টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ

বয়সে ২৫, মননে ১২!

এম. এম. কায়সার
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ১২: ০০
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ১৬: ২২
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্বীকৃতির আজ ২৫ বছর হলো। ছবি: এএফপি

একটা ক্রিকেট গল্প দিয়ে শুরু করি।

২০০০ সালের নভেম্বর। স্থান ঢাকা স্টেডিয়াম। অভিষেক টেস্ট ম্যাচ শেষ হলো চার দিনে। বাংলাদেশ হারল। ভারত জিতল ৯ উইকেটে। টেস্ট ম্যাচ তো পাঁচ দিনের হয়, চার দিনে ম্যাচ শেষ হতে বাংলাদেশ দলের এক ব্যাটার (ব্যাটিং পজিশন বললে সবাই চিনে যাবেন) বললেন, আসলে অভিষেক টেস্ট চার দিনেই শেষ হয়!

বিজ্ঞাপন

নেহাত কোনো কৌতুক নয়, তার জানাটাই ছিল এমন। সেই বিশ্বাস নিয়েই তিনি অভিষেক টেস্ট চার দিনেই শেষ হওয়ার এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন।

টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্বীকৃতির আজ ২৫ বছর হলো। সেই অর্জনের রজতজয়ন্তী উৎসব আজ পালন করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বেশ মহা আয়োজনে। তবে বয়স ২৫ হলেও এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের অর্জন, ব্যর্থতা এবং অনেককিছু না জানা, না করা, না মানা এবং সর্বোপরি না শেখার যোগফল জানাচ্ছে মননে এখনো বাংলাদেশ আটকে আছে ১২ তে!

বয়সে সাবালক কিন্তু চিন্তা, কর্ম এবং ফলাফলে এখনো টেস্ট ক্রিকেটে নাবালক পর্যায়ে। এই ২৫ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে যে ঠিকানায়, যে মর্যাদায় বাংলাদেশের পৌঁছানোর কথা ছিল, সেটা হয়ে উঠেনি। এই ব্যর্থতার দায় কার?

নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি দায় ক্রিকেট পরিচালকদের। ক্রিকেটকে গড়ে তোলার শপথ নিয়ে যারা ক্রিকেট বোর্ডের গদিতে আসীন হয়েছিলেন, এই ২৫ বছরে তাদের মেদ বেড়েছে ঠিক, কিন্তু এই ফরম্যাটে দেশের ক্রিকেট ক্রমশ ক্ষীণ হাড্ডিসার হয়েছে!

টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা প্রাপ্তির রজতজয়ন্তীতে এসে আমরা এখনো এই ফরম্যাটে নিজেদের উন্নতির জন্য যে পর্যায়ের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের কথা ভাবছি তাতেই স্পষ্ট যে বাকি দেশগুলোর চেয়ে আমরা এখনো অনেক পেছনে। দুই যুগের বেশি হয়ে গেল। সবমিলিয়ে ১৫৫টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। মাত্র ২৩ টেস্টে জয়। ১১১ টেস্টে হার। ড্র ১৯ ম্যাচে। ফলাফলে স্পষ্ট যে বাংলাদেশ দল এই ফরম্যাটে এখনো শিক্ষানবিশ। যুক্তি হিসেবে আপনি বলতে পারেন আমরা ফলাফলের চেয়ে প্রক্রিয়ায় বেশি জোর দিচ্ছি। সেই প্রক্রিয়াও যে পুরো গলদ ভরা সেটা তো আরো স্পষ্ট।

২৫ বছর ধরে একটা ফরম্যাটে খেলার পর যদি এখনো প্রতিদিন ‘ছাত্র’ হয়েই থাকতে হয়, তাও আবার ‘বাজে ছাত্র’; তাহলে আপনি কি পরিণত হয়েছেন? দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অর্জন-বিসর্জন, আনন্দ-বেদনা, উন্নতি-অবনতির রেখচিত্র পরিষ্কার জানাচ্ছে- না পারেনি। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের লম্বা সময় ধরে নবিশি আচরণ ও শিশুতোষ ভুল এবং মানিয়ে নিতে না পারার ক্রমাগত ব্যর্থতায় এই ফরম্যাটে আমরা আগেও ‘বাজে ছাত্র’ ছিলাম। এখনো তাই রয়েছি।

২০০০ সালের নভেম্বরে আমরা যখন প্রথম টেস্ট খেলতে শুরু করি তখন র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশ দলের মধ্যে দশম। এখন টেস্ট খেলে ১২টি দল। বাংলাদেশের সর্বশেষ র‌্যাংকিং নবম! ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষলেই আপনি বুঝতে পারবেন দুই যুগ আগে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ যেখানে শুরু করেছিল এখনো ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে শুধু বয়সটাই বেড়েছে, মেধার বিকাশ ঘটেনি যথাযথ। তবে ক্রিকেট বোর্ডে আসীন অনেকের ‘ক্যাশ’ বেড়েছে ঠিকই।

ব্যক্তিগত কৃতিত্বের কল্যাণে পেছনের দুই যুগের টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ কখনো-সখনো মর্যাদাপূর্ণ শিরোনাম পেয়েছে। তবে বেশির ভাগ সময় এর উল্টোপিঠ দেখেছে। ক্রিকেটে দিন শেষে সাফল্যের হিসাব হয় ফলাফল দিয়েই। আপনি যতই প্রক্রিয়ার গুণগান গান না কেন, নিক্তিতে সাফল্য যোগ না হলে সেই পরিশ্রম কেউ মনে রাখে না। টেস্ট ক্রিকেটের সেই অঙ্কে বাংলাদেশ একেবারে শুরুর সময় থেকে পিছিয়ে। আজ ২৫ বছর ধরে টেস্ট খেলে এসে আসার পরও সেই কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়াই রয়ে গেল!

টেস্ট ক্রিকেট শেখার জায়গা নয়। পারফরম্যান্স করার জায়গা। আমাদের সমস্যা হলো আমরা টেস্টে খেলতে নামছি শেখার মন্ত্র জপে। আর প্রতিপক্ষ তখন নামছে দাপট দেখাতে। এই মঞ্চে বাংলাদেশের সঙ্গে বাকিদের পার্থক্যটা মূলত ওখানেই স্পষ্ট।

এই ফরম্যাটে টিকে থাকতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রথম শর্তই হলো প্রস্তুতির জন্য সঠিক মঞ্চ। যে মঞ্চের নাম ঘরোয়া ক্রিকেট। কিন্তু আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্য নাম যে পিকনিক ক্রিকেট! আর তাই ঘরোয়া ক্রিকেটে হাজার হাজার রান করা বা সেঞ্চুরির উৎসব তোলা ক্রিকেটার নবিশ ও নাজুক হয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসরে। এই যুক্তির পেছনে উদাহরণ খুঁজছেন? এনামুল হক বিজয় বা তুষার ইমরানের ক্যারিয়ারে চোখ বুলিয়ে নিন, আপনার দ্বিধা কেটে যাবে।

বিসিবি কর্তার চেয়ারে বসে পুরো প্রতিষ্ঠানকে ধান্দাবাজি ও লুটপাটে পরিণত করা। রাজনৈতিক ও ক্লাব স্বার্থের কোটারিতে ক্রিকেটকে অপব্যবহার করা। গঠনতন্ত্রকে নিজের মতো করে সাজিয়ে ছক কেটে নির্বাচন করা। বিসিবিকে নিজের বাপ-দাদার জায়গিরদার ভাবতে শুরু করা। যুগের পর যুগ লোকদেখানো ভোটের নামে বিসিবির চেয়ার দখলে রাখা। দুর্বল পরিকাঠামো। পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব। পরিচালনায় পেশাদারত্বের সংকট। নিজস্ব ক্রিকেট সম্পদ, মস্তিষ্ক এবং তাদের শক্তি-সামর্থ্যর ওপর আস্থাহীনতা। দ্রুত ছাঁটাই। অতিরিক্ত বাছাই। উইকেট নিয়ে ক্লাব কর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে অনাদার-অবহেলা। বছরব্যাপী প্রতিভা অন্বেষণের কার্যকর তাগিদের অভাব। সর্বোপরি ঘরোয়া ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচের মচ্ছব। ক্লাব কর্তাদের মর্জিতে আম্পায়ারদের আঙুল তোলার দাসত্বগিরি- এসব অনাচার ও কুপ্রথা আমাদের বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের সম্ভাবনাকে ক্রমশ শূন্য এবং ফোকলা করে দিয়েছে। ঘরোয়া ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মানের এই ব্যবধান যতদিন না ঘুচবে ততদিন পর্যন্ত এই ফরম্যাটে আমাদের মানসিক বিকাশের বুদ্ধি ১২/১৩ গোরোয় আটকে থাকবে! দৈহিক বৃদ্ধি হবে। বয়স বাড়বে। কিন্তু আমরা সেই শিশু এবং শূন্যের ঘরেই আটকে থাকব, ওই শুরুর দিনের মতোই!

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত