দাবানলে বিধ্বস্ত লস অ্যাঞ্জেলেস ও হলিউডে একদিন

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৫৪

লস অ্যাঞ্জেলেস যুক্তরাষ্ট্রের এক নয়নাভিরাম মায়াবী শহর। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত পর্যটক শহরটিতে ভ্রমণে আসেন। কিন্তু বিধ্বংসী এক দাবানলের কারণে গত কিছুদিন ধরে পর্যটকদের জন্য এই শহরে আসা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। দাবানলের আগুন ও বিষাক্ত ধোঁয়া যে কাউকে ক্ষতি করতে পারে সে জন্যই এই সতর্কতা।

দাবানল এখন অনেকটা স্তিমিত। দমকল কর্মীরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে বেশিরভাগ এলাকার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন। দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল লস অ্যাঞ্জেলেসের বিস্তীর্ণ এলাকায়। আগুন লেগেছে প্যালিসেডস, ইটন ও হার্স্টসহ ছয়টি এলাকায়। গত ১৫ দিন ধরে আগুনে জ্বলছিল পুরো এলাকা।

বিজ্ঞাপন

সর্বত্র আতঙ্ক ছিল ভয়াবহ আগুন কখন কাকে পুড়িয়ে মারে, কখন কার ঘর ছাই করে দেয়। অবশেষে আগুনের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধে জয়ী হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসের দমকল কর্মীরা। ইতোমধ্যে পুড়ে গেছে ৬০ বর্গ মাইলের বেশি এলাকা। এতে ১৪ হাজার ঘরবাড়িসহ কাঠামো ধ্বংস হয়েছে। মানুষ মারা গেছেন ২৭ জন। বেশি ক্ষতি হয়েছে প্যালিসেডস ও ইটন এলাকা।

একজন সাংবাদিকের চোখের সামনে এতবড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সেখানে না যাওয়া এবং কভার করতে না পারার জন্য অস্বস্তিতে ছিলাম। অবশেষে কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় লস অ্যাঞ্জেলেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। রোববার পুরোদিন ওই এলাকায় ঘুরেছি। সেখানে আকাশ এখনও কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। আমার মতো অনেক পর্যটক এসেছে পরিদর্শনে। তবে দুর্যোগ যেন এলাকার উচ্ছলতা কেড়ে নিয়েছে। কালো বিষাক্ত ধোঁয়ার ভয়ে অনেককেই দেখেছি মুখে মাস্ক পরে আছেন।

হলিউড শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও বিনোদন শিল্পের জন্য প্রতীক হয়ে আছে। দাবানল হলিউড পর্যন্ত না ছড়ালেও হলিউডের অনেক তারকার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে আগুন। হলিউডের জনপ্রিয় শিশুশিল্পী ররি স্কাইজ মারা গেছে দাবানলে।

বাড়ি হারিয়ে হলিউড স্টার ম্যান্ডি মুর পোস্টে লিখেন, ‘আগুন থেকে বাঁচতে সন্তান ও পোষা প্রাণীদের নিয়ে দ্রুত এলাকা ছাড়লাম।’ হলিউডের যারা সুন্দর পাহাড়ি এলাকায় লাখ লাখ ডলার খরচ করে বাড়ি করেছিলেন তাদের অনেককে এভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে দাবানল।

তবে আগুন কমে যাওয়ায় অনেকেই ফিরে আসছেন। হলিউড আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। আর এটা হতেই হবে। কারণ হলিউডে কেবল সিনেমা নয়, প্রযুক্তি, সংগীত এবং অন্য বিনোদনমূলক ব্যবসাও রয়েছে। এর বাজারমূল্য ২০২৩ সালে ছিল ৩৪০ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪০ লাখ কোটি টাকা।

দাবানলে হলিউড সাইন পুড়ে গেছে এমন খবর ভাইরাল হয়েছিল। ছবিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিখ্যাত হলিউড সাইনটি যথাস্থানে ঠিকভাবেই আছে লক্ষ্য করলাম। দাবানলের আগুন এর থেকে দূরে ছিল। এই দূরত্ব গাড়িতে ৪০ মিনিটের ড্রাইভের সমান।

হলিউড সাইন এত আকর্ষণীয় হওয়ার কারণ হচ্ছে ইংরেজি অক্ষরে হলিউড লেখাটা। হলিউড হিলের এই লেখা বহুদূর থেকে দেখা যায়। সাইনটিতে নানা ধরনের আলো ফেলে একে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। ১৯২৩ সালে হলিউড হিলে ধনী ও জনপ্রিয়দের জন্য আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছিল। হলিউডল্যান্ড নামে রিয়েলস্টেট কোম্পানির সাইনবোর্ড ছিল মূলত এটি। ম্যাগনেটএইচজে হুইটলিই হলেন ফাদার অব হলিউড। ১৯১৫ সাল থেকে এই হলিউড আমেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজের প্রাণভোমরায় পরিণত হয়।

বিকাল থেকে রাত অবধি আমরা ঘুরে দেখি অপূর্ব নগরী লস অ্যাঞ্জেলেস। এটাকে বলা হয় দেবদূতদের শহর। এই জায়গা ১৭৭১ সালের দিকে স্প্যানিশদের কুঠি ছিল। কিংবদন্তি আছে, পোরসিউনকুলা নদীর দেবদূতদের রানী ছিলেন কুমারী মেরি। তার শহর বোঝানোর জন্য একে দেবদূতদের শহর বলা হয়। এরপর এই শহর স্প্যানিশদের কাছ থেকে চলে যায় মেক্সিকোর হাতে।

১৮৪৮ সালের আগে মেক্সিকোর সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের হয়। তখন আমেরিকানরা পুরো ক্যালিফোর্নিয়া কিনে নেয়। ১৮৪৯ সালের গোল্ড-রাসের পর থেকে ক্যালিফোর্নিয়া তথা লস অ্যাঞ্জেলেসের উন্নতি হতে থাকে। জৌলুস কুড়িয়ে কুড়িয়ে আজকের অবস্থানে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বৃহৎ নগরী এই লস অ্যাঞ্জেলেস । নিউইয়র্কের পর আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। বিশাল আয়তন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রৌদ্রময় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং বিনোদন জগতের চমৎকার জায়গা হলিউডের কারণে লস অ্যাঞ্জেলেসের এত জৌলুস। এই নগরী আমেরিকানের কাছে সংক্ষেপে ‘এলএ’ নামে পরিচিত। এই নগরীতে ১৯৩২ ও ১৯৮৪ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক হয়। আবার ২০২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক আয়োজন করতে যাচ্ছে।

রাতে আমরা নগরীর গ্রিফিত মানমন্দির বা অবজারভেটরি পরিদর্শনে যাই। এটি হলিউড পাহাড়ের গ্রিফিত পার্কে অবস্থিত। উঁচু এই জায়গা থেকে পুরো লস অ্যাঞ্জেলেস দেখা যায়। আরও দেখা যায় হলিউড সাইন ও মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কিত ডিসপ্লেগুলো। অবজারভেটরির সামনেই আছে সর্বকালের সেরা ছয়জন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর স্মৃতিস্তম্ভ।

এরা হলেন হিপারকাস, নিকোলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানেস কেপলার, আইজ্যাক নিউটন ও উইলিয়াম হার্শেল। রাতে অবজারভেটরির হিল থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস নগরীকে অপূর্ব লাগে। বিশেষ করে মনে হয় শহরটির উপর দিয়ে যেন আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই নগরীতেই আছে বিশ্ববিখ্যাত ক্যালটেক ইউনিভার্সিটি। ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার পাশাপাশি ভূতত্ত্ব বিভাগে গিয়ে এই এলাকার ভূমিকম্প ও দাবানল হওয়ার জিওলজিক্যাল কারণ সম্পর্কে আমরা ধারণা লাভ করি।

‘সান্তা আনা বাতাস’ কেন হয়, এই বাতাসে কেন হয় দাবানল, কেন এই বাতাস উষ্ণ, শুষ্ক এবং ঝড়ো হয় তাও জানতে পারি ক্যালটেক বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। অ্যাস্ট্র ফিজিক্স বিভাগে গিয়ে আমরা জানতে পারি সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের প্রিয় জায়গাটা কোথায় ছিল, তিনি কোন পথ ধরে হাঁটতে পছন্দ করতেন।

তেমনি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে কোন গবেষণাগারে বেশি সময় ব্যয় করতেন তাও জেনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। আরও জেনেছি মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য গবেষণাগার লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ক্যালটেকে রয়েছে। চাঁদে, মঙ্গলে এবং সূর্য অভিযানে মহাকাশ যান পাঠিয়ে অনুসন্ধান নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে এখানে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত