জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে ৩০০০ কোটি টাকা লুটপাট

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ০৯: ১৩
আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ০৯: ২১

ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং কোনো কোনো এলাকায় জলাবদ্ধতা আরো বাড়ার কথা জানিয়েছেন নগরবাসী।

বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করেও বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কোনোই উন্নতি হয়নি। ভারী বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় কোনো না কোনো এলাকা, এতে ভোগান্তিতে পড়েন এলাকাবাসী। প্রতি বর্ষা মৌসুমেই এটি যেন নিয়মতান্ত্রিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর ৩০ মিনিটের ৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, তাতে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী ।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার রাতে ভোগান্তিতে পড়া বিউটি আক্তার হাসু নামের মিরপুর-১০-এর এক বাসিন্দা ফেসবুক পোস্টে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘স্থলপথে অফিসে গেলেও মিরপুর মেট্রোরেল থেকে নেমে পানিপথের যুদ্ধ শেষে বাসায় আসছি। রাস্তায় পানি জমে থাকায় রিকশা পাচ্ছিলাম না। পানিপথে কিছুদূর হেঁটে এসে অবশেষে রিকশা মেলে।’

দারুস সালামের বাসিন্দা রকিব উদ্দিন বলেন, শুক্রবার রাতে কিছুক্ষণের বৃষ্টিতেও পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। মেইন রোডসহ অলিগলি পানিতে থই থই করছিল। অনেকেই হাঁটুপানি ভেঙেই ঘরে ফেরেন।

শুধু মিরপুর নয়, ওইদিন কাজীপাড়া, টেকনিকেল মোড়, মহাখালী, উত্তরা, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মেইন রোডেও ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগেভাগে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এবারও বর্ষায় রাজধানীবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে।

এদিকে জুলাই বিপ্লবের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্ষার আগেই রাজধানীর ১৯টি খালে পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এ নিয়ে বর্ষার আগেই এসব খালে পানির প্রবাহ ফেরাতে মাস্টারপ্ল্যানের পরিকল্পনা করছে সরকার। প্রথম ধাপে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বাউনিয়া, রূপনগর, বেগুনবাড়ি, মান্ডা, কালুনগর খাল এবং কড়াইল লেকসহ ২১ কিলোমিটার জলাশয়ের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

এর অংশ হিসেবে চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি মিরপুর-১৩ এলাকায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৬টি খালের সংস্কার কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন সরকারের তিন উপদেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা ৩-৪টি মন্ত্রণালয় বসে কীভাবে বর্ষার আগে খালগুলোতে পানি প্রবাহ ফেরাতে পারি, সে বিষয়ে কাজ করছি। প্রথমে খনন করব, এরপর ধাপে ধাপে বাকি কাজ এগোব।

এ খালে মশা ব্যতীত কিছুই নেই। আমরা স্থানীয়দের নিয়ে কমিটি করে দিয়েছি। তারাই খাল দখল, দূষণ রোধে কাজ করবেন। খালের পাড়ে সবুজ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব, একইসঙ্গে খালে মাছ যাতে বাঁচে, সে ব্যবস্থাও করা হবে।

স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, খালের এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি, তার মধ্যে ব্লু নেটওয়ার্ক তৈরি অন্যতম। ১৯টি খাল উদ্ধারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। ব্লু নেটওয়ার্ক চ্যানেল তৈরি করে পার্কের মতো করা হবে। যাতে খাল দূরে সরে না যায়, কাছে আসতে বাধ্য হয়।

তিনি বলেন, অন্য যে কোনো সরকার থাকলে এই কাজ করতে চিঠি চালাচালি করতেই সময় চলে যেত। আমরা তাই কোনো প্রকল্পে না গিয়ে কর্মসূচি নিয়েছি। কাজটি শুরু করে দিয়ে যেতে চাই; দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নিলে পরবর্তী সরকার এসে নেবে।

এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, গত সাড়ে ১৬ বছরে লুটপাট ও দুর্নীতির ফলে খালগুলো দখল-দূষণের শিকার হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজউক টোটাইল বিল দখলমুক্ত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) দেওয়া হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। তাতে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।

গত চার বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। গত অর্থবছরেও (২০২৩-২৪) প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি সূত্র বলছে, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা।

ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বোচ্চ ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা দ্রুত সময়ে নিষ্কাশনের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। এর বেশি বৃষ্টি হলে তারা নিরুপায়।

২০১৭ সালে শহরের জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা দেখে তৎকালীন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ (অঙ্গীকার) করছি, সামনের বছর থেকে আর জলাবদ্ধতা দেখবেন না।’

কিন্তু ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিতে ঢাকা সিটির অধিকাংশ এলাকাই তলিয়ে যায়। এমনকি কিছুক্ষণ বৃষ্টি হওয়ার পর কোনো কোনো এলাকায় নৌকা চালিয়ে বাসা-অফিসে আসা-যাওয়া করতেও দেখা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চারটি খালের সৌন্দর্যবর্ধনে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ৮৯৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুনে। ঠিকমতো কাজ শুরুর আগেই আড়াই বছর পেরিয়ে গেছে।

ঢাকার দখল হয়ে যাওয়া খালগুলোর মধ্যে মাত্র ১৫টি খাল খনন করলেই অবিরাম জলাবদ্ধতা সমস্যার প্রায় ৮০ শতাংশ সমাধান হতে পারে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) সম্প্রতি ঢাকার ৯টি জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে চলমান সমস্যার সমাধান দিয়েছে।

খননের জন্য আরডিআরসির সুপারিশ করা খালগুলো হলোÑ রূপনগর মেইন খাল, বাউনিয়া খাল, বাইশটেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কল্যাণপুর খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, পান্থপথ বক্স কালভার্ট খাল, রায়েরবাজার খাল, জিরানী খাল, রামপুরা খালের দক্ষিণ প্রান্ত, দোলাই খাল, কদমতলী খাল ও মান্দা খাল।

গবেষণায় যে ৯টি জলাবদ্ধতার ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছেÑ পল্লবী শিয়ালবাড়ি, রূপনগর ও ইস্টার্ন হাউজিং; কালশী ও মিরপুর-১১; টোলারবাগ, আহমেদনগর ও পাইকপাড়া; শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও কাফরুল; কলাবাগান, ধানমন্ডি ২৭, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড ও হাতিরপুল; হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, রায়েরবাজার, পশ্চিম ধানমন্ডি ও ঢাকা নিউমার্কেট; রামপুরা ও বাড্ডা; সূত্রাপুর, ওয়ারী, নবাবপুর, কাজী আলাউদ্দিন রোড, সিদ্দিক বাজার, নারিন্দা ও তাঁতিবাজার এবং জুরাইন, সিদ্ধিরগঞ্জ, জাকের মঞ্জিল, শ্যামপুর, পূর্ব জুরাইন, সাদ্দাম মার্কেট ও রায়েরবাগ।

গত বছরের জুলাই মাসে ‘ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা ও আমাদের দখলকৃত খাল’ শীর্ষক গবেষণাটি করা হয়।

আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, একসময় ঢাকা থেকে বৃষ্টির পানি সরতে পারেÑ এমন ৭৭টি খাল ও লেক ছিল। এখন এগুলোর বেশিরভাগই আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দখল করা হয়েছে।

খালগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি একটি মডেল অনুসরণের পরামর্শ দেন। সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্ট খাল এলাকা এবং তীরগুলো পুনরুদ্ধার ও স্থাপত্যের পরিকল্পনা করার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে তারপর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

১৫টি খালের মধ্যে পল্লবী শিয়ালবাড়ী, রূপনগর ও ইস্টার্ন হাউজিংয়ের জলাবদ্ধতা নিরসনে রূপনগর মেইন খাল খনন করতে হবে। বাউনিয়া খাল, বাইশটেকি খাল ও সাংবাদিক কলোনি খাল খনন করলে কালশী ও মিরপুর ১১-এর জলাবদ্ধতা নিরসন হবে।

অন্যদিকে টোলারবাগ, আহমেদনগর ও পাইকপাড়ার জন্য কল্যাণপুর খাল; শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও কাফরুলের জন্য ইব্রাহিমপুর খাল ও কলাবাগান, ধানমন্ডি ২৭, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড ও হাতিরপুলের জন্য পান্থপথ বক্স কালভার্ট খাল খনন করতে হবে।

পাশাপাশি রামপুরা ও বাড্ডার জন্য রামপুরা খালের দক্ষিণ প্রান্ত; হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, রায়েরবাজার, পশ্চিম ধানমন্ডি ও ঢাকা নিউমার্কেটের জন্য রায়েরবাজার খাল এবং জিরানী খালের শেষ অংশ; সূত্রাপুর, ওয়ারী, নবাবপুর, কাজী আলাউদ্দিন রোড, সিদ্দিক বাজার, নারিন্দা ও তাঁতিবাজারের জন্য দোলাই খাল এবং জুরাইন, সিদ্ধিরগঞ্জ, জাকের মঞ্জিল, শ্যামপুর, পূর্ব জুরাইন, সাদ্দাম মার্কেট ও রায়েরবাগের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কদমতলী খাল এবং মান্দা খাল খনন করতে হবে।

খালের অবৈধ দখল, অনুপযুক্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা জলাবদ্ধতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।

সংস্থাটির মতে, স্বাধীনতার পর ঢাকায় ৫৭টি খাল থাকলেও বর্তমানে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৬টিতে, যার অধিকাংশের অবস্থাই বেশ নাজুক। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানী। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে।

এমবি

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত