মুসলিম সভ্যতায় ঈদ সংস্কৃতি

ওয়ালিউল্লাহ সিরাজ
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ১২: ৪৮

ঈদ মুসলমানদের অন্যতম প্রধান উৎসব। এটি শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাই নয়, মুসলিম সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উৎসব পারস্পরিক ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ঈদের আনন্দ শুধু ব্যক্তিগত নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের।

বিজ্ঞাপন

ইসলাম-পূর্ব পৃথিবীতে মানুষের সংস্কৃতি কিংবা আনন্দ উৎসবে ছিল না সভ্যতার শিক্ষা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত। মুসলমানদের ঈদ সংস্কৃতির আগে মদিনায় ‘নাইরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দুটি উৎসব উদ্‌যাপিত হতো। দুটি উৎসবই পারস্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার দর্পণ। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে নাইরোজ এবং বসন্ত উৎসবকে উপলক্ষ করে মেহেরজান উদ্‌যাপিত হতো। অপরিশুদ্ধ মানবমননে আবিষ্কৃত দুটি উৎসবই বেহায়াপনা-বেলেল্লাপনা ও অশ্লীলতার নিকৃষ্ট আঁধারে ছিল নিমজ্জিত। তাদের ভিত্তিহীন সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে শুদ্ধ সংস্কৃতির পাঠ দিলেন মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.)। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ-উৎসব দুই ঈদ।’

ইসলামের দুটি আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয় ত্যাগের, ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার, শ্রেণিবৈষম্যের মূলোৎপাটন করার এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গরিব-ধনী এক কাতারে চলার।

ঈদের দিনের পারস্পরিক সম্ভাষণের বিষয়ে হাদিসে এসেছে, ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা.) থেকে বর্ণিত—তিনি বলেন, আমি ঈদের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললাম, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার পক্ষ থেকে কবুল করুন। তিনি বলেন, হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার পক্ষ থেকে কবুল করুন। উবাদা ইবনুস সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত—তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ঈদের দিন মানুষ এ কথা বলে যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার পক্ষ থেকে কবুল করুন। তিনি বলেন, এটি আহলে কিতাবদের সম্ভাষণ। উমর ইবন আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর মুক্ত করা দাস আদহাম (রহ.) বলেন, আমরা উমর ইবন আব্দুল আজিজ (রহ.)-কে উভয় ঈদে বলতাম, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা—হে আমিরুল মুমিনুন! তিনি আমাদের অনুরূপ বলে জবাব দিতেন এবং আমাদের এরূপ বলায় কোনো প্রকার অস্বীকৃতি জানাতেন না।

খুলাফায়ে রাশেদিনের আমলে ঈদ উদ্‌যাপনের পরিসর আরো বড় হয়। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.)-এর শাসনামলে ঈদ অত্যন্ত সরলতা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদ্‌যাপিত হতো। তাদের শাসন আমলে ঈদ ছিল বিনয়, তাকওয়া, দান-সদকা ও ভ্রাতৃত্ববোধের সমন্বয়। তাদের সময়ে ঈদ শুধু আনন্দের দিন ছিল না, বরং এটি ছিল ইসলামি ঐক্য, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার প্রতীক।

উসমানীয় খেলাফতের সময় মুসলমানদের ঈদ উৎসবের পরিসর আরো বড় হয়। তাদের কাছে ঈদ ছিল রাষ্ট্রীয় শক্তি, ঐক্য ও জনকল্যাণমূলক কাজের প্রতীক। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিটি শহর পরিপাটি করা হতো। খেলাফতের সুলতানের প্রাসাদ, মসজিদ ও প্রধান প্রধান স্থাপনায় আলোকসজ্জাও করা হতো। ঈদের আগের রাতে মানুষ সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকত, আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করত। অন্যান্য দিন মসজিদগুলোয় ইবাদত হলেও ঈদের আগের রাতে মুসল্লিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠত। ঈদকে কেন্দ্র করে সুলতানরা মানুষের মাঝে প্রচুর দান-সদকা করতেন। ঈদের সময় রাষ্ট্রীয়ভাবেও দান-সদকা করা হতো। আর সামরিক কুচকাওয়াজ, ঘোড়দৌড় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ঈদ উদ্‌যাপন করতেন। তারা ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে ঈদকে এক ব্যতিক্রমী ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবে পরিণত করেছিলেন।

ঈদ উৎসব মুসলিম সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং একটি সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ঘটনা, যা মুসলিম সমাজের ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত ঈদ উৎসব মুসলিমদের জীবনযাত্রা, শিল্প, সাহিত্য ও সামাজিক রীতিনীতিকে প্রভাবিত করেছে।

মুসলিম দেশগুলো ঈদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে পূর্ণ। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ঈদ উৎসবের রীতিনীতিতে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। সৌদি আরবের পুরুষরা ঈদকে কেন্দ্র করে সাদা কান্দুরা এবং নারীরা তোব পরিধান করে। ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল ফিতরকে স্থানীয় ভাষায় ‘লেবারান’ বলা হয়। ঈদের দিন স্থানীয় লোকদের আত্মীয়স্বজনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রথা রয়েছে। তারা ঈদের দিন বিশেষ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে। মিসরে চার দিন ধরে ঈদ উদ্‌যাপন করা হয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন ‘কাহক’ ও ‘ঘোরাইবা’ পরিবেশন করা হয়।

ঈদ ইসলামের ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল ফিতরের আগে ফিতরা ও জাকাত দেওয়ার বিধান রয়েছে অনেক আগে থেকেই। ঈদ যদিও মুসলমানদের জন্য, কিন্তু জাকাতের অর্থ শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জাকাতের টাকার একটা অংশ দেওয়া যায় অমুসলিমদেরও। সমাজের প্রত্যেক মানুষই যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে, সেজন্য জারি করা হয়েছে সাদাকাতুল ফিতরের বিধান। ইসলাম এখানেই অনন্য। অন্য ধর্মগুলোয় বিভিন্ন উৎসব থাকলেও ধনী-গরিব সবাই যেন সমানভাবে উৎসব করতে পারে, সে ব্যবস্থা নেই। শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষই যেন উৎসবে যোগ দান করতে পারে, সে নির্দেশনা দেওয়া আছে ইসলামে।

বর্তমান পৃথিবীতে বাড়ছে ধনী-গরিবের ব্যবধান। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা আরো গরিব হচ্ছে। ইসলাম চৌদ্দশ বছর আগেই সেই জাকাতের বিধান ফরজ করেছে মুসলমানদের ওপর। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই জাকাত আদায় করা হতো রমজান কেন্দ্রিক। এখনো রমজানেই জাকাত আদায় করেন বেশিরভাগ মুসলিম। বর্তমানে বিশ্বের মুসলমানদের জাকাতের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন হলে শুধু মুসলমানরা নয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষই স্বাবলম্বী হতে পারত, দূর হতো ধনী-গরিবের ব্যবধান। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাকাত বণ্টনে সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে জাকাতের কাপড়ের নামে বের করা হয় নিম্নমানের কাপড়। সেটাই দরিদ্রদের মাঝে বিলি করা হয়। এটা দেওয়ার মাধ্যমে যেমন আদায় হয় না জাকাতের বিধান, ঠিক তেমনই লাভবান হয় না জাকাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিও। ঈদ সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে শুধু মুসলিম সমাজ নয়, উপকৃত হবে পুরো বিশ্ব।

ইসলাম বিনোদন সমর্থন করে; কিন্তু অশ্লীলতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয় না। বিনোদনের নামে অসামাজিকতা ও নগ্নতা নেই। নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। উৎসবের সঙ্গে মানুষের রুচি ও চাহিদার বিষয়টি জড়িত। অন্যদের উৎসব ও আমাদের উৎসবের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। মুসলমানদের উৎসব সম্পূর্ণভাবে অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত।

বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্য সুসংহত করা আন্তর্জাতিক ঈদ উৎসবের প্রধান দীক্ষা। ভেদাভেদ ভুলে এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে বুকে টেনে নেয় আন্তর্জাতিক এ আনন্দের দিনে। পারস্পরিক উপহার-শুভেচ্ছা বিনিময় ঈদ উৎসবকে প্রীতিময় করে তোলে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের শুভেচ্ছা বিনিময় আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ-সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এতে বৈশ্বিক শান্তি-সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে ওঠে এবং মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য-সংহতি বাড়ে। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও ঈদ উৎসবের প্রভাব পড়ে। কারণ মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় ঈদ উপলক্ষে ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেন বেশি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক ঈদ মৌসুমে মুসলিম দেশসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটন-পরিবহন শিল্প চাঙা হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ঈদ উৎসবে মুসলিম বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ঈদ মুসলিম ঐক্য-সংহতির এক বৈশ্বিক উৎসব।

ঈদ বিশ্বের প্রতিটি দেশের উৎসব হলেও এতে স্থানীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব আছে। ঈদের মূল চেতনা ও মৌলিক বিধানাবলি অপরিবর্তিত রেখে স্থানীয় সংস্কৃতিতে উৎসব করা হয়। তাই দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উদ্‌যাপিত হয় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে। বাঙালি মুসলমানরা সকালে সেমাই-পায়েস ও অন্যান্য মিষ্টান্নজাতীয় খাবার খেয়ে ঈদগাহে যান; আর দুপুরে বা রাতে গোশত-খিচুড়ি, পোলাও-কোরমা ইত্যাদি মুখরোচক খাবার খান। ঈদের দিন সাধারণত বাঙালি পুরুষ ও ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং নারীরা শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে ঈদ উদ্‌যাপিত হয় বাঙালি সংস্কৃতিতে।

মুসলিম সভ্যতা বিস্তারে ঈদ সংস্কৃতি গভীর ও বহুমুখী তাৎপর্যপূর্ণ। এটি শুধু ধর্মীয় আনন্দের প্রকাশ নয়, বরং সামাজিক সম্প্রীতি, মানবিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির প্রতীক। বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিতে ঈদ উদ্‌যাপনের রীতিনীতি ভিন্ন হলেও এর মূল বার্তা সর্বত্র একই—আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, মানবতার সেবা ও সামাজিক ঐক্য।

বিষয়:

ঈদ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত