ঘরে ঘরে কোরবানির আনন্দ বিলান যারা

নুরুল ইসলাম তানঈম
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ১৭: ২১

এ দেশের হাজারো পরিবার দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত। দুমুঠো ভাতের জন্য প্রতিনিয়ত যারা জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেন। ঈদের দিনেও পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি নিয়ে দুবেলা ভালো খাবারের আয়োজন যাদের কাছে দুঃস্বপ্ন।

বিজ্ঞাপন

বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চল, ছিন্নমূল জনপদ, চরাঞ্চল, ছিটমহল, গুচ্ছগ্রাম, নিম্ন আয়ের চা-শ্রমিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লি, অবহেলিত বস্তি, নদীভাঙন ও ঝড়-বন্যা-খরায় বিপর্যস্ত এলাকার হতদরিদ্র পরিবার।

জিলহজের ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এই দিনে সামর্থ্যবানরা ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করেন।

ঈদুল আজহার প্রধানতম আনন্দ কোরবানিকে কেন্দ্র করে। ঘরে ঘরে কোরবানি বয়ে আনে আনন্দের হিল্লোল। মুসলমানরা আল্লাহর বিধান পালনার্থে নিজের প্রিয় বস্তু কোরবানি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন এবং পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শি, বন্ধুবান্ধব সবে মিলে আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত পশুর গোশত দিয়ে আনন্দচিত্তে আহার করেন।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো জনবিচ্ছিন্ন হওয়ায় অনেকাংশেই তাদের কাছে কোরবানির আনন্দ পৌঁছে না। মলিন মুখে চেয়ে থাকে শিশু-কিশোর। তাদের মলিন মুখে ঈদের অনাবিল আনন্দ পৌঁছে দিতে বেশ কিছু চ্যারেটি প্রতিষ্ঠান নিরলস কাজ করে। প্রতিবেশী দরিদ্র পরিবার ও দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হতদরিদ্র, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, অভাবীর ঘরে পৌঁছে দেন কোরবানির আনন্দ।

আমরা জনমানুষের বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল কয়েকটি চ্যারেটি প্রতিষ্ঠান, যারা কোরবানি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে, তাদের সম্পর্কে জানব, অবহিত হব তাদের কার্যক্রম সম্পর্কেও।

আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। জনপ্রিয় আলেম, দাঈ শায়খ আহমাদুল্লাহ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। অলাভজনক, অরাজনৈতিক, পূর্ণ মানবসেবায় নিবেদিত সরকার নিবন্ধিত একটি চ্যারেটি প্রতিষ্ঠান।

‘উম্মাহর স্বার্থে, সুন্নাহর সাথে’ এই স্লোগানকে ধারণ করে নানামুখী সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে ফাউন্ডেশনটি। রাজধানীর আফতাবনগরে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় সব কার্যক্রম।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত। ২০২৪ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ত্রাণকর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে দেশের আপামর মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ ছাড়া গৃহহীনদের গৃহায়ন, পুনর্বাসন, ইফতার বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনায় নলকূপ স্থাপন, বৃক্ষরোপণ, স্বাবলম্বীকরণ ও বেকার অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানসহ মানবসেবায় নানা প্রজেক্টে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

বিশেষত ঈদুল আজহায় সচ্ছলদের পক্ষ থেকে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল ও অসহায় পরিবারে কোরবানির গোশত বিলি করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মুখে ঈদের অনাবিল আনন্দ ছড়িয়ে দেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ‘সবার জন্য কোরবানি’ নামে এই প্রজেক্ট নিয়মিত পরিচালনা করে আসছে।

ইতোমধ্যে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও হতদরিদ্র পরিবারে এ যাবৎ ২ হাজার ২১৮ টি গরু-ছাগল কোরবানি করে দুস্থদের মধ্যে গোশত বিতরণ করেছে।

এ ছাড়া ঈদের দিন ঢাকা থেকে গোশত সংগ্রহ করে ফ্রোজেন গাড়ির মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে। এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৭৩০টি দুস্থ পরিবারে কোরবানির গোশত বিতরণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

হাফেজ্জি চ্যারিটেবল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হাফেজ্জি চ্যারিটেবল সোসাইটি অব বাংলাদেশ। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর খেদমতে খালকের দ্বীনি চেতনাকে ধারণ করে ‘সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টার সন্তুষ্টি’ স্লোগানে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মাদিয়া হাউজিং সোসাইটির ৬ নম্বর রোডের ৫৭/এ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় HCSB-এর যাবতীয় কার্যক্রম।

হাফেজ্জি চ্যারিটেবল সেবামূলক নানা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি ছয় মাস ধরে গাজার নিপীড়িত মানুষদের মধ্যে নিয়মিত সহায়তা করে যাচ্ছে। গাজাবাসীর মধ্যে স্বচ্ছতার সঙ্গে সহায়তা দিয়ে সংস্থাটি আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।

ঈদুল আজহায় অসহায় দরিদ্র পরিবারে তারাও কোরবানির গোশত বিতরণ করে। অভাবী মানুষের মুখে হাসি ফোটায়। এ বছর তারা গাজাতে ও শরণার্থীশিবিরে কোরবানির গোশত বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিগত বছরগুলোয় হাফেজ্জি চ্যারিটিবল সোসাইটি অব বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্প, চরাঞ্চল, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নোয়াখালীসহ ২৬ জায়গায় ১৭টি গরু ও ১৬টি খাসি কোরবানি করে ২০০০+ পরিবারে বিতরণ করেছে।

আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন

২০১৭ সালে প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন। এটি সরকারনিবন্ধিত একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রামের চান্দগাঁও গোলাম আলী নাজিরপাড়ায় ফাউন্ডেশনের প্রধান অফিস। ফাউন্ডেশনটি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, ফেনী, বান্দরবান, হাটহাজারী, খাগড়াছড়িসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

ঈদুল আজহায় বিশেষভাবে কোরবানির প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে ফাউন্ডেশন। এদেশে হাজারো এমন পরিবার আছে যারা কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর গোশত দিয়ে খেতে পারেন না। সেসব পরিবারে কোরবানির গোশত পৌঁছে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটায় তারা।

আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন (ASHF) এখন পর্যন্ত তাদের কোরবানি কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ২,০০০ জন উপকারভোগীকে কোরবানির মাংস সরবরাহ করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বন্যাকবলিত এলাকা, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করেছে।

২০২৩ সালে কুড়িগ্রামের জাত্রাপুর ইউনিয়নে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ছয়টি গরু ও ১০টি ছাগলের কোরবানির গোশত বিতরণ করে।

মাস্তুল ফাউন্ডেশন

২০১২ সালের ১৯ অক্টোবর কাজী রিয়াজ রহমানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মাস্তুল ফাউন্ডেশন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে মাস্তুল ফাউন্ডেশন দীর্ঘ এক যুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছে।

নিজস্ব স্কুল, মাদরাসা, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর খাবার বিতরণ, করোনাকালে বিশেষ সহায়তা প্রদানসহ সমাজসেবামূলক বহুমুখী কাজ করেছে মাস্তুল ফাউন্ডেশন।

গোশত বিতরণ প্রজেক্টে ঈদুল আজহায় কোরবানির গোশত বিলি করে অসহায় জনবিচ্ছিন্ন মানুষের মধ্যে আনন্দ বিলি করে তারা। উদ্বাস্তু পরিবার, পথশিশুদের হাতে হাতে পৌঁছে দেন কোরবানির আনন্দ।

প্রতিবছর ঈদুল আজহায় গোশত বিতরণ প্রজেক্টে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের মধ্যে কোরবানির মাংস বিতরণ করে থাকে। ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৫ হাজারেরও বেশি দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, অসহায় এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে কোরবানির মাংস বিতরণ করেছে।

২০২৪ সালে মাস্তুল ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২০ হাজার দরিদ্র পরিবারের মধ্যে কোরবানির মাংস বিতরণ করেছে ।

এ ছাড়া ২০২৪ সালে তারা গাজা, ফিলিস্তিনের এক হাজার পরিবারের মধ্যে কোরবানির মাংস বিতরণ সম্পন্ন করেছে ।

খাইরুল উম্মাহ ফাউন্ডেশ

খাইরুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন—বিশেষত নওমুসলিমদের নিয়ে কাজ করে। নওমুসলিমদের শিক্ষা-দীক্ষা, পুনর্বাসন এবং তাদের নতুন পরিবার গঠনে সার্বিক সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধান করে থাকে।

নওমুসলিমরা সাধারণত পরিবার, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ফলে, অনেককে খুব মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। খাইরুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন সারা দেশের নওমুসলিমদের সহযোগিতা করেন।

ঈদুল আজহায় কোরবানির আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে খাইরুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন সচ্ছলদের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত নওমুসলিম ও গরিব মানুষদের কাছে কোরবানির গোশত বিতরণ করে।

ময়মনসিংহের সদরে খাইরুল উম্মাহ ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়। সেখান থেকেই সারা দেশে পরিচালিত হয় এসব কর্মযজ্ঞ। ফাউন্ডেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন দাঈ মাওলানা যুবায়ের আহমদ।

চ্যারেটি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোরবানির গোশত বিতরণের উদ্যোগ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং কোরবানি হয়ে ওঠে সবার। ঘরে ঘরে বয় কোরবানির আনন্দের হিল্লোল।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত