সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের প্রথম বার্ষিকীতে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে বাংলাদেশের মানুষ। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে জয়োৎসবে ঢাকায় জড়ো হন হাজারো জনতা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
দেশজুড়ে কনসার্ট, সমাবেশ এবং বিশেষ প্রার্থনা সভাযর আয়োজন করা হয়। স্বৈরশাসক হাসিনার পতনকে ১৭ কোটি মানুষের এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ বলে অভিহিত করে। তবে এই আনন্দঘন দৃশ্যগুলোতে গত ১২ মাসের পুরো গল্প উঠে আসেনি।
অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, দেশটিতে গণপিটুনি, গণ-সহিংসতা বা মব ভায়োলেন্স, প্রতিশোধমূলক আক্রমণ এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থানের ঘটেছে; এরফলে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা লাইনচ্যুত হওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।
এদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বরাবরই মারাত্মক দমন-পীড়নে তার ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ মোকাবেলা করতে দেশে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
নারী অধিকারকর্মী শিরিন হক বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা একটি শাসন পরিবর্তন দেখেছি, বিপ্লব নয়। কারণ নারীবিদ্বেষ এখনও অটুট রয়েছে এবং পুরুষের আধিপত্য বিদ্যমান রয়েছে।’
শিরিন হক নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনেরও প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের লক্ষ্য প্রতিফলিত করে এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে এই কমিশন গঠন করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার।
চলতি বছরের এপ্রিলে, ১০ সদস্যের এই সংস্থা লিঙ্গ সমতার আহ্বান জানিয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় - বিশেষ করে নারীদের উত্তরাধিকার এবং বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারের ক্ষেত্রে, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার এবং পুলিশ এবং অন্যদের দ্বারা নির্যাতন ও হয়রানির সম্মুখীন হওয়া যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা করার আহ্বান জানায়।
পরের মাসে, হাজার হাজার ইসলামপন্থি প্রস্তাবিত সুপারিশগুলোর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের অভিযোগ, সুপারিশগুলো ইসলামবিরোধী। বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয় হেফাজতে ইসলাম। তাদের একজন প্রতিনিধি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছে। তিনিও নারী কমিশন বিলুপ্ত করা এবং এসব প্রস্তাব দেওয়ার জন্য এর সদস্যদের শাস্তির দাবি জানান।
পরবর্তীতে কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে জনপরিসরে কোনো বিস্তারিত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়নি।
শিরিন হক বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম যখন আমাদের সমালোচনা করে, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের যথেষ্ট সমর্থন না করায় আমি হতাশ হয়েছি।’
অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধের জবাবে ইউনূসের কার্যালয় সাড়া দেয়নি।
অধিকার কর্মীরা বলছেন, হাসিনার আমলে কট্টরপন্থীদের কোণঠাঁসা করে ফেলা হয়েছিল, তারা এখন কীভাবে সাহসী হয়ে উঠেছে, এই বিক্ষোভ তারই একটি উদাহরণ।
দেশের কিছু অংশে মেয়েদের ফুটবল খেলা, বাণিজ্যিক প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে নারী সেলিব্রিটিদের অংশগ্রহণ এবং কিছু ক্ষেত্রে, পোশাকের কারণে প্রকাশ্যে নারীদের হয়রানির অভিযোগও তারা করেছেন।
তবে কেবল নারীরাই এর শিকার হননি। গত বছরে কট্টরপন্থিরা সুফি মুসলিমদের মতো সংখ্যালঘুদের অসংখ্য মাজার ভাঙচুর করেছে।
কিন্তু শিরিন হকের মতো ব্যক্তিরা ভবিষ্যতের দিকে তাকালেও, বাংলাদেশ এখনো পশ্চাৎমুখী।
বেআইনি হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের ওপর নৃশংস দমনের অভিযোগে হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল।
সাংবাদিক এবং দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক ডেভিড বার্গম্যান বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এমন এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা কেবল জবাবদিহিতাই নয়, প্রতিশোধ এবং প্রতিকারও দেখতে চেয়েছিল।’
তবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে যে অবিচার ছিল, তা অব্যাহত থাকা এবং বর্তমান সময়েও সেগুলো পুনরাবৃত্তি করা কাম্য নয়।’
হাসিনার আওয়ামী লীগ দাবি করছে, এমনটাইএটাই ঘটছে। তারা বলেছে, গত এক বছরে তাদের শত শত সমর্থককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এবং সমর্থককে হত্যার অভিযোগে মাসের পর মাস জেল খাটতে হয়েছে। আদালত বারবার তাদের জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন যে এই হত্যার অভিযোগগুলোর কোনো সঠিক তদন্ত হয়নি এবং কেবল আওয়ামী লীগের প্রতি আগের সমর্থনের কারণেই তাদের আটক রাখা হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘একটি বড় ধরনের গণআন্দোলনের পর স্থিতিশীলতা ফিরতে সময় লাগে। আমরা একটি পরিবর্তিত সময়ের মধ্যে রয়েছি।’ নাহিদ ইসলাম ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নাহিদ স্বীকার করেন দেশে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থি প্রভাব নিয়ে যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, বাস্তবতা সেরকম নয়। তিনি বলেন, ‘এটি একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অংশ’ যা বহু বছর ধরে বিদ্যমান।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে উন্নয়নের লক্ষণও রয়েছে। বিশেষ করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং আশঙ্কার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতকে বাঁচিয়ে রাখা।
এছাড়া বাংলাদেশ ঋণপরিশোধের বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছে, খাদ্য দামের স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা হয়েছে। প্রবাসী আয় ও আন্তর্জাতিক ঋণের কারণে শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলানে উন্নিত হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানিও স্থির রয়েছে।
তারপর আরও কিছু বিষয় আছে, যা পরিমাপ করা সহজ নয়।
নাহিদ ইসলাম যুক্তি দেন যে, হাসিনার পতনের পর থেকে, ‘একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এখন প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।’ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যাকাণ্ড এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাসে গড়ে ওঠা এই দেশে এটি উদযাপন করার মতো বিষয়।
কিন্তু কেউ কেউ এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ছাত্র নেতাদের প্রভাব সমালোচনার মুখে পড়েছে। হাসিনার পতনের অভূতপূর্ব বিক্ষোভে নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের এই ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভায় দুজন ছাত্র উপদেষ্টা রয়েছেন এবং সমালোচকরা বলছেন যে আওয়ামী লীগের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞার মতো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছাত্রদের চাপের মুখে নেওয়া হয়েছিল।
বার্গম্যান বলেন, ‘সরকার মাঝে মাঝে কিছু জনপ্রিয় দাবি মেনে নিয়েছে, বিশেষ করে ছাত্রদের। সরকারের আশঙ্কা ছিলো, দাবি না মানলে হয়তো নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হতে পারে। তবে, এটি ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম।’
এদিকে, আওয়ামী লীগের একজন নির্বাসিত নেতা অভিযোগ করেছেন, পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিয়ে দলের সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে - যার বেশিরভাগ নেতা নির্বাসিত বা কারাগারে।
হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ আলি আরাফাত বিবিসিকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত ছিলো। এছাড়া মব ভায়োলেন্স উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উৎখাত করেছি, কিন্তু স্বৈরাচারী আচরণের অবসান না হলে, আমরা সত্যিকার অর্থে একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে পারব না।’
বাংলাদেশ যখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তখন আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
কেউ কেউ যুক্তি দেন যে, যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থবহ পরিবর্তন না আসে, তাহলে বিদ্রোহে নিহতদের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে যেতে পারে।
আরএ


গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে ৩৪ জনের মৃত্যু
ফ্রান্সে পত্রিকার হকার আকবরকে জাতীয় সম্মাননা দিচ্ছেন ম্যাক্রোঁ