আতঙ্কে কাঁপছে ভারত

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ৪৩

এশিয়ার দেশ ভারতের ওপর আজ বুধবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হবে। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এ-সংক্রান্ত নোটিস জারি করেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ভারতীয় রপ্তানিকারকরা। খবর বিবিসি ও রয়টার্সের।

যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির তথ্যমতে, বুধবার রাত ১২টার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী অথবা গুদাম থেকে প্রত্যাহার করা ভারতীয় পণ্যের ওপর নতুন এ শুল্ক প্রযোজ্য হবে।

বিজ্ঞাপন

দিল্লির ওপর এ শুল্কারোপ করা হচ্ছে রুশ তেল কেনার শাস্তি হিসেবে।

হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এবং মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টের অভিযোগ, রাশিয়ার তেল কেনা বৃদ্ধি করে ভারত পরোক্ষভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থায়ন করছে এবং এটি বন্ধ হওয়া উচিত।

চলতি মাসের শুরুতে বেসেন্ট বলেছিলেন, ভারত রাশিয়ান তেল কিনে লাভবান হচ্ছে, যা এখন ভারতের মোট তেল আমদানির ৪২ শতাংশ। যদিও যুদ্ধের আগে এটি ১ শতাংশেরও কম ছিল। এ পরিবর্তনকে অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছে ওয়াশিংটন।

এমন পরিস্থিতিতে আজ থেকে ভারতের রপ্তানিপণ্যের ওপর ‍যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন দিল্লির পোশাক রপ্তানিকারকরা।

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চিংড়ি এবং রত্ন ও অলংকারসহ বিভিন্ন পণ্যের বড় রপ্তানিকারক ভারত। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ান তেল এবং অস্ত্র কেনার জন্য উচ্চ শুল্কারোপ ভারতীয় পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার অনুরূপ।

ভারতের বৃহত্তম টেক্সটাইল রপ্তানি কেন্দ্রগুলোর একটি তিরুপুরে এন কৃষ্ণমূর্তির পোশাক উৎপাদন ইউনিটে অদ্ভুত এক নীরবতা বিরাজ করছে। শ্রমিকরা যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতাদের জন্য শিশুদের পোশাক তৈরি করছেন। প্রায় ২০০টি সেলাই মেশিনের মাত্র সামান্য কিছু চালু আছে। ঘরের এক প্রান্তে নতুন ডিজাইনের কাপড়ের নমুনার স্তূপে ধুলা জমেছে।

শুধু এ কারখানা নয়, তিরুপুরজুড়েই একই অবস্থা। শহরটি ভারতের ১৬ বিলিয়ন ডলার রেডি-টু-ওয়্যার পোশাক রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশের জন্য অবদান রাখে। তারা পণ্য তৈরি করে টার্গেট, ওয়ালমার্ট, গ্যাপ ও জারার মতো ব্র্যান্ডের জন্য। শাস্তিমূলক শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় এই শহরে।

ক্লায়েন্টরা সব অর্ডার স্থগিত করে দিয়েছেন বলে জানান কৃষ্ণমূর্তি। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের পর থেকে হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না।

সম্প্রতি কৃষ্ণমূর্তিকে তার কারখানার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা স্থগিত করতে হয়েছে এবং শুল্কারোপের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রায় ২৫০ জন নতুন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করতে হয়েছে।

যে সময়ে শুল্কারোপ করা হয়েছে, সেটির কারণেও পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য। কেননা, পুরো বছরে যে পরিমাণ পোশাক রপ্তানি হয় তার প্রায় অর্ধেকই হয় এই মৌসুমে অর্থাৎ বড়দিনের আগে।

আরেকটি কারখানা, যেখানে অন্তর্বাস তৈরি হয়, তারা প্রায় ১০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ পণ্য তৈরি করেছে। সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলোর জন্য নির্ধারিত ছিল কিন্তু এখন সেগুলোর কোনো ক্রেতা নেই।

র‍্যাফ্ট গার্মেন্টসের মালিক শিভা সুব্রামানিয়াম বলেন, আমরা আশা করেছিলাম ভারত আমেরিকার সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করবে। গত মাসে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। যদি এ ধারা চলতে থাকে তবে আমি কীভাবে কর্মীদের বেতন দেব?

৫০ শতাংশ শুল্কহারে ভারতীয় তৈরি শার্ট যা এক সময় ১০ ডলারে বিক্রি হতো এখন তার দাম পড়বে ১৬ দশমিক ৪ ডলার, যা চীনের ১৪ দশমিক ২ ডলার, বাংলাদেশের ১৩ দশমিক ২ ডলার বা ভিয়েতনামের ১২ ডলারের চেয়ে অনেক বেশি। শুল্ক ২৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হলেও ভারত তার এশিয়ান প্রতিযোগীদের তুলনায় কম সুবিধা পাবে।

এ ধাক্কা সামলাতে সরকার কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেÑউদাহরণস্বরূপ কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক স্থগিত করা। বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনাও গতি পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে এ উদ্যোগ খুবই নগণ্য। এছাড়া অনেক দেরিও হয়ে গেছে।

গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় ​​শ্রীবাস্তব বলেন, মার্কিন ক্রেতারা মেক্সিকো, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশে চলে যাবেন বলে আমাদের মনে হয়।

প্রায় এক হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে মুম্বাইয়ের একটি রপ্তানি অঞ্চলে শত শত শ্রমিক হীরা ঘষে চকচকে করা এবং প্যাকিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন, যা ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও অলংকার রপ্তানি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এখানকার জুয়েলারি ব্র্যান্ডগুলো সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে তাদের বিক্রির ওপর শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। কেননা এই সময়ে তিনি থেকে চার বিলিয়ন ডলার মূল্যের অলংকার যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে।

ক্রিয়েশন জুয়েলারির আদিল কোতোয়াল তার ৯০ শতাংশ হীরাখচিত গহনা যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেন। তার আশঙ্কা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের নতুন বাণিজ্য অংশীদারত্ব সুযোগের দ্বার উন্মোচন করলেও যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিতি গড়ে তোলার জন্য বছরের পর বছর ধরে করা প্রচেষ্টা কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যর্থ হতে পারে।

কোতোয়াল তার হীরা গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহর থেকে সংগ্রহ করেন। বিশ্বের হীরা কাটা ও মসৃণ করার কেন্দ্রস্থল সুরাট। বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাস এবং ল্যাব-উৎপাদিত হীরার প্রতিযোগিতার কারণে শুল্কারোপের অনেক আগে থেকেই একটি সংকট তৈরি হচ্ছিল। এখন শুল্ক দ্বিগুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকান গ্রাহকরা উধাও হয়ে গেছেন এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহকারী কারখানাগুলো এখন প্রতি মাসে মাত্র ১৫ দিন চালু থাকছে। শত শত চুক্তিবদ্ধ কর্মীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

শুল্কারোপের আগেই ভারতের চিংড়িশিল্পেও ধাক্কা লাগতে শুরু করে। ইতোমধ্যে ভারতের অনেক চিংড়িচাষি এ ধাক্কা থেকে বাঁচতে অন্যান্য পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র এর প্রধান বাজার।

অন্যান্য শুল্কের পাশাপাশি চিংড়ির ওপর মোট শুল্ক এখন ৬০ শতাংশের বেশি হবে, যা এ খাতের জন্য একটি বড় ধাক্কা। কারণ শুল্ক ঘোষণার পর থেকে প্রতি কেজিতে দাম শূন্য দশমিক ৬০ থেকে শূন্য দশমিক ৭২ ডলার কমেছে এবং ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর এ দাম আরো কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

থোটা জগদীশ নামে এক রপ্তানিকারক বলেন, বড়দিন এবং নববর্ষের সময় যুক্তরাষ্ট্রে চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকে। সে অনুযায়ী এখানকার কৃষকরা তাদের নতুন চাষাবাদ শুরু করেছেন। এখন ট্রাম্পের শুল্কারোপের ফলে বিরাট অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

হ্যাচারি অপারেটররা বলছেন, অনিশ্চয়তার ফলে তারা চিংড়ির লার্ভা উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছেন।

বীরভসারম শহরের শ্রীমন্নারায়ণ হ্যাচারির এমএস ভার্মা বলেন, আগে আমরা বছরে গড়ে ১০ কোটি চিংড়ির লার্ভা উৎপাদন করতাম। এখন, আমরা ছয়-সাত কোটিতেও পৌঁছতে পারছি না।

ধারণা করা হচ্ছে, এ শুল্কারোপ প্রত্যক্ষভাবে পাঁচ লাখ চিংড়িচাষির জীবিকা এবং পরোক্ষভাবে আরো ২৫ লাখ চিংড়িচাষির জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

এমন একটি দেশে যেখানে ইতোমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী কর্মসংস্থান সংকট চলছে, সেখানে এ পরিসংখ্যানগুলো সত্যিই উদ্বেগজনক।

আপাতত ভারত ও আমেরিকার মধ্যে অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। বিগত সপ্তাহগুলোয় বাণিজ্য আলোচনার পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে। চলতি সপ্তাহে দিল্লিতে শুরু হতে যাওয়া বাণিজ্য আলোচনা ইতোমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এমতাবস্থায় মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতের সমালোচনা দ্বিগুণ করেছেন।

এশিয়া গ্রুপের গোপাল নাদ্দুর বলেন, ভারত-মার্কিন আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারের ওপর নির্ভর করছে, যার মধ্যে রাশিয়া ও চীন জড়িত। ভারতের নীতিনির্ধারক এবং ব্যবসায়ী নেতাদের এখন মন্ত্র হওয়া উচিতÑআত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি, বৈচিত্র্য আনা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত