উত্তর আয়ারল্যান্ডের জায়ান্টস কজওয়ে: হুমকির মুখে ৬ কোটি বছরের ইতিহাস

ফাতিমা তামান্না
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৫, ১৫: ২১
আপডেট : ৩১ মে ২০২৫, ১৫: ২৬
জায়ান্টস কজওয়ের ব্যাসেল্ট স্তম্ভ

উত্তর আয়ারল্যান্ডের ইউনেস্কো স্বীকৃত প্রাকৃতিক বিস্ময় জায়ান্টস কজওয়ে। পর্যটকদের অসচেতন আচরণে পরিবেশগত হুমকির মুখে পড়েছে স্থানটি। পর্যটকদের মুদ্রা গুঁজে দেওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ব্যাসল্ট পাথরের স্তম্ভগুলো, যা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষতি নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ঐতিহাসিক ক্ষতিও বটে।

ইউনেস্কো ১৯৮৬ সালে একে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক এখানে ভ্রমণ করতে আসেন। তবে সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের পাথরের ফাঁকে মুদ্রা গুঁজে দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ন্যাশনাল ট্রাস্ট বিভিন্ন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে এবং ‘লিভ নো ট্রেস’ নীতিমালাকে উৎসাহিত করছে, যাতে মানুষ প্রকৃতি উপভোগ করে তাকে নষ্ট না করে।

বিজ্ঞাপন

প্রাকৃতিক বিস্ময় জায়ান্টস কজওয়ে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় ভূতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। অতিরিক্ত ভ্রমণকারীদের পদচারণা, পাথরের ওপর উঠা, মুদ্রা আটকানো ইত্যাদি কার্যকলাপ জায়ান্টস কজওয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জায়ান্টস কজওয়ের ব্যাসল্ট স্তম্ভগুলো সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ৬ কোটি বছর আগে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে লাভা নির্গত হয়ে ঠাণ্ডা হয়ে জমে যাওয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল স্তম্ভগুলো। এখানে প্রায় ৪০ হাজার স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলোর বেশিরভাগই ষড়ভুজাকার এবং নিখুঁতভাবে স্থাপিত। এই স্তম্ভগুলোর উচ্চতা ভিন্ন ভিন্ন, কিছু স্তম্ভ সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১২ মিটার উঁচু। এ এক অপূর্ব ভূতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বজুড়ে ভূমিজ্ঞানী ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। স্তম্ভগুলো এমনভাবে তৈরি, একে অনেক সময় প্রাকৃতিক কীর্তি না বলে মনে হয় মানুষের নির্মাণ করা।

জায়ান্টস কজওয়ে শুধু উত্তর আয়ারল্যান্ডের নয়, বরং গোটা যুক্তরাজ্যের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এই স্থান নিয়ে কল্পকাহিনীভিত্তিক লোককথা প্রচলিত আছে। মনে করা হয়, আইরিশ দৈত্য ফিন ম্যাককুল স্কটিশ দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করার জন্য এই পথ তৈরি করেছিলেন। এই কাহিনীর কারণে স্থানটি পর্যটকদের কাছে আরো আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উত্তর আয়ারল্যান্ডের জায়ান্টস কজওয়ে একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়, যা পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় ভূতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এই স্তম্ভগুলোর ফাঁকে পর্যটকরা মুদ্রা গুঁজে দিত। তাদের বিশ্বাস, এই মুদ্রা স্থাপনের মাধ্যমে ভাগ্য খুলে যাবে।

অনেকের কাছে শুভ কামনার প্রতীক বা সৌভাগ্য কামনার একটি রূপও ছিল এটি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মুদ্রা স্থাপন পাথরের জন্য ক্ষতিকর। ন্যাশনাল ট্রাস্টের তথ্যমতে, এসব মুদ্রায় থাকা তামা, লোহা বা নিকেলে বৃষ্টির পানিতে মরিচা ধরে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পাথরের গঠন দুর্বল করে ফেলে। ফলে স্তম্ভগুলোর গায়ে ছিদ্র তৈরি হয় এবং ভেতর থেকে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে।

প্রাচীন ব্যাসল্ট স্তম্ভের মধ্যে মুদ্রা আটকে দেওয়া অনেকের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক হলেও ন্যাশনাল ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়কে ‘ধ্বংসাত্মক’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। সংস্থার মুখপাত্র জানান, ‘মুদ্রায় থাকা ধাতব উপাদান যেমন লোহা বা তামা বৃষ্টির সংস্পর্শে মরিচা ধরে, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পাথরের অভ্যন্তরীণ গঠন দুর্বল করে ফেলে।’ বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, মরিচার কারণে পাথরের ভেতরে চাপ তৈরি হয়, যা সময়ের সঙ্গে স্তম্ভ ভেঙে পড়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ফলে এই নিদর্শনের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ন্যাশনাল ট্রাস্টের মতে, মুদ্রাগুলোতে থাকা ধাতব উপাদান যেমন লোহা, তামা ও নিকেল বৃষ্টির সংস্পর্শে মরিচা ধরে এবং আকারে তিনগুণ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই প্রসারণ পাথরের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, ফলে স্তম্ভগুলো ফেটে যায় ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এ ছাড়া মরিচা থেকে সৃষ্ট লালচে দাগ পাথরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে।

মূলত, ভালোবাসা পাওয়া বা ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রাচীন ব্যাসল্ট স্তম্ভের মধ্যে মুদ্রা রেখে যাওয়া হয়। ঠিক যেমন প্যারিসের পন্ট ডেস আর্টস ব্রিজে তালা ঝুলিয়ে রাখা হতো।

২০১৪ সালে সেতুর কিছু অংশ ভেঙে পড়ার পর প্যারিসের সেতুতে তালা লাগানো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

জায়ান্টস কজওয়ে কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়- এটি পৃথিবীর ইতিহাসের পাথরে খোদাই করা এক প্রাকৃতিক মহাকাব্য। এমন একটি নিদর্শন মানুষের সামান্য অসচেতনতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে না। সময় এসেছে সবাই মিলে এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করার।

স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তোলা যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির হৃদয়ে আর কোনো ছিদ্র নয়।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত