ট্র গঠন করা যাবে, তাহলে এটাই হবে দেশের জাতীয় সক্ষমতার বিকাশের পথ। রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়া তাই অর্থনীতিক বিপ্লব সম্ভব হবে না আমাদের জন্য। ফলে গণঅভ্যুত্থানকে কীভাবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক রেভলুশনে ট্রান্সলেট করা যায়, সে জন্য কাজ করা দরকার দেশের বুদ্ধিজীবীদের এবং গণমুখী রাজনীতিবিদদের।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচিত বিদেশি শক্তির কথামতো না চলে গণঅভ্যুত্থানের গণশক্তির ওপর নির্ভর করে নিজেদের রাজনীতি করা। রাজনীতিবিদরা যদি তাদের পুরোনা রাজনীতি বহাল রেখে দায়সারা গোছের সংস্কার করে শাসনকাজ পরিচালনা করেন, তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশ না হয়ে আবার সব আগের মতোই চলবে। তাই এই মুহূর্তে দরকার গণঅভ্যুত্থানকে সেকেন্ড ফেজে নিয়ে যাওয়াÑ মানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য দেশের চিন্তক, বুদ্ধিজীবী, সিভিল সোসাইটি এবং মাঠের ত্যাগী গণমুখী রাজনীতিবিদদের ভূমিকা পালন করা। ডিপ স্টেট এবং বিদেশি পাওয়ার হাউস চাইবে এসব নস্যাৎ করে দিতে। কারণ শক্তিশালী স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যদি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে গড়ে ওঠে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে নিজের স্বাধীনতাকে সুসংহত করে, তাহলে পরাশক্তির দাস রাষ্ট্র হিসেবে আর বাংলাদেশ কাজ করবে না।
লেখক : চিন্তক, সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণঅভ্যুত্থানের বৈপ্লবিক কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ সাধন করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা। এটা অবশ্যই একটা বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা এবং তার প্রতি জনমত আছে শুধু না, জনগণ রক্ত দিয়েছে এ জন্যই। জনগণের সেই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক রূপরেখা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়াই বিপ্লবী কাজ। এর জন্য দরকার হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় ধাপ ত্বরান্বিত করা।
বিপ্লব সব সময় সমাজতান্ত্রিক বা ধর্মীয় হতে হবে এমন নয়; এটি উদার গণতান্ত্রিক বিপ্লবও হতে পারে। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানটি ছিল ফরাসি এবং মার্কিন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণাকে ধারণ করে গড়ে ওঠা একটি স্বতন্ত্র বাংলাদেশি গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যার রয়েছে নিজস্ব কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য, গতিশীলতা এবং আকাঙ্ক্ষা। এই গণ-আন্দোলনটি ছিল একটি ফ্যাসিবাদী-কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে চলমান সংবিধানের ভিত্তিতেই দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের পথ খুঁজছেন, তাতে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ডিপ স্টেট, আঞ্চলিক পরাশক্তি ও গ্লোবাল পরাশক্তির সঙ্গে আপসে গিয়ে দেশের বিদ্যমান সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো এবং সিস্টেম বজায় রেখে চলার রাজনীতি শুরু করেছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে দিয়ে পুরানা ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’ অব্যাহত রাখার দিকেই দেশকে নিয়ে গেলে সংকট সমাধান তো হবেই না, উল্টো আরো ঘনীভূত হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব মানে গণসার্বভৌমত্ব নেই, এর মানে এই সংবিধান আসলে সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক নয়। বুর্জোয়া উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সরকার ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষার জন্যই সমস্ত প্রশাসনিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ঢেলে সাজাবে, অর্থাৎ গণসার্বভৌমত্বই হবে মূল কথা।
অথচ ৭২-এর পর থেকেই বাংলাদেশে ‘সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র’ চালু আছে, যেখানে সংসদকে বা সরকারকেই সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষাই এই সংবিধানের মূলশাঁস।
সংসদকে সার্বভৌমত্ব দিয়ে এসব মৌলিক অধিকার দলনের জন্য সব আইনকানুন প্রবর্তনের সুযোগ রেখেছে। ফলে এই সংবিধানের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে এখানে জনগণের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষাই হবে রাষ্ট্র- সরকার-রাজনৈতিক দলের মূল কাজÑ এ রকম প্রস্তাবনা রাখতে হবে। এর ভিত্তিতেই দেশের রাষ্ট্রকাঠামো এবং সরকার ও ক্ষমতা-কাঠামো নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
ছাত্ররা দাবি জানাচ্ছে, জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর গুরুত্ব এখানেই যে, গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে এই প্রোক্লেমেশনের মূল কথা। একে দেশের গঠনতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে হবে। এ রকম বৈপ্লবিক সংস্কার বা নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে অবশ্যই নির্বাচিত সংবিধান সভার মাধ্যমে।
বিএনপিসহ অনেক বুদ্ধিজীবী এখন দাবি করছেন এই সংবিধান সংস্কার করবে জাতীয় সংসদ। যেখানে সংবিধানের ভিত্তিতেই সংসদ গঠন হয়, সেখানে সেই সংসদের হাতে সংবিধান রদবদলের সুযোগ রাখা সংসদকেই সার্বভৌম করে তোলে, জনগণকে নয়। কারণ আমরা দেখেছি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচিত হয়ে কীভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী গণনিপীড়নমূলক আইনকানুন সংবিধানসম্মতভাবেই প্রণয়ন করে। ফলে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এই অন্তর্বর্তী সময়েই সংবিধান সভা করে সংবিধানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর না করলে নির্বাচিত দলীয় বা জাতীয় সরকার তা করবে বলে আস্থা রাখা কঠিন।
গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাস পর এভাবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে হাইজ্যাক করার জন্য বাংলাদেশি করপোরেট অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডিপ স্টেট ও বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখন বিদেশি শক্তির সঙ্গে একজোট হয়েছে। এটি স্পষ্ট যে, বর্তমানে এজেন্সি পলিটিকসই নিয়ন্ত্রণের আসনে বসে রয়েছে এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গতিপথকে প্রভাবিত করছে।
ডিপ স্টেট, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো এই গণঅভ্যুত্থানকে শুধু রেজিম চেঞ্জ মনে করছে এবং শুধু ক্ষমতার হাতবদলেই আগ্রহী, যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বাংলাদেশ, যা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে, তা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ অলিগার্কদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে বলেই তারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর সে জন্যই ৯০-এর মতো ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে হাইজ্যাক করার সব আয়োজন চলছে।
পুঁজিতান্ত্রিক গ্লোবাল অর্ডারে প্রান্তিক দুর্বল রাষ্ট্রের সত্যিকারের সার্বভৌমত্ব একদিকে যেমন গ্লোবাল এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধক, অন্যদিকে তা দেশীয় করপোরেট অলিগার্ক গোষ্ঠীর লুটপাটের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রকাঠামো বহুজাতিক কোম্পানির হাতে দেশের সেবা খাতসহ শিল্প খাতকে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে জাতীয় অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে পারে। ফলে দেশি-বিদেশি করপোরেট কোম্পানির পুঁজির অবাধপ্রবাহ এবং লুণ্ঠন ও শোষণভিত্তিক অর্থনীতি চালু রাখার উপযোগী করে যে রাষ্ট্রকাঠামো এবং প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো বাংলাদেশে চালু রয়েছে, তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন বাংলাদেশের ডিপ স্টেট এবং বিদেশি শক্তিগুলো এখন সমর্থন করছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আসলে একই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে বলে এই সিস্টেম অব্যাহত রাখার পক্ষে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে সংবিধানের গুণগত পরিবর্তনের বিপক্ষে তাদের এই অবস্থান নেওয়াকে মূলত সাংবিধানিক যে রাষ্ট্রীয়-আইনি-প্রশাসনিক ক্ষমতা-কাঠামো দেশে চালু রয়েছে, তার ভিত্তিতেই শাসনকাজ পরিচালনার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের কনসেনসাস হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে করে দেশের ডিপ স্টেট যেমন নিজেদের লুটেরা মাফিয়া নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারবে এবং বিদেশি পরাশক্তির জিওপলিটিক্যাল স্বার্থও অক্ষুণ্ণ থাকবে। আবার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল তার নিজের গণতান্ত্রিক সংস্কার না করেই শাসনকাজ পরিচালনার নিশ্চয়তা পাবে। নিজ নিজ স্বার্থ সুরক্ষার জন্য ডিপ স্টেট, রাজনৈতিক দল এবং বিদেশি পরাশক্তির যে ঐকমত্য অথবা বোঝাপড়া দেশের বিদ্যমান কাঠামো রক্ষায় কাজ করে, তাকেই তারা নাম দিয়েছে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’।
এই ধারাবাহিকতা রক্ষার রাজনীতি ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যেমন দেখা গেছে, এখন আবার একই রাজনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। ফলে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের যে গণ-অভিপ্রায় মানে দেশের বিদ্যমান সিস্টেমের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, তা আবার হুমকির মুখে পড়েছে।
এখন দায়িত্ব এসে পড়েছে দেশের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ওপর। তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বর্তমান সংবিধান এবং রাষ্ট্রের কাঠামোকে গণতান্ত্রিকীকরণের কৌশল নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রনেতাদের উচিত জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, যাতে মানুষ শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলের দিকে মনোযোগ না দিয়ে অগণতান্ত্রিক এবং ‘ফ্যাসিবাদী’ কাঠামো উচ্ছেদ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। পাশাপাশি, শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে সংহতি বাড়ানোও জরুরি। গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় ধাপের এই আন্দোলন ছাড়া আমাদের আর আশা নেই এবং তা সফল না হলে আমরা আবার ‘পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদে’ বন্দি হয়ে যেতে পারি, যা নামমাত্র গণতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হবে।
গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো এখন দেশি-বিদেশি এজেন্সি পলিটিকসের মুখে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের দাবি থেকে পিছিয়ে গেলে এই অভ্যুত্থান হাইজ্যাক হয়ে যাবে। ছাত্রসমাজ এবং দেশের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শক্তি এখন কীভাবে নতুন করে সংঘটিত হতে পারে, তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে নিজেদের গঠন করে একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার ভবিষ্যৎ। তবে আবার চলমান সংবিধান এবং শাসনতন্ত্র চালু রেখে দেশে লুটপাট-দুর্নীতি-জননিপীড়নের রাজনীতি চালু রাখার দিকেই চলে যাওয়ার বিপদ দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কোনো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি আগে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর একটা বড় সুযোগ ছিল; কিন্তু তখন স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ব্লকের প্রভাবের কারণে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কোনো কাঠামোই আমরা গড়তে পারিনি। সমাজতন্ত্রের নামে স্টেট ক্যাপিটালিজমও কায়েম করা যায়নি, কায়েম হয়েছিল স্টেট লুণ্ঠনতন্ত্র, যেখানে সব শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করলেও জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ হয়নি বরং সবকিছুতে দলীয় মাফিয়াদের লুটপাট কায়েম করে দেশের অর্থনীতির ১২টা বাজিয়ে দেওয়া হয়। আর একটা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র তৈরি করা হয়নি, যেখানে ব্যক্তির বিকাশ এবং অধিকার সুরক্ষাকেই পুরো রাষ্ট্রের এবং রাজনীতির মূল লক্ষ ধরে সব ঢেলে সাজানো হবে। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আরেকটা সুযোগ আসছিল; কিন্তু সেখানেও এ দেশের রাজনীতিবিদরা এবং চিন্তাবিদরা নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে ব্যক্তিকেই সার্বভৌম ধরে ব্যক্তি নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার এবং দৈহিক, আত্মিক এবং স্পিরিচুয়াল বিকাশকেই রাষ্ট্র এবং তার সব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ধরে সবকিছুকে সাজানো এবং তাকে ঘিরেই রাজনীতির আবর্তন, এভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা যায় গণসার্বভৌমত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা গঠনতন্ত্রে এ বিষয়টি ট্রান্সলেট করতে পারিনি। বাংলাদেশে যে বুর্জোয়া লিবারেল ডেমোক্রেসির বিকাশ হয়নি, তার প্রধান কারণ, এখানে সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হলেও গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কাঠামো নেই বরং কলোনিয়াল এবং সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো রয়ে গেছে। ফলে এখানকার রাজনৈতিক দল, শিল্প-কারখানা, বাজার সিস্টেম, বিশ্ববিদ্যালয়, সেবা খাত সব জায়গায় দেখবেন মাফিয়াতন্ত্র অথবা সামন্ততন্ত্র কিংবা কলোনিয়াল নিপীড়নযন্ত্র। দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে না তুলেই যখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নিওলিবারেল পলিসি কায়েম শুরু হয়েছে এ দেশে, তখন তা জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে যেমন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, একইভাবে গণমানুষের অধিকারকে আরো নেই করে দিচ্ছে।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে যদি আমরা একটা লিবারেল ডেমোক্রেটিক রেভলেশনেও রুপান্তরিত করতে পারি, যেখানে দেশের সব নাগরিকের বিকাশের সুরক্ষার জন্য রাজনীতি, অর্থনীতি, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার কাঠামো, সংসদÑ সবকিছুকে আমূল পরিবর্তন করে একটা গণমুখী সমাজ রাষ্ট্র গঠন করা যাবে, তাহলে এটাই হবে দেশের জাতীয় সক্ষমতার বিকাশের পথ। রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়া তাই অর্থনীতিক বিপ্লব সম্ভব হবে না আমাদের জন্য। ফলে গণঅভ্যুত্থানকে কীভাবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক রেভলুশনে ট্রান্সলেট করা যায়, সে জন্য কাজ করা দরকার দেশের বুদ্ধিজীবীদের এবং গণমুখী রাজনীতিবিদদের।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচিত বিদেশি শক্তির কথামতো না চলে গণঅভ্যুত্থানের গণশক্তির ওপর নির্ভর করে নিজেদের রাজনীতি করা। রাজনীতিবিদরা যদি তাদের পুরোনা রাজনীতি বহাল রেখে দায়সারা গোছের সংস্কার করে শাসনকাজ পরিচালনা করেন, তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় বিকাশ না হয়ে আবার সব আগের মতোই চলবে। তাই এই মুহূর্তে দরকার গণঅভ্যুত্থানকে সেকেন্ড ফেজে নিয়ে যাওয়াÑ মানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য দেশের চিন্তক, বুদ্ধিজীবী, সিভিল সোসাইটি এবং মাঠের ত্যাগী গণমুখী রাজনীতিবিদদের ভূমিকা পালন করা। ডিপ স্টেট এবং বিদেশি পাওয়ার হাউস চাইবে এসব নস্যাৎ করে দিতে। কারণ শক্তিশালী স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যদি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে গড়ে ওঠে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে নিজের স্বাধীনতাকে সুসংহত করে, তাহলে পরাশক্তির দাস রাষ্ট্র হিসেবে আর বাংলাদেশ কাজ করবে না।
লেখক : চিন্তক, সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১১ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১১ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১১ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে