সারদায় ৩২১ প্রশিক্ষণার্থী এসআই বহিষ্কারের নেপথ্যে

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৫৮
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ২৫

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে প্রশিক্ষণের সময় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কয়েক ধাপে ৩২১ প্রশিক্ষণার্থী এসআইকে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ২৫ শিক্ষানবিশ এএসপিকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে জবাব আসার পর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন ইমন এ নোটিশ জারি করেন।

বিজ্ঞাপন

কর্তৃপক্ষ বলছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে নিয়ম অনুযায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় এএসপি এবং এসআই পদে নিয়োগ পান ছাত্রলীগ নেতারা। তারাই মূলত বর্তমান পুলিশ একাডেমিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে।

পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ অতিরিক্ত আইজিপি মাসুদুর রহমান ভূইঞা বলেন, বরখাস্তের ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বিচেনায় নেওয়া হয়নি। শৃঙ্খলা ভঙ্গই কারণ। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শৃঙ্খলা ভঙ্গ ছাড়াও এর পেছনে আরও কারণ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পুলিশ সদর দপ্তর ৪০তম ব্যাচের ৮০১ জন শিক্ষানবিশ এসআইয়ের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত করেছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই তদন্ত করে।

বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে গত ১ অক্টোবর সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে আউটসাইড ক্যাডেট এসআইদের প্রশিক্ষণ চলছিল। প্যারেড বিরতিতে সবাইকে নির্ধারিত নাশতা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণে থাকা এসআইরা নাশতা বর্জন করে হইচই ও বিশৃঙ্খলা শুরু করেন। তারা সংগঠিত হয়ে একাডেমি কর্তৃপক্ষকে হেয় করে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং প্যারেড থেকে ব্যারাকে ফিরে যান।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত এসআইদের কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের ২৫২ এসআইকে বরখাস্ত করা হয়।

এরপর ৪ নভেম্বর সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের আরও ৫৮ জন শিক্ষানবিশ উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

গত ১২ নভেম্বর জিমনেশিয়ামে ক্যাডেট এসআইদের রাত্রিকালীন কম্বাইন্ড ক্লাস ছিল। ওই ক্লাসে যাওয়ার সময় কোম্পানির সিএই যথাসময়ে ফলইন করিয়ে রওনা করেন। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা মূল দল থেকে আলাদা হয়ে যান। দলের সঙ্গে মিলে সঠিকভাবে মার্চিং করে যেতে বারবার বললেও তারা কোম্পানির সিএইচএমের কথা না শুনে কমান্ড অমান্য করে মার্চিং না করে উচ্চস্বরে হইচই করতে থাকেন। এ ধরনের শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থি মর্মে কোম্পানি সিএইচএম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

এরপর গত ২৯ ডিসেম্বর সারদা পুলিশ একাডেমি মাঠে নির্দেশনা না মেনে ‘উচ্চস্বরে হইচই’ করায় প্রশিক্ষণরত পুলিশের আটজন উপপরিদর্শককে (এসআই) কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।

উল্লেখ্য, ৪০তম ক্যাডেট এসআই ব্যাচে প্রশিক্ষণের জন্য মোট ৮২৩ জন এসআই ছিলেন। তারা ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর থেকে সারদায় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু করেন। মাঠে ও ক্লাসে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ তুলে তিন ধাপে ৩১৩ জন এসআইকে শোকজ করে একাডেমি। ইতিমধ্যে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ২১ অক্টোবর ২৫২ জন, ৪ নভেম্বর ৫৮ জন এবং সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর তিনজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এবার চতুর্থ ধাপে প্রায় একই ধরনের অভিযোগে আরও আটজনকে শোকজ করা হলো। সব মিলিয়ে ৪০তম ব্যাচের ৩২১ প্রশিক্ষণার্থী এসআইকে বরখাস্ত করা হলো।

শোকজ পাওয়া উপপরিদর্শকরা বলছেন, ১২ মাসের জায়গায় তাঁরা ১৪ মাস ধরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী চলতি বছরের ৪ নভেম্বর তাঁদের প্রশিক্ষণ শেষ করে বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটে যোগদানের কথা ছিল।

এর আগে গত ২০ অক্টোবর মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ ও প্যারেড পরিদর্শনের কথা ছিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আইজিপি ময়নুল ইসলাম চৌধুরীর। কুচকাওয়াজ ঘিরে রাজশাহী সারদা বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি জুড়ে ছিল সাজ সাজ রব। কিন্তু আগের রাতে অভিযোগ ওঠে, এ ব্যাচে অন্তত ৬২ জন ছাত্রলীগ নেতা দলীয় বিবেচনায় এএসপি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে মাঠে নামছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের এমন আপত্তির মুখে রাতেই পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানান, প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ ‘অনিবার্য কারণে’স্থগিত করা হয়েছে। তবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘আমাদের অভিযোগের জায়গা শুধু এটাই। ফ্যাসিস্ট হাসিনার গোপালগঞ্জ কোটা, ক্যাডার কোটা দেশের প্রতিটা কোণায় বসে আছে এখনো। তাদের সরানো বাদ দিয়ে আমরা জয়েন করতে দেব? শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে আমরা ফ্যাসিস্টদের বৈধতা দিতে পারি না। তদন্ত করে যাদের সমস্যা নেই তারা নিয়োগ পাক, আমরা সাদরে গ্রহণ করব।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত