সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল

প্রকৌশলীর অনিয়মের কারণে রোগ নির্ণয়ে অচলাবস্থা

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০: ১৪

নষ্ট যন্ত্র দেখিয়ে নতুন যন্ত্র ক্রয়, অর্ধকোটি টাকার সফটওয়্যার চুরি, মেরামতযোগ্য যন্ত্র ফেলে রাখাসহ বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে।

এসব অনিয়মের কারণে হাসপাতালের রোগ নির্ণয়ব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে অপরাধ করেও প্রভাবশালীদের দিয়ে হাসপাতালের পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

একের পর এক অনিয়মের লিখিত অভিযোগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি, নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। ফলে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এই প্রকৌশলী। তার বাধায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না হাসপাতালের চার টেকনিশিয়ান। অনিয়মের বাধা হওয়ায় প্রতিনিয়ত তাদের হয়রানি ও নানাভাবে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৌহিদের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে একাধিকবার লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তবে মেলেনি প্রতিকার।

প্রকৌশলীর এমন কর্মকাণ্ডে চিকিৎসাযন্ত্র মেরামতে হাসপাতালে বরাদ্দের দেড় কোটি টাকার সবটাই ফেরত গেছে। অথচ বর্তমানে ছোট-বড় অন্তত ৬০ কোটি টাকার চিকিৎসাযন্ত্র অচল, যেগুলোর অধিকাংশই মেরামতযোগ্য বলে জানিয়েছেন টেকনিশিয়ানরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব ছিলেন প্রকৌশলী তৌহিদের নিটকাত্মীয়। ওই সচিবকে ব্যবহার করে সব অপকর্মে জড়ান তিনি। বর্তমান পরিচালক ডা. শফিউর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই হাসপাতালে তিনজন টেকনিশিয়ান যোগদান করেন, যারা দেড় বছরেই প্রায় ১৮ কোটি টাকার অচল যন্ত্র সচল করেছেন। এতে পরিচালকের ওপর নাখোশ হন তৌহিদ।

তবে একের পর এক অপরাধ করেও শাস্তি তো দূরের কথা, উল্টো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফেলে রেখেছেন হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার যন্ত্র। এসব যন্ত্র সচল না করায় হাসপাতালের পুরো রোগ নির্ণয়ব্যবস্থায় স্থবিরতা এসেছে। বাইরে থেকে বেশি দামে রোগ নির্ণয় করতে হচ্ছে রোগীদের। অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি হাসপাতালের পরিচালক।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর আমার দেশকে বলেন, ‘এর আগেও হাসপাতালটিতে অনিয়মের বিষয়টি নজরে এসেছে। কেন এমন অবস্থা হলো, আমরা খতিয়ে দেখব। কেউ কোনো অনিয়ম করে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বসে আছে ৬০ কোটি টাকার যন্ত্র

সাড়ে ১৩শ’ শয্যার হাসপাতালটিতে প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় ঢাকার আশপাশ এলাকার পাশাপাশি কাছের জেলাগুলো থেকেও রোগীরা আসেন এই হাসপাতালে। অথচ হাসপাতালটিতে থাকা ৬৫ ভাগ যন্ত্রই বিকল, যার মূল্য ৬০ কোটি টাকার বেশি। বিশেষ করে এমআরই, সিটি স্ক্যান দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে নষ্ট। কিন্তু মেরামতযোগ্য হলেও পড়ে আছে ইআরসিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র, যার মূলে প্রকৌশলী তৌহিদুজ্জামান বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত এক সপ্তাহে হাসপাতালটিতে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, পাঁচটি এক্স-রে মেশিনের তিনটিই বিকল। অথচ এক্স-রে করতে রোগীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক্স-রে কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে রোগীদের। এ ছাড়া তিনটি ইকো-কার্ডিওগ্রামের মধ্যে দুটি, একমাত্র এক্সে-রে ম‍্যামোগ্রাফি, ১১টি আল্ট্রাসনোগ্রামের মধ্যে সাতটি, ১১টি ল‍্যাপারোস্কপির মধ্যে ছয়টি, ১৭টি ওটি লাইটের মধ্যে ছয়টি এবং ১২টি ওটি টেবিলের ছয়টিই বিকল। এ ছাড়া ১১টি অ‍্যানেসথেসিয়া ভেন্টিলেটর মেশিন, আটটি ডায়াথারমি, তিনটি এক্স-রে সি-আর্ম মেশিন এবং সাতটি পোর্টেবল এক্স-রে মেশিনের মধ্যে বিকল ছয়টি। এ ছাড়াও আরো কিছু যন্ত্র অচল অবস্থায় পড়ে আছে।

অভিযোগ রয়েছে, এসব যন্ত্রের ৯০ ভাগই মেরামতযোগ্য হলেও সেটি করতে দিচ্ছেন না প্রকৌশলী তৌহিদ। আগে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু যন্ত্র নষ্ট করতেন তিনি। টেকনিক্যাল ভুলগুলোও ধরার মতো লোকবল না থাকায় ছিল না কোনো জবাবদিহি।

৭০ লাখ টাকার যন্ত্রের সফটওয়্যার ডিভাইস চুরি

পিত্তনালি ও অগ্ন্যাশয়ের নালিতে ব্লক (বাধা) সরাতে করা হয় এন্ডোনকপি রেট্রোগ্রেড কোলাঞ্জিও-প্যানক্রিয়াটোগ্রাফি বা ইআরসিপি পরীক্ষা। এই পরীক্ষা এক্স-রে সিআর্ম যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়। সম্প্রতি যন্ত্রটিতে ত্রুটি দেখা দিলে মেরামত শুরু করেন টেকনিশিয়ানরা। অনুমতি ছাড়া কাউকে হাত না দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও টেকনিশিয়ানদের না জানিয়ে প্রকৌশলী তৌহিদ বহিরাগত লোক নিয়ে মেশিনটি চালুর চেষ্টার করেন। দুদিন পর বিভাগীয় প্রধান দ্রুত যন্ত্রটি সচল করতে টেকনিশিয়ানদের নির্দেশ দেন। সচল করতে গিয়ে যন্ত্রটির ডঙ্গল ডিভাইস (মূল সফটওয়্যার) পাননি টেকনিশিয়ানরা। তৌহিদ শুরুতে অস্বীকার করলেও পরে ডিভাইস ফেরত দেবেন বলে জানান। এখনো তা ফেরত দেননি বলে জানা গেছে।

বিষয়টি নিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পরিচালককে লিখিত অভিযোগ দেন টেকনিশিয়ানরা। একই ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে পরিচালককে চিঠি দেন গ্যাস্ট্রোএন্টারলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাহমুদুজ্জামান।

ডিভাইস চুরির ঘটনায় ব্যবস্থা না নিয়ে যন্ত্রটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ডিভাইসটি বিনামূল্যে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক। আর চুরির সঙ্গে জড়িতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিচালকের ওপর ক্ষুব্ধ হাসপাতালের বায়োমেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকরা।

আলোর মুখ দেখে না তদন্ত

সচল যন্ত্র যন্ত্র নষ্ট দেখিয়ে নতুন যন্ত্র ক্রয়ের ঘটনায় গত বছরের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে প্রকৌশলী তৌহিদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু দুই মাসেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

জানা গেছে, ২৫ বছর আগে ওটি টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগদান করেন তৌহিদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব তার নিকটাত্মীয় হওয়ায় ওই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে হাসপাতালে একের পর এক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

বিভিন্ন সূত্রে ঢাকা শহরে তার বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটির তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগার হিসেবে নিজেকে পরিচায় দিলেও এরপর থেকে বিএনপিপন্থি চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়েন তিনি।

ফেরত গেছে মেরামতের বরাদ্দ

নিজস্ব খরচে চিকিৎসাযন্ত্র মেরামতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বছরে বরাদ্দ দেড় কোটি টাকা। হাসপাতালে বিপুল পরিমাণ যন্ত্র নষ্ট থাকায় এই বরাদ্দও যৎসামান্য। কিন্তু ওই টাকাও ফেরত গেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে।

হাসপাতালের বায়োমেডিক্যাল টেকনিশিয়ান সাজেদুল ইসলাম ও হৃদয় চন্দ্র মল্লিক আমার দেশকে বলন, যেখানে হাসপাতালের প্রায় ৭০ ভাগ যন্ত্র বিকল এবং অধিকাংশই সামান্য ত্রুটিযুক্ত, সেখানে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ একেবারেই কম। তারপরও খরচ করতে দেওয়া হয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে প্রকৌশলী তৌহিদুজ্জামানের কক্ষে কয়েক দফা গিয়েও পাওয়া যায়নি। অভিযোগ লিখে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালে দেখেও সাড়া দেননি তিনি।

একের পর এক অপরাধের পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘তৌহিদের ব্যাপারে এর আগেও বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ ছিল। তদন্ত কমিটিও হয়েছে। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদন এখনো অধিদপ্তরে দেওয়া হয়নি। এক্স-রে সি-আর্ম যন্ত্রের ডিভাইস চুরির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধানও অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করব। নানামুখী চাপ থাকায় বরাদ্দ ফেরত যায়।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত