মরা ইভিএমও টাকা খায়

গাজী শাহনেওয়াজ
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৫, ০৮: ১৮

প্রযুক্তিনির্ভর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্প বিলুপ্ত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মরা এই প্রকল্পের জন্য সরকারের ব্যয় থেমে নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, মেশিনগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা কিংবা সেগুলো বাদও দেওয়া হচ্ছে না।

মাঝখান থেকে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) বড় অঙ্কের ব্যয় গুনতে হচ্ছে। ইভিএমগুলো কোনো কাজে না এলেও প্রতি বছর সেগুলোর জন্য সরকারকে গুদাম ভাড়া গুনতে হচ্ছে ১৫ কোটি টাকার বেশি। মরা এই প্রকল্পের পেছনে এখনো এত বিশাল ব্যয় অযৌক্তিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে এ বিষয়ে সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, ইভিএম প্রকল্প বিলুপ্ত হওয়ার পর সরঞ্জামগুলো বুঝে নিয়েছে ইসি। গত ২৭ এপ্রিল হস্তান্তর কার্যক্রম লিখিত চুক্তি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। সেখানে সুপারিশে বলা হয়, হস্তান্তরিত ইভিএম ও সরঞ্জামাদির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া, সফটওয়্যারগুলোর নিয়মিত আপডেট ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ইভিএম পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে নির্বাচন ও অন্যান্য ব্যবহারের জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। কিন্তু এ সুপারিশের কোনোটির দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইসি। অনেকটা দায়সারাভাবে যত্রতত্র গুদামঘর ভাড়া করে সেখানে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

এদিকে বিতর্কিত সাবেক কমিশনের মতোই বর্তমান কমিশনও ইভিএমগুলোর বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। এটিকে জিইয়ে রেখে রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে ফেলা হচ্ছে বলে মনে করছে সচেতনমহল।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ইভিএম নিয়ে আপাতত মনোযোগ কম। বেশি ফোকাস দিচ্ছি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের দিকে। ইভিএম সংরক্ষণের জন্য সারা দেশে যে গুদামঘর আছে সেগুলো চুক্তির শর্তানুযায়ী আপাতত ভাড়া পরিশোধ করে যাচ্ছি। যেখানে চুক্তি শেষ হচ্ছে নবায়ন করছি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী কেনা হয় দেড় লাখ ইভিএম, যার দাম ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজারের মতো ইভিএমের বর্তমানে হদিস নেই। বর্তমানে ইভিএম রয়েছে ১ লাখ সাড়ে ৪৮ হাজার। ব্যয়বহুল ইভিএমগুলো তিনটি জায়গায় মজুত রাখা আছে। জায়গাগুলো হলো বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ), ইসির জেলা নির্বাচন অফিস এবং আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের বেজমেন্ট।

ইসির তথ্যমতে, সারা দেশের ৪১ জেলায় ইভিএম সংরক্ষিত রয়েছে। মাঠ অফিসে মাসিক যে ভাড়া, ঢাকা জেলায় তা প্রায় দ্বিগুণ। সব মিলিয়ে জেলাগুলোতে ইভিএম সংরক্ষণের বার্ষিক গুদাম ভাড়া বাবদ ব্যয় হচ্ছে অন্তত চার কোটি টাকার বেশি। আর বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) থাকা সর্বোচ্চ ৮৬ হাজার ২৩৩টি ইভিএমের মাসিক ভাড়া প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে শুধু বিএমটিএফে রাখা ইভিএমের পেছনে ইসির গচ্চা বার্ষিক প্রায় ১১ কোটি টাকার বেশি।

বিলুপ্ত ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান আমার দেশকে জানান, বিএমটিএফ ওয়্যারহাউস তৈরি করে ঢাকার ইভিএমগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইসির তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণ হচ্ছে গুদামঘর ভাড়া নিয়ে। গুদাম ঘর ও ওয়্যারহাউসের মধ্যে তফাৎ হচ্ছে ওয়্যারহাউসে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় জরিমানা গুনতে হয়। রাকিবুল হাসান জানান, বিএমটিএফের ৫৬ হাজার বর্গফুট ওয়্যারহাউজে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার ইভিএম রাখা সম্ভব; সেখানে তারা রাখছে ৮৬ হাজার। কিন্তু ভাড়া নিচ্ছে ৫৬ হাজার বর্গফুটের।

এদিকে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেও বিএমটিএফের সঙ্গে ভাড়া ইস্যুতে আজও জটিলতা কাটেনি ইসির। এ বিষয়ে সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, প্রতি বর্গফুটের জন্য ইসি বিএমটিএফকে ১২৫ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু বিএমটিএফের দাবি ১৩৫ টাকা। অন্যদিকে খাদ্য সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ১২০ টাকা এবং ওষুধ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ৩০০ টাকা ভাড়ার প্রস্তাব করে। চড়া মূল্যের এই যন্ত্রগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলে ভালোভাবে সংরক্ষণ জরুরি। না হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কেননা ব্যবহার না করলেও এর পেছনে ইসির বার্ষিক কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে যেতে হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করবে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগে ইভিএম সংরক্ষণের জন্য কোনো গুদাম ভাড়া নেয়নি ইসি। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ইভিএমগুলো চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সম্প্রতি এ অঞ্চলের ইভিএম সংরক্ষণের জন্য গুদামঘর ভাড়া নিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা গণপূর্ত বিভাগে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি গুদামের ভাড়া মাসে ৬৯ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসির রংপুর অঞ্চলের চিত্রও একই।

আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে ইভিএমের জন্য নেওয়া ভাড়া গুদামঘরের মাসিক ব্যয়ের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কার্যালয়ের দায়িত্বশীলরা আমার দেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ প্রায় অভিন্ন। তারা বলছেন, এটা ইসির গলার কাঁটা। যন্ত্রগুলো শুধু শুধু ফেলে রেখে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, যদি নির্বাচন আসে শুধু পরিবহনে আনা-নেওয়ায় মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়। সর্বশেষ রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ইভিএমের পরিবহন খরচ বাবদ বরাদ্দ ছিল ১০ লাখ টাকা। যেহেতু নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই এগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

বিষয়:

ইভিএম
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত