মানুষ মনে করে পৃথিবী খুব শক্ত, অটল ও অনড়। কিন্তু আল্লাহ কোনো এক মুহূর্তে যখন মাটিকে সামান্য নড়াচড়া দেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়—শক্তির মালিক মানুষ নয়, বরং একমাত্র রাব্বুল আলামিন। ভূমিকম্প তাই শুধু ভূবিজ্ঞান নয়; এটি মানুষের হৃদয়ে আঘাত করা এক স্মরণবার্তা—তুমি ক্ষুদ্র আর তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাস তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কোরআনুল কারিম পৃথিবীর কাঁপনকে এক ভয়ংকর বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যখন পৃথিবী তার প্রকৃত কম্পনে কেঁপে উঠবে।’ (সুরা জিলজাল : ১)
এ আয়াত কিয়ামতের ভয়ংকর ভূমিকম্পকে নির্দেশ করলেও প্রতিটি ভূমিকম্প সেই মহাদিনের ক্ষুদ্র স্মারক। পরের আয়াতে বলা হয়েছে—‘যখন মাটি তার বোঝা বের করে দেবে।’ (সুরা জিলজাল : ২)
পৃথিবীর নিচে যে অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে, তা শুধু ঘটনাচক্র নয়; বরং আল্লাহর নির্দিষ্ট নিয়মের প্রতিফলন। আরো একটি আয়াতে আল্লাহ সতর্ক করছেন— ‘তোমরা কি নিরাপদ মনে করো, আল্লাহ স্থলে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন না?’ (সুরা ইসরা : ৬৮)
এই আয়াত মানুষকে ভাবতে শেখায়; আমরা কি সত্যিই নিরাপদ? কংক্রিটের দেয়াল, অট্টালিকা, শহরের জৌলুস, আর্থিক শক্তি—এসবই তো এক মুহূর্তের কাঁপনে মুছে যেতে পারে।
হাদিসে ভূমিকম্প : গোনাহ থেকে সতর্কবার্তা
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন-ভূমিকম্প শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং আল্লাহর এক সতর্কবার্তা। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের মধ্যে অশ্লীলতা ও গোনাহ ছড়িয়ে পড়বে, তখন আল্লাহ তোমাদের ওপর ভূমিকম্প চাপিয়ে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৫৬৫১)
আরেক বর্ণনায় এসেছে—‘তোমরা যখন ভূমিকম্প দেখবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ করো, দোয়া করো, ক্ষমা প্রার্থনা করো।’ (আল-মুজামুল কাবির : ৭৫৪৬) এগুলো আমাদের শেখায়—ভূমিকম্প শুধু আতঙ্ক নয়; এটি আত্মসমালোচনার মুহূর্ত, তওবার আহ্বান, মানুষের অন্তরের কঠিনতা ভেঙে দেওয়ার এক সুযোগ।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ : মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অস্থিরতা
কোরআন মানুষকে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছে—‘তোমরা কি চিন্তা করবে না?’ (সুরা রুম : ৮) বিজ্ঞান আজ বলে—পৃথিবী কয়েকটি বিশাল টেকটোনিক প্লেটের ওপর দাঁড়িয়ে। এগুলো তলদেশে ধীরে ধীরে সরে, কখনো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়। প্লেটগুলো চাপ তৈরি করে; একসময় সেই চাপ ফেটে বের হয়—আর তখনই ঘটে ভূমিকম্প। এই চাপের কমান্ড কার হাতে? আল্লাহর হাতে।
মানুষের সব উন্নতি সত্ত্বেও পৃথিবীর কোন স্থানে কবে ভূমিকম্প হবে—তা আজও নির্ভুলভাবে বলা যায় না। এতে প্রমাণিত হয়—মানুষ যতই উন্নত হোক, আজও সঠিকভাবে বলা যায় না—ঠিক কোন সময়, কোন স্থানে ভূমিকম্প হবে। এটাই প্রমাণ করে—‘তোমার রবের বাহিনীকে তিনিই জানেন।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৩১)
ভূমিকম্প : মানুষের অহংকার ভেঙে দেওয়ার শিক্ষা
ভূমিকম্প মানুষকে তিনটি বড় শিক্ষা দেয়— ১. হৃদয়ের জন্য ঈমানি সতর্কবার্তা : এই কাঁপন মনে করিয়ে দেয়—মানুষের শক্তি ক্ষণিক; আল্লাহর শক্তি চিরস্থায়ী। তাই ভূমিকম্পের সময় সুন্নাহ হলো—ইসতেগফার, তওবা, দোয়া ও ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) শিখিয়েছেন। বিপদের মুহূর্তে একজন মুসলিম— হে আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করুন।
২. সমাজ থেকে গোনাহ দূর করার আহ্বান : অন্যায়-অশ্লীলতা, সুদ, মিথ্যা, প্রতারণা—এসব যখন বেড়ে যায়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সতর্কবার্তা আসে। ভূমিকম্প তারই একটি।
৩. দায়িত্বশীলতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার শিক্ষা : যখন দুর্যোগ নামে, তখন দেখা যায়— মানুষে মানুষে কী পরিমাণ ভ্রাতৃত্ব আছে। সুতরাং দুর্যোগের সময় একে অন্যের সাহায্য করা ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—‘যে তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)
বাস্তব প্রস্তুতি : ইসলাম ও বিজ্ঞানের মিলিত নির্দেশনা
ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিকতা শেখায় না; বরং বাস্তব জীবনের প্রস্তুতিও নির্দেশ করে— ‘তোমরা যা পারো প্রস্তুতি গ্রহণ করো।’ (সুরা আনফাল : ৬০)
সুতরাং আমাদের করণীয়—১. ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন নির্মাণ : ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ম ভঙ্গ করে ভবন নির্মাণ করা শুধু বোকামি নয়, বরং শরিয়ত অনুযায়ী ‘জান-মালের ক্ষতির কারণ সৃষ্টি’, যা পাপ। ২. কম্পনের পর করণীয়—গ্যাস-বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করা। ফাটল ধরা ভবনে প্রবেশ না করা। প্রতিবেশীকে সাহায্য করা। রক্তদান, স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ— এগুলোর প্রতিটিই ইবাদত।
দুর্যোগের মধ্যে ইবাদত : আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—‘দোয়াই হলো ইবাদত।’ (তিরমিজি : ২৯৬৯) ভূমিকম্পের সময় ও পরে; দোয়া, তওবা, নামাজ, সদকা— সবই আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভের সুযোগ। বিপর্যয়ের পর মানুষের প্রতি দয়া দেখানোও বিশাল সওয়াব। ইমাম ইবনুল কাইয়িম লিখেছেনÑকোনো বিপদ আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য মানুষকে এমনভাবে প্রস্তুত করে, যেমন লোহার আগুনে নরম হওয়া।
শেষকথা
ভূমিকম্প শুধু বিজ্ঞান নয়, শুধু ভয় নয়—এটি আল্লাহর এক নিদর্শন। এক সতর্কবার্তা। এক আত্মজাগরণের সময়। কোরআন আমাদের সাবধান করে, হাদিস আমাদের তওবার ডাক দেয় আর বিজ্ঞান আমাদের প্রস্তুতি নিতে শেখায়। ইবাদত-তওবা-সদকা আমাদের রুহকে নিরাপদ করে; আর সঠিক পরিকল্পনা-শিক্ষাসচেতনতা আমাদের জীবনকে নিরাপদ করে। যখন পৃথিবী কেঁপে ওঠে, তখন আসলে মানুষকে ডাকা হয়—ফিরে এসো। সংশোধন হও। প্রস্তুত হও।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আস-সুফফাহ মডেল মাদরাসা, গাজীপুর

