ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট ময়মনসিংহ, ২ মাসে মৃত্যু ১৩

আব্দুল কাইয়ুম, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ৪২

ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ময়মনসিংহে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। একদিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মমেক) ডেঙ্গু ইউনিটে শয্যা সংকট, অন্যদিকে শহরজুড়ে মশার উপদ্রব। সব মিলিয়ে নগরবাসীর জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ।

ময়মনসিংহ মেডিকেলের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ২৪টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছেন চারগুণেরও বেশি রোগী। ওয়ার্ডের ফ্লোরের ধুলোবালি ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের মধ্যে কেউ করিডোরে, কেউবা মাদুর বিছিয়ে শুয়ে স্যালাইন নিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডের করিডোর, বারান্দা এমনকি সিঁড়ি পর্যন্ত রোগীতে ভরা। নার্স ও চিকিৎসকদের পক্ষে এত রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, ফ্লোরে থাকা রোগীদের সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এটি ডেঙ্গুর জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মমেক হাসপাতালে এক হাজার ৮০২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে সেপ্টেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ১১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮৫, নারী ২৪ ও শিশু ছয়জন। প্রতিদিনই নতুন রোগী আসছেন, কিন্তু বেড খালি নেই। এ কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে করিডোরে বা মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

অন্যদিকে, বিভাগের অন্যান্য জেলার হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর চাপ। গত বৃহস্পতিবারের তথ্যানুযায়ী, জামালপুরের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩১, শেরপুরে ২৪ ও নেত্রকোনায় ২৯ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ময়মনসিংহ এখন দেশের নতুন ডেঙ্গু হটস্পট। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় বিভাগজুড়ে নতুন করে শতাধিক আক্রান্ত হয়েছেন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন খান বলেন, প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে যেহেতু অনেক রোগী ভর্তি রয়েছে সেহেতু আমরা মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। দুয়েক দিনের মধ্যে ডেঙ্গু রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ডে নেওয়া হবে ফলে শয্যা নিয়ে কিছুটা জটিলতা কমবে।

হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. জাকিউল ইসলাম বলেন, চিকিৎসক ও নার্সরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু হাসপাতালে রোগীদের থাকার জায়গা সীমিত। মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।

এদিকে, হাসপাতালের ভেতরে রোগীর কষ্ট যেমন তীব্র, তেমনি শহরের ঘরে ঘরে এখন মশার রাজত্ব। সন্ধ্যা নামলেই যেন শহর ঢেকে যায় মশার ঝাঁকে। কয়েল, স্প্রে, ব্যাট কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

নগরীর দুর্গাবাড়ী রোডের বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, সন্ধ্যার পর ঘরে বসে থাকা দায়। শিশুরা ঘুমাতে পারে না, সকালে ক্লান্ত হয়ে স্কুলে যায়।

ভাটিকাশর এলাকার গৃহিণী রীপা জানান, ড্রেন, খাল ও আবর্জনার স্তূপ এখন মশার প্রজননস্থল। সিটি করপোরেশনের ধোঁয়া ছড়ানোর কাজ শুধু নামকাওয়াস্তে।

মীরবাড়ি এলাকার জাহিদ হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মশা নিধনে করপোরেশন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ড্রেন ও নালার পাশে মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন।

সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশা নিধনের ১ দশমিক ৫ কোটি টাকা বাজেটের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে।

গত ২০ অক্টোবর থেকে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ চালু হয়েছে দাবি করা হলেও বাস্তবে তার ফলাফল চোখে পড়ছে না।

সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এইচকে দেবনাথ বলেন, মশা নিধনের কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। তবে এর পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানও অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়মনসিংহের ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রশাসনিক গাফিলতি ও অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার ফল। নিয়মিত ফগিং, লার্ভা ধ্বংস ও ড্রেন পরিষ্কারের কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। ফলে মশার প্রজনন বেড়ে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত