জামাল-মাহিন প্যানেল: যা রয়েছে ২৭ দফা ইশতেহারে

প্রতিনিধি, ঢাবি
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ৫৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৭ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেল। বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. জামাল উদ্দীন খালিদ ও জিএস প্রার্থী মাহিন সরকার।

এসময় ভিপি প্রার্থী জামাল উদ্দীন খালিদ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ‘এক ক্লিকেই সব সেবা, Smart University’, ‘প্রথমেই স্বাস্থ্য, প্রথমেই নিরাপত্তা’, ‘সবার জন্য আবাসন, সবার জন্য পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস’, ‘সময়ে শক্তি, বৈচিত্র্যে সৌন্দর্য’, ‘শিক্ষার্থী শুধু ভবিষ্যৎ নয়, তারা আজকের নেতা’ এবং ‘সুস্থ শরীর, সুস্থ মন—শিক্ষার্থীর মূল শক্তি’। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সুস্থ, নিরাপদ, মাদকমুক্ত, কল্যাণমুখী ও পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত করতে চাই।”

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। “আমাদের ইশতেহারের মাধ্যমে আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে গবেষণা, উদ্ভাবন, নৈতিক নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্র।”

জিএস পদপ্রার্থী মাহিন সরকার বলেন, “আমরা শুধু ইশতেহার ঘোষণা করেই থেমে যাব না; বরং প্রতিটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করব। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‍্যাংকিং ৫০০-এর মধ্যে আসুক। এজন্য আধুনিক কারিকুলাম, গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ, One Student One Laptop কর্মসূচি এবং সুপার কম্পিউটার স্থাপন নিশ্চিত করা হবে।”

ইশতেহারের দফাগুলো হলো

০১. আমাদের স্লোগান DU First

শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী-সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ।

কোনো দলীয় আধিপত্য নয়, বরং অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষ ও মানবিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ। বিশ্বমানের শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি যেন ছাত্রছাত্রীদের নাগালে আসে। ক্যাম্পাস হবে নিরাপদ, সহিংসতামুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক

০২. ২১শ শতাব্দী হলো Artificial Intelligence, Robotics, Data Science, Nanotechnology, Biotechnology 3 Cyber Security-এর যুগ। আমরা চাই-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিক। "গবেষণায় উৎকর্ষতা, বিশ্বমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়"। আমাদের লক্ষ্য হলো-গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে আনা, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল নামমাত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ বিশ্বাস করে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই শিক্ষা ও গবেষণায় বিপ্লব ঘটাতে হবে।

০৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে দেশের নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। এখান থেকে যে গ্র্যাজুয়েট বের হবে, তারা হবে দেশপ্রেমিক, দক্ষ ও সৎ। রাজনীতি হবে নীতিনিষ্ঠ, দলীয় আধিপত্যমুক্ত। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক দখল, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও গুণগত শিক্ষার অভাবে ভুগছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি পরিবর্তনের মডেল হতে পারে, তাহলে পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে।

০৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ভবন, পাঠাগার বা পরীক্ষার কেন্দ্র নয়। এটি একটি আন্দোলনের নাম, একটি স্বপ্নের নাম। আমাদের ভিশন হলো সেই স্বপ্নকে নতুন যুগে বাস্তবায়ন করা-যেখানে শিক্ষা হবে মুক্তির শক্তি, গবেষণা হবে উন্নয়নের হাতিয়ার, এবং ক্যাম্পাস হবে নিরাপদ, আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

০৫. শিক্ষক নিয়োগে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য নয়, বরং অ্যাকাডেমিক সাফল্য, গবেষণাপত্র, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত কাজ ও শিক্ষাদানের দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। সব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনলাইনে প্রকাশ, প্রার্থীদের প্রোফাইল উন্মুক্ত করা, এবং ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া রেকর্ড রাখা হবে।

০৬. বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে চাইলে শিক্ষার্থীদের IELTS, GRE, TOEFL-এর মতো পরীক্ষায় ভালো করতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কোনো সাপোর্ট সিস্টেম নেই। এখানে শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন খরচে IELTS, GRE, TOEFL-এর প্রস্তুতি নিতে পারবে। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে টেস্ট প্র্যাকটিস সিস্টেম থাকবে।

০৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পাঠ্যক্রম এখনও ২০-৩০ বছর আগের ধাঁচে রয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা চাকরি ও গবেষণা ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যায়। এজন্য কারিকুলাম রিডিউ বাধ্যতামূলক ও আধুনিক বিষয় যেমন, AI, IoT, Data Science, Cyber Security, Bioinfor-matics-এর মতো বিষয় প্রতিটি অনুষদে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

০৮. "সহিংসতামুক্ত নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি"। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো ক্যাম্পাসকে সহিংসতামুক্ত করা। এজন্য-গেস্টরুম নিষিদ্ধ, যেকোনো প্রকার জোরপূর্বক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বন্ধ ও র‍্যাগিং বন্ধ করতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

০৯. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল অনেক সময় এক ধরনের একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি করে। ভিন্ন মতের সংস্কৃতি, সংগীত, সাহিত্য বা নাটক জায়গা পায় না। আমরা চাই- সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ও উন্মুক্ত মতপ্রকাশের স্বাধিনতা।

১০. শিক্ষক ও কর্মচারীর দলীয় রাজনীতি প্রায়ই ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করে। ডাকসুর পক্ষ থেকে শিক্ষক রাজনীতি ও কর্মচারী রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হবে।

১১. "One Student One Laptop" কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি প্রদান ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ল্যাপটপ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া। বিশ্ব র‍্যাংকিং-এ ৫০০-এর মধ্যে আনার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেয়া।

১২. সিন্ডিকেট থেকে সিনেটে ক্ষমতা স্থানান্তরে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া যাতে ডাকসুর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায় এবং ক্ষমতা কাঠামোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

১৩. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সেবা একটি প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য চালু করা হবে ওয়েব পোর্টাল এবং ক্লাসরুম, হল এক্টিভিটিজসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নত তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হবে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

১৪. মানসিক স্বাস্থ্য এখন একটি বড় সংকট। হতাশা, ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার মতো অবস্থা যেন তৈরি না হয় এজন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেল গঠন, সাইকোলজিস্ট নিয়োগ, প্যারা কাউন্সিলর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে।

১৫. মাদক শিক্ষাজীবনের জন্য বড় হুমকি। মাদক সাপ্লাই বন্ধে প্রশাসন ও পুলিশের সাথে সমন্বয় করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হতাশায় বা আসক্তিতে যারা ভুগছে, তাদের জন্য পুনর্বাসন ও কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম চালু হবে।

১৬. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার অর্থে আধুনিক ও বিশ্বমানের করতে হলে প্রথম শর্ত হলো-শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে আমরা কর্মসূচি গ্রহন করব।

১৭. "আধুনিক অবকাঠামো, সবুজ ক্যাম্পাস, সবার জন্য নিরাপদ আবাসন" নিশ্চিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১৮. বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন সংখ্যা অন্তত ৫০% বৃদ্ধি করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও সম্মিলনে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করা হবে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস চালু হবে।

১৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী সমান মর্যাদা ভোগ করবে, তাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন।

২০. গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা প্রায়ই শহুরে শিক্ষার্থীদের তুলনায় অ্যাকাডেমিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের জন্য বিশেষ Bridge Course চালু করবে (ইংরেজি, আইসিটি, অ্যাকাডেমিক রাইটিং ইত্যাদি)। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মেন্টর হিসেবে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হবে।

২১. বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোটার বাইরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহায়তা প্রদান করা হবে। নৃগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর গবেষণায় বিশেষ তহবিল থাকবে। বার্ষিকভাবে Ethnic Culture Festival আয়োজন করা হবে।

২২. বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা International Student Center তৈরি করা হবে। ভিসা, আবাসন ও অ্যাকাডেমি সহায়তায় প্রশাসন সরাসরি সহযোগিতা করবে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়াতে Exchange Club চালু হবে।

২৩. "আজকের শিক্ষার্থী, আগামীর নেতৃত্ব" আমাদের লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন-যাতে তারা শুধু শিক্ষাজীবনেই নয়, জাতীয় পর্যায়েও নেতৃত্ব দিতে পারে। নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন আমাদের অঙ্গীকার। অন্যান্য ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যাপারেও ডাকসু সরব থাকবে।

২৪. বর্তমানে সিনেট ও সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সিদ্ধান্ত নেয়, অথচ শিক্ষার্থীদের ভূমিকা প্রায় শূন্য। সিন্ডিকেট থেকে সিনেটে ক্ষমতা স্থানান্তর করতে হবে-যাতে শিক্ষার্থীরাও নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে পারে। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্যরা অধিকারভিত্তিক ভোটাধিকার পাবে।

২৫. গেস্টরুম, র‍্যাগিং, দখলদারি, শারীরিক নির্যাতনের সম্পূর্ণ অবসান ঘটানো হবে। শূন্য-সহনশীল নীতি অনুসারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার হবে। রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান জানিয়ে সংলাপ সংস্কৃতি চালু করা হবে।

২৬. বিশ্ববিদ্যালয়কে "Cultural Hegemony" থেকে মুক্ত করা হবে। শিক্ষার্থীরা যেন স্বাধীনভাবে সংগীত, সাহিত্য, নাটক, শিল্পকলা চর্চা করতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি হবে। মাদ্রাসা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য Orientation Program থাকবে, যাতে তারা সহজে একীভূত হতে পারে।

২৭. "স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা-শিক্ষার্থীর অধিকার নিশ্চিত করার মূলমন্ত্র"। আমাদের লক্ষ্য হলো- স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, যেখানে শিক্ষার্থীদের অধিকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বাজেট, প্রকল্প ও খরচের হিসাব অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। যেকোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণ ও প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে প্রদর্শিত হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত