আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বছরজুড়ে আলোচনায় শুধু মাঠের বাইরের ক্রিকেট

পার্থ রায়

বছরজুড়ে আলোচনায় শুধু মাঠের বাইরের ক্রিকেট

বাংলা প্রবাদ ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’-এর সঙ্গে খানিকটা মিলিয়ে বলা যায়-২০২৫ সাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ছিল দারুণ কিছু। বছরের শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজে আয়ারল্যান্ডকে ২-১ ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ দল। তবে বছরব্যাপী মাঠের পারফরম্যান্সে যতটা না আলোচনা-সমালোচনা ছিল, তারচেয়ে বেশি ক্রিকেটপাড়া সরগরম ছিল মাঠের বাইরের নানান আলোচনা নিয়ে। বিসিবি সভাপতি থেকে ফারুক আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া, বিসিবি নির্বাচন, টেস্ট অধিনায়ক থেকে নাজমুল হোসেন শান্তর পদত্যাগ। সঙ্গে আছে তার ফিরে আসার গল্পও। এছাড়া ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে শান্তকে সরিয়ে মেহেদি হাসান মিরাজের কাঁধে তুলে দেওয়া। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে ফিক্সিং কাণ্ড। এতসব আলোচনার ভিড়ে মাঠের ক্রিকেট নিয়ে খুব একটা আলোচনার সুযোগ ছিল না এ বছরে।

বাইরের বিভিন্ন আলোচনার মাঝে মাঠের ক্রিকেটেও ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স ছিল অম্ল-মধুর। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে ৫০ শতাংশ জয় পেয়েছে লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা। সেখানে ১১ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জিতেছে মোটে তিনটি। অর্থাৎ, নিজেদের সেরা সংস্করণে বাংলাদেশ মোটেও সেরা ছন্দে ছিল না। সাদা পোশাকে খেলা ছয় টেস্টে সমান তিনটি করে জয়-হার ছিল বাংলাদেশের। আর টি-টোয়েন্টিতে ৩০ ম্যাচে ১৫ জয় ও ১৪ হার। একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত। সব মিলিয়ে মাঠের ক্রিকেটে বাংলাদেশকে খানিকটা সফলই বলা যায়।

বিজ্ঞাপন

মাঠের ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সফল বিবেচনা করলেও বাইরে ছিল নানান অক্রিকেটীয় আলোচনা। সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বিসিবি নির্বাচন ও ফিক্সিং ইস্যুতে। চলতি বছরের অক্টোবরে হয় বিসিবি নির্বাচন। সেখানে তামিম ইকবাল-মাসুদুজ্জামানসহ অনেকে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কট করেন। অপর প্রান্তে থাকা আমিনুল ইসলাম বুলবুল-ফারুক আহমেদরা অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে নেন বিসিবির দায়িত্ব। এই নির্বাচন নিয়ে ওঠা প্রশ্নের কারণে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট মাঠে গড়াতে পারেনি ঠিকঠাক। প্রথম বিভাগ লিগ শুরু করলেও সেখানে ২০ ক্লাবের মধ্যে খেলছে মোটে ১২টি। আর ২৪ দলের দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১০ ক্লাব। এমনকি এই নির্বাচনের প্রভাবে তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ ও প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটেও সবগুলো দলের অংশ নেওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত।

এ তো গেল নির্বাচন। আরো একটি বিষয় দেশের ক্রিকেটকে রেখেছিল গরম করে। ফিক্সিং কাণ্ডে চলমান বিপিএল শুরুর আগ মুহূর্তে কয়েকজন ক্রিকেটারকে বাদ দেয় বিসিবি। তাদের রাখা হয়নি বিপিএল নিলামে। সন্দেহজনক বোলিং-ব্যাটিংয়ের অভিযোগের তাদের বিপিএলে খেলার সুযোগ দেয়নি বিসিবি। এ নিয়ে বেশ কজন ক্রিকেটার আদালতের দ্বারস্থ পর্যন্ত হয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় ছিল বিসিবির পক্ষে। যে বিপিএল ঘিরে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ, সেই বিপিএল ছিল আরো বিতর্কিত। ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক না দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল গত ২০২৪-২৫ বিপিএলে। ওই বিপিএলে খেলা দুদল চিটাগং কিংস ও দুর্বার রাজশাহীর বিপক্ষে ছিল ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক আটকে রাখার অভিযোগ। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে হোটেল বিল না দেওয়া, খেলোয়াড়দের দৈনিক ভাতা না দেওয়ার অভিযোগ তো ছিলই।

বিপিএল বিতর্ক ছাড়াও এ বছর অধিনায়কত্ব ইস্যু নিয়েও হয়েছে বেশ জল ঘোলা। চলতি বছরের মে মাসে শ্রীলঙ্কা সফরে যায় বাংলাদেশ। ওই সফরে ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব থেকে শান্তকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব পান মেহেদি হাসান মিরাজ। একই সিরিজে পূর্ণ অধিনায়ক হিসেবে টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব পান লিটন দাস। ওয়ানডে অধিনায়কত্ব সরিয়ে দেওয়ার পর নিজ থেকে টেস্ট দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। তবে সে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি তিনি। অক্টোবরে ফের তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় বিসিবি। তার অধীনে আয়ারল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা।

বিপিএল নির্বাচন ও অধিনায়কত্ব ইস্যুর পাশাপাশি মাঠের বাইরের সমালোচনা ছিল বিসিবির সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদকে নিয়ে। গত বছরের জুলাই বিপ্লবের পর বিসিবি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। ধারণা করা হয়েছিল অক্টোবরে বিসিবি নির্বাচন পর্যন্ত তার কাঁধেই থাকবে বিসিবির দায়িত্ব। তবে চলতি বছরের মে মাসে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিসিবির সভাপতি পদ থেকে। সে সময় বিসিবিতে থাকা ১০ পরিচালকের আটজনই তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনায় পদত্যাগ করতে হয় তাকে। পরে তার স্থলাভিষিক্ত হন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আইসিসির চাকরি ছেড়ে এই দায়িত্ব নেন তিনি। তার অধীনে চলতি বছরের অক্টোবরে হয় নির্বাচন। যে নির্বাচন ঘিরে আছে নানান বিতর্ক, সে নির্বাচনের পর ফের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান বুলবুল।

মাঠের বাইরের এত সমালোচনার মাঝে আরো একটি সমালোচনা অনেক বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। চলতি বছরের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে আম্পায়ার শরফুদৌল্লা ইবনে শহীদ সৈকতের সঙ্গে ঝামেলা। মাঠে তৈরি হওয়া বাগ্‌বিতণ্ডার কারণে তাওহিদ হৃদয়কে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ করেন ম্যাচ রেফারি নিয়ামুর রশিদ রাহুল। পরে আবেদন করে সেই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমিয়ে আনে হৃদয়ের ক্লাব মোহামেডান। তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে বিসিবির চাকরি ছেড়ে দেন আইসিসির এলিট প্যানেল আম্পায়ার সৈকত। এর আগে অবশ্য তাওহিদ হৃদয় সংবাদমাধ্যমে তাকে নিয়ে করেন বাজে মন্তব্য। সব মিলিয়ে এ ঘটনাও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল চলতি বছর।

মাঠের ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাজে পারফরম্যান্স করে বাংলাদেশ দল। বোলিং অ্যাকশন সমস্যার কারণে সাকিব আল হাসান ও অফ ফর্মের কারণে লিটন দাস ছিলেন না চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলে। তাদের ছাড়াই ভারত ও নিউজিল্যান্ডের কাছে ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। অথচ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলার লক্ষ্য নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এমনকি ওই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর শারজায় আরব আমিরাতের কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারে বাংলাদেশ দল। এরপরই টি-টোয়েন্টি নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় লিটন দাসের কাঁধে। তার অধীনে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টানা তিন টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতে বাংলাদেশ।

টানা তিন টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের স্মৃতি নিয়ে এশিয়া কাপে গেলেও সেখানে বলার মতো পারফর্ম করতে পারেনি বাংলাদেশ। সুযোগ ছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার। তবে পারফরম্যান্সের কারণে সুপার ফোরের বাধাটাই পার করতে পারেনি দল।

এতসব নেতিবাচকতার মধ্যে খানিকটা ইতিবাচকতাও ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটে। এ বছরই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শততম টেস্ট খেলেন মুশফিকুর রহিম। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে মুশফিকের রেকর্ড গড়ার সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জিতে নেয় বাংলাদেশ। এছাড়া বছরের শেষদিকে আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের রেকর্ড ৯ কোটি ২০ লাখ টাকায় দল পান মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া দেশের বাইরের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে তাসকিন আহমেদ-রিশাদ হোসেনদের পারফরম্যান্স অনেকটাই আশাবাদী করে তুলেছে বাংলাদেশকে।

শেষ পর্যন্ত নেতিবাচকতার এই ঝড় থামিয়ে ইতিবাচক হতে পারে কি না বাংলাদেশের ক্রিকেট-সেটাই দেখার অপেক্ষা।ত

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়: