রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলামের তিন বছরের মেয়ে তাশরিফা। জন্মের পাঁচ মাসের মাথায় জানতে পারেন মেয়ের হার্টে ছিদ্র রয়েছে। রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তির শিকার হয়ে ফিরে আসেন। অন্যদিকে রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করারও সামর্থ্য নেই। তাই এখনো চিকিৎসাহীন বলে জানান তার বাবা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ মেটাতে না পেরে ৯০ ভাগ জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশু চিকিৎসাসেবার বাইরে।
এর প্রধান কারণ রোগীদের ৯৫ ভাগরেই অবস্থান গ্রামে। অথচ রোগটির চিকিৎসার শতভাগ সুযোগ-সুবিধা শহরে বিদ্যমান। আক্রান্তদের মাত্র ১০ শতাংশ পূর্ণ চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
শিশু-হৃদরোগ বিশেজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছরে শিশু কার্ডিয়াক চিকিৎসায় খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। জন্মগত হৃদরোগকে এখনো শিশুরোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে অনেক শিশু সময়মতো চিকিৎসা পাচ্ছে না। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামোতে দুর্বলতা প্রকট। এখনো সব বিভাগে কার্ডিয়াক সেন্টার গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি সরকারিতে ব্যবস্থাপনার অভাবের পাশাপাশি নেই স্বাস্থ্যবিমা। ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ মেটাতে না পেরে অধিকাংশই থাকছে চিকিৎসার বাইরে।
এমন বাস্তবতা নিয়েই সারা বিশ্বের মতো আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হৃদরোগ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘ডোন্ট মিস এ বিট’ অর্থাৎ প্রতিটি হৃৎস্পন্দনই জীবন।
হৃদরোগ নিয়ে বছরে জন্মাচ্ছে ৭৩ হাজার শিশু
বাংলাদেশ জার্নাল অব কার্ডিওভাস্কুলার অ্যান্ড থোরাটিক অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রায় ২০০ শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩ হাজারে। এর মধ্যে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে এক-তৃতীয়াংশই জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা যাচ্ছে।
আক্রান্তের এই চিত্রকে মহামারি বলছেন শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নূরুন্নাহার ফাতেমা বলেন, বাংলাদেশে জন্মগত হৃদরোগের ভয়াবহতা দিনদিন বেড়ে চলেছে। এটি ডেঙ্গু বা কোভিডের মতো একটি মহামারি। তবু জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে জন্মগত হৃদরোগ এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
দুই বিভাগে নেই কোনো কার্ডিয়াক সেন্টার
বাংলাদেশ জার্নাল অব কার্ডিওভাস্কুলার অ্যান্ড থোরাটিক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট বলছে, দেশে জন্মগত হৃৎরোগীর ৯৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলের। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রায় শতভাগই শহরাঞ্চলে। এর মধ্যে আবার বেশিরভাগই ঢাকা শহরে।
গবেষণা পত্রটি বলছে, ঢাকা ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগে কম করে হলেও একটি করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে। তবে বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে কোনো কার্ডিয়াক সেন্টার নেই। এসব বিভাগের জেলাগুলোতে রোগীদের একমাত্র ভরসা রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের শিশু ও জন্মগত হৃদরোগ সার্জন ডা. এম এ কে আজাদ বলেন, যেহেতু চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি, তাই সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ স্বাস্থ্যবীমা জরুরি। আর জনবল সংকট নিরসনে দরকার শিশু হৃদরোগ প্রোগ্রামের কাঠামো তৈরি। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক হৃদরোগের কাঠামো দিয়ে শিশুর জটিল হৃদরোগের কাঙ্ক্ষিত সফলতা আশা করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধান সংকট রোগীর প্রকৃত চিত্র অজানা। যতটা আছে তাদেরও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
এদিকে, গতকাল রোববার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে শিশু হৃদরোগ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাড়ানো না হলে শিশু হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।
অনুষ্ঠানে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নূরুন্নাহার ফাতেমা জাতীয় কর্মসূচির ঘাটতির কথাও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, শিশুদের সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার জন্য অবকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি নবজাতককে প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে জটিলতা দেখা দেওয়ার আগে চিকিৎসা দেওয়া যায়।
এ সময় দেশবরেণ্য হৃদরোগ সার্জন অধ্যাপক ডা. এসআর খান বলেন, শিশুদের হৃদরোগের ক্ষেত্রে একটি প্রধান ঝুঁকি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বিবাহ, যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাইবোনদের মধ্যে। এছাড়া চিকিৎসা না হওয়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি এবং ভাইরাল রোগও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। তবে এসবের প্রতিকারও সম্ভব।

