ঈদের ছুটিতে বিক্রি অর্ধশত কোটি টাকার বগুড়ার দই

সবুর শাহ্ লোটাস, বগুড়া
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫, ০৯: ১৩

এবারের ঈদে টানা ছুটিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বগুড়ার প্রসিদ্ধ দই ও মিষ্টি বিক্রি হয়েছে অর্ধশত কোটি টাকার। গতকাল মঙ্গলবার বগুড়া ঘুরে দেখা যায়, দইয়ের দোকানগুলোতে প্রচুর ক্রেতাসমাগম।

অতিথি আপ্যায়ন কিংবা ভোজ উৎসব অথবা প্রিয়জনকে উপহার দিতে বগুড়ার দইয়ের বিকল্প নেই। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের তালিকায় বগুড়ার দই নেই-এমনটা ভাবা যায় না। বগুড়ার দই দিন দিন হয়ে উঠেছে আত্মীয়তার সেতুবন্ধন। শুধু দইকে কেন্দ্র করেই বগুড়া পেয়েছে নতুন পরিচিতি। যে কারণে কেউ কেউ বলেন ‘দইয়ের রাজধানী বগুড়া’।

বিজ্ঞাপন

স্বাদে-গুণে অতুলনীয় হওয়ায় বগুড়ার দই দেশ-বিদেশে এখন জনপ্রিয় মিষ্টান্ন খাবার। উত্তরাঞ্চলের বগুড়াকে এগিয়ে নিতে বগুড়ার দই জিআই পণ্যের তালিকায় নাম লিখিয়েছে; যার ফলে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে এ দই।

এশিয়া সুইটমিট, আকবরিয়া দইঘর, চিনিপাতা দই, শেরপুর দই, শ্যামলী, মহরম দইঘর, আদি মহরম, রফাত দইঘর ছাড়া শহরের মোড়ে মোড়ে ঈদের দিন থেকে দই দোকানগুলো খোলা রয়েছে।

কয়েকটি বড় দোকান ঘুরে জানা গেছে, এবার বগুড়ায় অর্ধশত কোটি টাকার দই বিক্রির টার্গেট ছিল। ঈদের আগে ও পরের তিন দিন সেই টার্গেট অতিক্রম করেছে। যারা ঈদ করতে বগুড়া এসেছেন, তাদের একটা চাপ রয়েছে যে, বগুড়ার দই ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে গিয়ে প্রিয়জনকে উপহার দেবেন।

বগুড়া এশিয়া সুইটসের জেনারেল ম্যানেজার আরিফ উজ্জামান দিপু জানান, স্পেশাল (৬৫০ গ্রাম) ওজনের দই বিক্রি করা হচ্ছে ৩০০ টাকায়, একই ওজনের শাহী দই ৩৫০ টাকা, সাদা দই (চিনিমুক্ত) ২৮০ টাকা, টকদই ২০০ টাকা, বড় ক্ষীরসা ৭০০ টাকা, ছোট ক্ষীরসা ৩৫০ টাকা। এসব দই মাটির তৈরি সরা ও হাঁড়িতে ভরে বাজারজাত করেন ব্যবসায়ীরা।

তিনি আরো বলেন, বহুকাল ধরে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বগুড়ার সাদা দই। ঠাণ্ডাপানীয় খাবার হিসেবে সাদা দইয়ের তুলনা হয় না।

বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, আকিকা, হালখাতা বা পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে দই মিষ্টান্ন খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে দেশব্যাপী। শুধু তা-ই নয়, খোদ ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও মুগ্ধ হয়েছিলেন বগুড়ার দই খেয়ে।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও এখানকার দইয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মন জয় করতে বগুড়ার দই পাঠানো হয়েছিল। ভারত ভাগের সময় থেকে বগুড়ার দইয়ের স্বর্ণযুগ শুরু। এরপর থেকে বাঙালিদের রসনায় দই জুড়িহীন।

বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজে দই পরিবেশন করা হয়ে থাকে। দই পছন্দ করেন নাÑএমন মানুষ খুব কমই আছেন। আবার বাংলাদেশে দইয়ের কথা উঠলে চলে আসে বগুড়ার নাম।

এদিকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বগুড়ার দই। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) ২০২৩ সালের ২৬ জুনের সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

বগুড়ার ইতিহাসবিদরা জানান, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর গৌর গোপাল নামের এক ব্যক্তি পরিবারসহ ভারত থেকে এসে আশ্রয় নেন শেরপুরের ঘোষপাড়ার নিজের আত্মীয়-স্বজনের কাছে। শুরুতেই তিনি টকদই সরবরাহ করতেন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের কাছে। সেই দই নবাবদের অন্যরকম কদর ও প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তখন গৌর গোপালের এই দই খ্যাতি পেয়েছিল নওয়াববাড়ির দই নামে।

গৌর গোপালের ফর্মুলাতে রেডিমেড দইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কালক্রমে স্বাদের বৈচিত্র্যের কারণে তা মিষ্টি দইতে রূপান্তরিত হয়। প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস বগুড়ার দইয়ের। সারা দেশে দই তৈরি হলেও বগুড়ার দই বিখ্যাত।

১৯৩৮ সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে বগুড়ার বিখ্যাত দই। স্বাধীনতার পর বগুড়ায় দই তৈরিতে শহরের গৌর গোপালের পাশাপাশি মহরম আলী ও বাঘোপাড়ার রফাত আলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ছোট ছোট মাটির পাত্রে (স্থানীয় ভাষায় হাঁড়ি) দই ভরানো হতো।

ঘোষদের ছোট ছোট দোকান থাকলেও তখন কাঁধে (ভার) ও ফেরি করেই দই বিক্রি হতো। এখন স্থান পেয়েছে অভিজাত দোকানগুলোয়। বগুড়ায় প্রায় ৫০০ দইয়ের শোরুম রয়েছে।

বগুড়ায় খাবার হিসেবে দইয়ের প্রচলন বেশি হওয়ায় জেলা শহরের আনাচে-কানাচে দইয়ের শোরুম গড়ে উঠেছে। হিসাব কষলে ১২ উপজেলায় দুই সহস্রাধিকের বেশি দইয়ের শোরুম রয়েছে। এসব শোরুম থেকে প্রতিদিনিই দই বিক্রি হচ্ছে।

এর মধ্যে বর্তমানে সুনাম ছড়িয়েছে বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের এশিয়া সুইটস, চিতিপাতা, শ্যামলী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের দই, বাঘোপাড়ার রফাত দইঘর, মহরম আলী, শেরপুর দইঘর, সাউদিয়া, জলযোগ, শম্পা, বৈকালী ও শুভ দধি ভাণ্ডার, নবাববাড়ীর রুচিতা, দইবাজার, মিষ্টিমহল ও আকবরিয়ার দই।

এছাড়া ছোট ছোট নানা নামে গড়ে উঠেছে দইয়ের দোকান ও শোরুম। এসব শোরুম থেকে প্রতিদিন গড়ে দই বিক্রি হচ্ছে প্রায় কোটি টাকার। হরেক রকম নামে বিক্রি হচ্ছে বগুড়ার দই।

বগুড়ার শ্যামলী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের জেনারেল ম্যানেজার জামিল খান জানান, ‘দই তৈরির মূল উপকরণ হলো ভালো মানের দুধ। দুধ যত ভালো মানের হবে, দই ততই স্বাদের হবে। দই তৈরির কাজে বিশেষ দক্ষ কারিগর না হলে উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাজারে আগের তুলনায় দুধের দাম অনেক বেশি। সঙ্গে সঙ্গে চিনি ও অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় দইয়ের দামও বেড়ে গেছে। আগের চেয়ে বর্তমানে দ্বিগুণ হারে দই বেচাবিক্রি হচ্ছে।’

বগুড়া শহরের ঝাউতলা এলাকার এনাম দইঘরের মালিক আলহাজ এনামুল কবির জানান, ‘প্রতিযোগিতার এই বাজারে দইয়ের মান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে নিম্নমানের দইয়ের ভিড়ে বেশি দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি নিয়ে হয় ঝুটঝামেলা। আবার দাম কমিয়ে দইয়ের গুণগত মান ঠিক রাখাও যায় না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ বগুড়া এলে এখানকার দইয়ের স্বাদ নিয়ে থাকেন।’

বিষয়:

বগুড়াদই
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত