তিনি সরকারে ছিলেন একসঙ্গে দুটি মন্ত্রণালয়ে। কোনো দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ছিলেন না। তবে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তীতে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে তার কাগজে-কলমে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সখ্য যে ছিলÑসেটা খুবই স্পষ্ট। নিজের রাজনীতিতে নামা এবং নির্বাচন করার বিষয়টিও অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার করেছিলেন তিনি। শুধু অস্পষ্ট রাখলেন নিজ রাজনীতির ঠিকানা। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতাশালী চেয়ারে প্রায় ১৬ মাস বসার পর যেদিন সেই হটসিট ছেড়ে দিচ্ছেন, সেদিনই অবশ্য নিজের ‘রাজনীতির স্থায়ী ঠিকানা’র বিষয়টি রহস্যজনকই রাখলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
নির্বাচন করলে সরকারি পদ থেকে সরে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক। সেই নিয়মে অঙ্ক কষে এটা জানাই ছিল যে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রাক্কালেই উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন আসিফ এবং হলোও ঠিক সেটাই। নির্বাচন কমিশন আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে; সেই ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা আগে উপদেষ্টার চেয়ার থেকে সরে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন আসিফ মাহমুদ। দুপুরে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন এবং সন্ধ্যায় হাসিমুখে পদত্যাগপত্র দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন করলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু সিদ্ধান্ত কোলাহল তৈরির আগে নীরবতার জন্ম দেয়। সময়ের পরিক্রমায় সেই নীরবতাই পরে ঝড় হয়ে ওঠে। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পদত্যাগের বিষয়টিও আপাতত অমন কিছু। হালকা চালে মৃদু ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া, কিন্তু পেছনে রয়ে যায় নীরব কোলাহল!
কোনো সন্দেহ নেই এই কোলাহল আজ থেকে আরো সরব হচ্ছে। আজ থেকে আসিফের প্রতিটি পদক্ষেপেই তার রাজনৈতিক পথরেখার জবরদস্ত খোঁজের শুরু হবে। ক্ষমতায় থাকায় এতদিন অনেক সমস্যা তিনি কাচের ঘরে বসে দেখেছেন, সেভাবেই সমাধান খুঁজেছেন। প্রশ্রয়ও পেয়েছেন। প্রতিরোধটা তাতে তার সহজ হয়েছে। এখন ক্ষমতার বাইরে আসার পর রাজনীতির অনেক রূঢ়তা তাকে দেখতে হবে। কঠিন লড়াইটা হয়তোবা একাই লড়তে হবে। রাজনীতির মাঠে আসিফের সেই জটিল পরীক্ষার সময় শুরু আজ থেকেই।
পরিপ্রেক্ষিত যখন বাংলাদেশের রাজনীতি, তখন এখানে অনেক সময় দুই যোগ দুই চার নয়, পাঁচও হয়! এই রাজনীতির প্রবেশদ্বার চৌকাঠ বড়ই অদ্ভুত। খালি চোখে তাকিয়ে আপনি যাকে বন্ধ দরজা বলে ভাবছেন, দেখা গেল সেটাই খোলা অর্গল। নতুন মৌসুমে খেলোয়াড়রা দলবদল করেন। কখনো আগের দলে থেকে যান; আবার কেউ নতুন দল বেছে নেন। ১৬ মাস ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ অভিভাবকের হটচেয়ারে থাকা আসিফ মাহমুদ আজ থেকে রাজনীতির মাঠের সাধারণ খেলোয়াড়।
বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত-নির্বাচনের আগে দলবদলের এই মৌসুমে কাকে বেছে নিচ্ছেন আসিফ অথবা কোন দল তাকে নিতে আগ্রহী সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে একলা চলো স্লোগান তুলে রাজনীতি এবং নির্বাচনের মাঠে নামবেন আসিফ, সেই কৌতূহলের কেমিস্ট্রি গাঢ়ই হচ্ছে। রাজনীতি কখনো কখনো অদৃশ্য সংকেতে কাজ করে।
কোনো কোনো সিদ্ধান্ত হয় আলোচনার টেবিলে, আবার কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা প্রতিভাত হয় সময়ের ছায়াতে। আসিফ মাহমুদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঠিকানাও খুব সম্ভবত এখন তেমন কিছুই।
দেড় বছর আগে ক্রীড়া উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার দিনে আসিফ বলেছিলেন, ‘আমরা মানুষ, নাকি সিস্টেমে বদল আনতে চাই।’ বেশি নয়, একটি উদাহরণ দিই শুধু। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় যে প্রক্রিয়ায় ও খবরদারি করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচন করেছে, তাকে সিস্টেম বদল বলে না। তাকে বলে দখলদারিত্ব।
উপদেষ্টা থাকাকালীন সময় আসিফ তার কাজের মহিমায় যতটুকু না আলোচনায় এসেছেন, তারচেয়ে ঢের বেশি সমালোচনায় দগ্ধ হয়েছেন তাকে ঘিরে ওঠা বিতর্কের আগুনে। তার এপিএসের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ আজও দুদকে ঝুলছে। নিশ্চিত থাকতে পারেন, এই অভিযোগ নির্বাচনে বড় করে তোলা হবে-এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দক্ষ স্ট্রাইকারের মতো অতীতের বিতর্ককে ডজ দিয়ে ময়দানি লড়াইয়ে আসিফ কতখানি সফল হবেন সেটা সামনের সময়ই বলে দেবে। সে সময়ও আবার বেশি নয়, মাত্র দুই মাস! আসিফ মাহমুদের জন্য সামনের সময়ের এই ‘খেলা’ সহজ কিছু নয়।
আসিফ কী জিতবেন এই ম্যাচ?

