উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির এখনই সময়

আকরাম হুসাইন
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ৩৮

একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছরে আমরা একটি জনগোষ্ঠীকে জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে দিইনি। বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করেছে। উর্দুভাষী এই জনগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে বিহারি হিসেবে পরিচিত করা হয়। নতুন বাংলাদেশে এই উর্দুভাষী বিহারি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করা খুবই জরুরি।

স্বাধীনতার পর পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে রাষ্ট্র নানা সুবিধা দিয়েছে। তবে, এর বিপরীতে এমন কিছু জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের একেবারেই রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বিহারি সম্প্রদায় এবং কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া দলিত হিন্দু সম্প্রদায়, বিশেষ করে রবিদাসরা, যাদের পেশাগতভাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচিত, তারাও রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার। ঢাকা শহরের নিম্নবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের এই অংশটি বহু বছর ধরে সমাজে অবদান রাখলেও, তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

বিজ্ঞাপন

বিহারিদের নিয়ে বাংলাদেশে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে, তারা পাকিস্তান থেকে এসেছিল এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশিদের নিপীড়ন করেছে। তবে ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিষয়টি আসলে তেমন নয়।

বিহারিদের আগমন একাত্তরের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। মূলত, ১৮৬০ সালে সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানা স্থাপন হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই জনগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ববাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) আসতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৩৫ সালের দাঙ্গার সময়, ভারতের মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশসহ নানা অঞ্চল থেকে এসে এ অঞ্চলে তারা বসতি গড়ে। তখনকার রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার কারণে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে এই ভূখণ্ডকে তারা নিরাপদ মনে করে এবং এখানেই বসবাস শুরু করে।

২০০৩ সালের হাইকোর্টের রায়ে প্রথম এ জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা হয়। এরপর ২০০৭ সালে রায়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান এবং ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এসব উদ্যোগে বিগত প্রতিটি সরকারেরই সদিচ্ছায় ঘাটতি ছিল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিদের একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। তবে, বিহারি জনগোষ্ঠীর সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। কিছু বিহারি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকলেও, অনেকেই নিরপেক্ষ ছিল বা নিগ্রহের শিকার হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর, বিহারি গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। যেখানে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব থেকে তাদের ওপর ব্যাপক সহিংসতা চালানো হয়। এটি আমাদের ইতিহাসের একটি ন্যক্কারজনক অধ্যায়। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, যা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থাকে নিদারুণ সংকটে ফেলে দেয়।

ভোটাধিকার স্বীকৃত থাকলেও বিহারিদের বসবাসের অন্যতম চিহ্ন হয়ে রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এবং অন্যান্য রিফিউজি ক্যাম্পগুলো। এসব ক্যাম্পকে এখনো ‘রিফিউজি ক্যাম্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যদিও তারা এদেশেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং অন্য কোথাও ফিরে যাওয়ার কোনো বাস্তবতা তাদের নেই।

মানবেতর জীবনযাত্রার সুযোগ নিয়ে একটি অপরাধচক্র এই জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে ফেলে। তারা চোরাচালান, মাদক ব্যবসা বা অন্যান্য অপরাধে ব্যবহার হয়। ফলে ঢাকা শহরের অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে বিহারি ক্যাম্পগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ অপরাধের মূল কারণ হলো রাষ্ট্রীয় অবহেলা, যা তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার সুযোগ সীমিত করে ফেলেছে।

আমরা বিহারি জনগোষ্ঠীর নিউ জেনারেশনের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা জুলাই অভ্যুত্থানে এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বিশেষত, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে কিংবা মাদক বিক্রি করছে, তারা সবাই একটি ভালো জীবন চায়। তাদের যদি একটি উন্নত জীবন ফিরিয়ে দিতে হয়, তবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া কখনোই তাদের একটি ভালো জীবন প্রদান সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে বিহারিদের প্রায় ১১৬টি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে সৈয়দপুরে একটি ভালো অবস্থান রয়েছে, আর ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের বড় বড় ক্যাম্প রয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। যদি আমরা এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে না পারি, যদি এই তরুণরা অদক্ষ থাকে, তবে তারা কোনো ভালো চাকরি পাবে না এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।

অনেক সময় আমরা ভুলে যাই, বেকারত্বের সঙ্গে অপরাধের একটি সম্পর্ক রয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাং বা অপরাধী চক্র গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। যদি সরকার উদ্যোগ নেয় এবং তরুণ কিশোরদের দক্ষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করানো যায়, তবে বিশ্বাস করি সেখানে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে আসবে।

শুধু মানবেতর জীবনযাপন নয়, তারা নানা নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। নিজস্ব হোল্ডিং নম্বর না থাকায় তারা ব্যক্তিগতভাবে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারে না। তাদের বিল কেন্দ্রীয়ভাবে হয়, যা অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করে।

তাদের বড় সংকটগুলোর আরেকটি হলো পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া। বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে পাসপোর্টপ্রাপ্তিতে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়, যা তাদের জন্য বাড়তি দুর্ভোগ তৈরি করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ সমস্যা সম্পর্কে জেনেছি এবং বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকেও এমন অভিযোগ পেয়েছি। এই জটিলতা দূর না হলে বিহারিরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে।

আওয়ামী লীগের আমলে যেটা হতো, উর্দুভাষী হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ নানা ধরনের ট্যাগিং করে তাদের ডিহিউম্যানাইজ করত এবং তাদের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলত। যদি তাদের ট্যাগিং করে ডিহিউম্যানাইজ করা বন্ধ করা না যায় এবং শুধু উর্দুভাষী হওয়ার কারণে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা হয়, তবে আমরা কখনোই তাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারব না।

বিহারি তরুণরা যারা পড়াশোনা সম্পন্ন করে, তারা চাকরির ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে, যখন ভেরিফিকেশনের সময় তাদের পরিচয় ‘জেনেভা ক্যাম্প’ বা ‘বিহারি ক্যাম্প’ হিসেবে উঠে আসে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের চাকরি প্রক্রিয়া আটকে যায়। এই সামাজিক ও প্রশাসনিক জটিলতা তাদের পেশাগত জীবনে অগ্রসর হতে বাধাগ্রস্ত করে।

শুধু চাকরি নয়, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হয়। ক্যাম্পের বাসিন্দা হওয়ায় অনেক সময় তাদের ভালো স্কুলে ভর্তি নিতে চায় না কর্তৃপক্ষ। ফলে যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে, তারা ক্যাম্পের বাইরের পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় শিফট করার চেষ্টা করে এবং সেখানে বসবাস শুরু করে।

বিহারিদের পুনর্বাসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমি মনে করি, তাদের জন্য একটি পরিকল্পিত আবাসন নিশ্চিত করা। যাতে তারা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে পারে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর হওয়ার ফলে তারা শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগটুকু পায় না। ফলে সরকারের দায়িত্ব হলো বিহারি জনগোষ্ঠীর বসবাসকারী অঞ্চলে তাদের জন্য ভালো স্কুল-কলেজ ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। যদি এটি করা না যায়, তাহলে তাদের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে না।

আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই, সেখানে বিহারিরা পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। তাদের পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান এবং বিশেষ করে ‘উর্দু স্পিকিং কমিউনিটি’ হিসেবে যে বিমানবিকীকরণের ট্যাগিং করা হয়, তা থেকে মুক্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

এর পাশাপাশি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করা এবং যাবতীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা। যদি এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা না হয়, তবে বিহারিরা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত হয়ে উঠতে পারবে না। সর্বোপরি, এই কমিউনিটিকে যদি আমরা দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানে সম্পৃক্ত করতে না পারি, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হবে না।

কোনো জনগোষ্ঠীকে কর্মহীন রেখে, দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না দিয়ে কিংবা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে কোনো রাষ্ট্র টেকসইভাবে উন্নতি করতে পারে না। যদি তারা অগ্রসর হতে না পারে, তাহলে তাদের সারাজীবন রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো—তাদের দক্ষ করে তোলা, যেন তারা কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে।

অনেক বাংলাদেশি শুধু ভাষাগত দুর্বলতার কারণে বিদেশে ভালো কাজের সুযোগ পায় না। যদি এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তাদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে বিদেশে মানবসম্পদ হিসেবে পাঠানো যাবে এবং তারা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠাবে। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় (বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত) ভারতের ও পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক কর্মী কাজ করে এবং সেখানে উর্দু-হিন্দি ভাষা প্রচলিত, তাই বিহারিদের ভাষাগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তাদের ড্রাইভিং বা অন্যান্য কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ করে তোলা হলে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে।

একটি সমতাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে হলে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। এই জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তোলা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া হলে বাংলাদেশ বৈষম্যহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যাবে। সর্বোপরি তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

লেখক : সাবেক ডাকসু নেতা ও যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টিÑ এনসিপি

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত